বিশেষ প্রতিনিধি : হাজিরা না দিলে চাকরি থাকবে না-বিধানের মতো রাজনৈতিক স্টাইলে ভারতমুখী হওয়ার প্রবণতা বাংলাদেশের কয়েকটি দলের। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদল ফিরে এসে জানিয়েছে, দিল্লি তাদের পাশে ছিল-আছে-থাকবে বলে আশ্বাস দিয়েছে। এরই মধ্যে জাপার প্রতিনিধিদল হিসেবে জিএম কাদের দম্পতিও দিল্লি সফর দিয়ে এসেছেন। আমীর খসরু মাহমুদের নেতৃত্বে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদলও ভারত সফরের আমন্ত্রণের অপেক্ষায়। জামায়াতে ইসলামী ছাড়া নির্বাচনের মাঠে পারফর্মে সক্ষম বাদবাকি দলগুলোর এভাবে ভারতের দিকে হেলে পড়ার রহস্য ওপেন সিক্রেট। সোভিয়েত ইউনিয়নের যুগে চেকোশ্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, পূর্ব জার্মানির মতো পূর্ব ইউরোপের ছোট ছোট সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে মস্কোর যে সম্পর্ক ছিল, এখন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সেই সম্পর্কের আভাস স্পষ্ট। বাংলাদেশকে নিয়ে
যুক্তরাষ্ট্র যখন মরিয়া, ভারত তখন আসলে কী চায়-এ প্রশ্নের ঘূর্র্ণিপাক চলছে বেশ কয়েক দিন ধরে। ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম টার্গেট। এ সময়ে আনন্দবাজার, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য হিন্দুসহ ভারতের পত্রপত্রিকাগুলোতে নানা তথ্য প্রিটিকশনের গরম খবরের ছড়াছড়ি। জি-২০ সম্মেলন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকে সামনে রেখে তাদের খবরচর্চার ঝাঁজে তোলপাড় বাংলাদেশ। তাদের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ দিয়েছে বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের ঐকমত্যের খবর। এতে বলা হয়, আগামী সেপ্টেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময় ভারতীয় সংস্থা দুটি স্পষ্ট বার্তা দিতে পারে। প্রথম বার্তা হচ্ছে-বাংলাদেশে আসন্ন সাধারণ নির্বাচন অবশ্যই অবাধ ও সুষ্ঠু হতে হবে। আর দ্বিতীয় বার্তা-আওয়ামী লীগে শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে, দল থেকে তাড়াতে হবে চীনপন্থী ও ইসলামপন্থী নেতাদের। এর ঠিক কদিন আগে আনন্দবাজার সংবাদ দিয়েছে, ভারত শেখ হাসিনাকেই চায়। তারা যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাতে পেরেছে, শেখ হাসিনাকে সরালে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র উভয়েরই ক্ষতি হবে।
নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ভারত তত ফ্যাক্টর হচ্ছে। নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়াচ্ছে ভারত। এর সুফল তারা পেতে শুরু করেছে। এ পালে বাতাস দিচ্ছে দেশটির গণমাধ্যম। এর জেরেই আনন্দবাজার ‘শেখ হাসিনাকে দুর্বল করলে সবার ক্ষতি’ মর্মে বার্তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে। এ নিয়ে প্রতিক্রিয়ার মাঝেই দ্য টেলিগ্রাফ কিঞ্চিৎ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের সামনের নির্বাচনের বিষয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের ঐকমত্যের খবর দিয়েছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশের মধ্যে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হলেও ভারত কখনো প্রশ্ন তোলেনি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ৯৬ শতাংশের বেশি আসনে জয় পাওয়ার পর শেখ হাসিনাকে প্রথম অভিনন্দন জানিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। অর্থাৎ নির্বাচনের ফলাফল যতক্ষণ পর্যন্ত শেখ হাসিনার পক্ষে থাকবে, ততক্ষণ ভারত এর সুষ্ঠুতা নিয়ে চিন্তা করবে না। শেখ হাসিনাকে নয়াদিল্লি সর্বদা তার প্রতিবেশীদের মধ্যে সবচেয়ে বিশ্বস্ত মিত্র হিসেবে বিবেচনা করে। মোটকথা, শেখ হাসিনা এখনো ভারতের নিরঙ্কুশ প্রিয়।
ভারতের উৎকণ্ঠা শুধু শেখ হাসিনার অতি চীন-নির্ভরতা নিয়ে। বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই একটি ফ্যাক্টরই ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এক করেছে। এ নিয়ে দেন-দরবারে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে আরও কয়েকটি দেশের প্রতিনিধি ছিলেন। বৈঠকও হয়েছে দুই দেশের বাইরে অন্য কয়েকটি দেশে। দুই পক্ষই বাংলাদেশের ক্ষমতাকাঠামো, আওয়ামী লীগ, সরকারসহ সব জায়গাতেই চীনপন্থী ও ইসলামপন্থী উপাদান নিয়ে চিন্তিত। তারা এ পরিস্থিতির আশু পরিবর্তন চায়। একই সঙ্গে তারা মনে করে, একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের অধীনে হতে হবে। ভারতীয় গণমাধ্যমে জোরালোভাবে উঠে আসা এসব তথ্যের সূত্র উল্লেখ নেই। পুরোটাই যুক্তিনির্ভর। বাস্তবতা হচ্ছে-সরকার এখন চাইলেই চীন থেকে মুক্ত হতে পারছে না। বাংলাদেশ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে যোগ দেওয়ার পর বেইজিংয়ের কাছ থেকে ৩৮ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ পেয়েছে। এ ছাড়া চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক বন্ধুও। বর্তমানে সিনো-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ২৫ বিলিয়ন ডলার। যেখানে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসার পরিমাণ ১০ বিলিয়ন ডলার আর ভারতের সঙ্গে ১৮ বিলিয়ন ডলার।
এ ছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্কের মূলে আছে প্রতিরক্ষা খাত। এ সম্পর্ক শুরু হয় ১৯৮০ সাল থেকে। বর্তমানে বাংলাদেশের সামরিক প্রয়োজনীয়তার ৭২ শতাংশ মেটায় চীন। বাংলাদেশের সামরিক খাতে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতির বিষয়টি ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশের জন্যই চিন্তার বিষয়। এ ক্ষেত্রে রাশিয়াও প্রাসঙ্গিক। সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসছেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। আগামী ৭ ও ৮ সেপ্টেম্বর তিনি ঢাকায় অবস্থান করবেন। ঢাকা সফরে ল্যাভরভ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। বৈঠক হবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গেও। আগামী সেপ্টেম্বরে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জি-২০ সম্মেলনে যোগ দেবেন ল্যাভরভ। ঢাকা হয়ে দিল্লিতে যাবেন তিনি। ঢাকা ও মস্কোর কূটনীতিকদের মাঝে এ নিয়েও অনেক বিশ্লেষণ। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, রোহিঙ্গা, খাদ্য নিরাপত্তা, জাতিসংঘে বাংলাদেশের সমর্থনসহ বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক বিষয়াদিও রয়েছে রাশিয়ার সঙ্গে।