গত দেড় দশকে ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকতে বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শের লোকদের জোরপূর্বক গুম, নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ নানা মানবাধিকার লঙ্ঘনের আশ্রয় নিয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ধরনের বেআইনি ও অমানবিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তিনি চালু করেছিলেন ভয়ের সংস্কৃতি। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ঘটা এসব অপকর্মের সহযোগী হয়েছিল রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোও। মানবাধিকার লঙ্ঘনের এসব ঘটনা উঠে এসেছে গুম কমিশনের প্রতিবেদনে।
কমিশন বলছে, হাসিনা সরকারের আমলে গুমের বিভিন্ন ঘটনা বিচার বিভাগের নজরে আনা হয়েছিল। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, জোরপূর্বক গুমের ঘটনা রোধে বিচার বিভাগ সক্রিয় ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থাকেও নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে গত ৪ জুন দেওয়া দ্বিতীয় দফার প্রতিবেদনে এমন অভিমত তুলে ধরেছে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন গুম কমিশন। ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ :আ স্ট্রাকচারাল ডায়াগনোসিস অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের ঐ প্রতিবেদনে গুমের ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রতিটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকাও তুলে ধরা হয়। কমিশন বলছে, ‘রাষ্ট্র বনাম ব্লাষ্ট’ মামলায় দেশের সর্বোচ্চ আদালত আট দফা নির্দেশনা দিয়েছিল। বেআইনি আটক ও নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতনের ঘটনা রোধে এসব নির্দেশনা যদি সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট ও বিচারকরা সঠিকভাবে অনুসরণ করেন, তাহলে আশা করা যায় দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি হবে। প্রশস্ত হবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথ।
প্রতিবেদনে ‘বিচার বিভাগের জন্য একটি বার্তা’ শিরোনামের অধ্যায়ে গুম কমিশন বলছে, জোরপূর্বক গুম ও নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু মানবাধিকারের সবচেয়ে খারাপ দিক। এমনকি একজন দাগী অপরাধীরও তার সংঘটিত অপরাধের জন্য উপযুক্ত আদালতে বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। যদি তার কোনো অপরাধ থেকে থাকে সেজন্য আইন প্রয়োগকারী বা গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের দ্বারা তাকে জোরপূর্বক গুম বা শারীরিকভাবে নিশ্চিহ্ন করা যায় না।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা আইনের ঊর্ধ্বে নন। তাদের হেফাজতে থাকা ভুক্তভোগীদের ওপর যে কোনো ধরনের নির্যাতন, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ স্পষ্টতই অবৈধ, অসাংবিধানিক ও নিন্দনীয়। এমন পরিস্থিতিতে, যে কোনো স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে ভুক্তভোগীদের আইনের সুরক্ষা লাভের অধিকার রয়েছে। কমিশন বলছে, ভুক্তভোগীদের জোরপূর্বক গুম করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে নিজেরাই আইন ভঙ্গ করেছে। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে আইনের এই লঙ্ঘন মেনে নেওয়া যায় না। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে আইনের এই লঙ্ঘনকে প্রশ্রয় দেওয়ার সুযোগ নেই।
কমিশন বলছে, বিগত হাসিনা সরকার রাজনৈতিক ভিন্নমতের কারণে বিরোধীদের অবিশ্বস্ত করে তোলার জন্য সন্ত্রাস দমন ব্যবস্থাকে একটি সুবিধাজনক কাঠামো হিসেবে ব্যবহার করেছিল। আওয়ামী লীগের শাসনকে দীর্ঘায়িত করতে জোরপূর্বক গুম, নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং মিথ্যা মামলাও দেওয়া হয়েছিল। এগুলো এমন এক পদ্ধতি, যা শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘনই করে না, এটি চরমপন্থা সহিংসতা মোকাবিলার জন্য আইনের প্রয়োজনীয় নীতিগুলোকেই বিসর্জন দেয়। একটি রাষ্ট্র আইনবহির্ভূত পদ্ধতিতে আইনবহির্ভূত কাজের বিরুদ্ধে বিশ্বস্ততার সঙ্গে লড়াই করতে পারে না। যখন এগুলো করা হয় তখন তা জনগণের সুরক্ষার জন্য তৈরি প্রতিষ্ঠানগুলিকে ধ্বংস করে দেয়। এমনকি শেষ পর্যন্ত দেশকে কম নিরাপদ করে তোলে। সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলা অবশ্যই করতে হবে, তবে এভাবে নয়। কমিশন বলছে, আওয়ামী লীগের শাসন দীর্ঘায়িত করতে এভাবে বছরের পর বছর ধরে চলা সন্ত্রাসবাদের মিথ্যা মামলায় আসামি হওয়ার কারণে অনেক মানুষ প্রাণ দিয়েছে, তাদের কর্মজীবন নষ্ট হয়েছে, ধ্বংস হয়েছে শিক্ষাজীবন। অনেকে হয়েছে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। ভুক্তভোগীরা কঠিন মানসিক ও শারীরিক আঘাত সহ্য করেছে।
গুম কমিশন বলছে, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। বিচার বিভাগ সংবিধানের রক্ষক। এমনকি জনগণের মৌলিক অধিকারের সংরক্ষক হিসেবে কাজ করে। একটি স্বাধীন ও জবাবদিহিমূলক বিচার বিভাগ কেবল গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্যই নয়, বরং টেকসই অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্যও অপরিহার্য। কেবল সমন্বিত সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমেই বাংলাদেশ একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও জনগণের আস্থার যোগ্য বিচার বিভাগ নিশ্চিত করতে পারে। যদি মানুষের এই ধারণা হয় যে, নির্বাহী ও আইন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করছে না (দুর্ভাগ্যবশত এটি এই দেশের মানুষের ধারণা), তবে বিচার বিভাগের কোনো স্থান থাকে না।
ঠিকানা/এসআর