আলোচিত ১ জুলাই ২০২৪। দিনটি ছিল সোমবার। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদ এবং কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে লাগাতার আন্দোলনের সূচনা করেছেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলে উত্তাল ক্যাম্পাস। ৩ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন শিক্ষার্থীরা। তবে সেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে প্রতি দিনের মতো বিএনপিকে নিয়ে আওয়ামী লীগ পড়েছিলেন।
সেদিন দুপুরে তেজগাঁও ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে এক আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, বিএনপির নেতাদের চোখে ঘুম নেই। তাদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। মির্জা ফখরুলের (বিএনপির মহাসচিব) চোখে অশান্তির আগুন। লন্ডন থেকে ফরমান আসে ‘ইন অ্যান্ড আউট’। বিএনপিতে এখন ‘ইন-আউট’ চলছে। সেই ওবায়দুল কাদের আজ দেশ থেকে পালিয়ে ‘ভারতে’ অবস্থান নিয়েছেন। দলের এই ক্রান্তিলগ্নে হয়তো তার আজ ঘুম হারাম হয়ে গেছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
দীর্ঘ ১৬ বছর ক্ষমতা থাকা দল আওয়ামী লীগ ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। দলের সভাপতি সেদিন ভারতে পালিয়ে যান। তার দলের নেতাকর্মীরা আত্মাগোপনে চলে যান। আওয়ামী লীগ ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হলেও সেই আন্দোলনের বীজ রোপন করা হয় ১ জুলাই। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ ৫৬ শতাংশ কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদ এবং কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে লাগাতার আন্দোলনের সূচনা করেছেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সেদিন মানববন্ধন, সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলে উত্তাল ছিল ক্যাম্পাস।
তার আগে ২০২৪ সালের ৫ জুন বিচারপতি কেএম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। সেই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতেই কোটা বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়।
এদিকে গত বছরের ১ জুলাই বাংলাদেশ এক অবিশ্বাস্য ঘটনার সাক্ষী হয়। এদিন শিক্ষার্থীদের ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে’ রূপ নেয়। এটি ছিল প্রায় ১৬ বছরের আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সূচনাবিন্দু। ১ জুলাই এই আন্দোলন পুরো মাত্রায় শুরু হলেও এর গোড়াপত্তন ঘটে ২০২৪ সালের ৫ জুন। ওইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীরা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রাস্তায় নামে। ৩০ জুন সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ঘোষণা না আসায় ১ জুলাই ঢাবি, জগন্নাথ, জাবি, রাবি, চবি, বরিশাল ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমে পড়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণ থেকে একটি মিছিল বের করে, যা রাজু ভাস্কর্যে শেষ হয়। সমাবেশ থেকে নাহিদ ইসলাম ঘোষণা দেন, আগামী ৪ জুলাই পর্যন্ত দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ও পরীক্ষার বর্জন চলবে। তিনি তিন দিনের কর্মসূচিও ঘোষণা করেন ২ জুলাই দেশব্যাপী মহাসড়কে মিছিল, ৩ ও ৪ জুলাই রাজধানীর রাজু ভাস্কর্যে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত সরকারি কলেজ এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সমাবেশ।
১ জুলাই ছিল যেসব কর্মসূচি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : কোটা বাতিল করে বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকশ শিক্ষার্থী। দুপুরে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়ে কলাভবন, মল চত্বর, ভিসি চত্বর ও টিএসসি হয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে সমাবেশে মিলিত হয়। এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘সংবিধানের/মুক্তিযুদ্ধের মূলকথা, সুযোগের সমতা’, ‘সারা বাংলায় খবর দে, কোটা প্রথার কবর দে’, ‘১৮’র হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার’, ‘জেগেছে রে জেগেছে, ছাত্রসমাজ জেগেছে’, ‘কোটা প্রথা বাতিল চাই বাতিল চাই’, ‘কোটা প্রথার বিরুদ্ধে, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’ ইত্যাদি স্নোগান দিতে থাকেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় : বিক্ষোভ মিছিল ও ছাত্র সমাবেশ করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সমাবেশে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়’ ব্যানারে ছাত্রছাত্রীরা চার দফা দাবি জানান। সেদিন বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে এ ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে জড়ো হয়ে মিছিল নিয়ে পুরো ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে। মিছিলটি রায়সাহেব বাজার মোড় হয়ে বাহাদুর শাহ পার্ক প্রদক্ষিণ করে ক্যাম্পাসে ফিরে আসে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় : বিক্ষোভ-মিছিল ও ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থীরা। সোমবার বেলা সাড়ে ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের পাদদেশে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে বিক্ষোভ-মিছিল নিয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা ৪ দফা দাবি জানান।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় : দ্বিতীয় দিনের মতো মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থীরা। মানববন্ধন কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন লেখা সংবলিত প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন। এর মধ্যে ছিল ‘মেধাবীদের কান্না আর না আর না’, ‘কোটা বৈষম্য নিপাত যাক, মেধাবীরা মুক্তি পাক’, ‘কোটা প্রথায় নিয়োগ পেলে দুর্নীতি বাড়ে প্রশাসনে’, ‘দেশটা নয় পাকিস্তান, কোটার হোক অবসান’ ইত্যাদি। মানববন্ধন শেষে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ করেন।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় : ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পাশে ববির প্রধান গেটে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পরে মহাসড়কে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। এ সময় বক্তারা প্রতিবন্ধী ও অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠীর কোটা বাদে সব কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবি জানান।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) বিক্ষোভ করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বেলা সাড়ে ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এ কর্মসূচি পালন করেন তারা। বিভিন্ন স্লোগানে মুখরিত হয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ। এ সময় তারা ৪টি দাবি উপস্থাপন করেছিলেন।
ঠিকানা/এসআর