মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বর্তমানে এক জটিল রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছেন।
অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা, অভিবাসনবিরোধী সহিংস বিক্ষোভ, প্রযুক্তি জগতের প্রভাবশালী ব্যক্তি ইলন মাস্কের সঙ্গে প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে তার অবস্থান - সব মিলিয়ে ট্রাম্পকে ঘিরে তৈরি হয়েছে গভীর উদ্বেগ ও বিতর্ক। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই মুহূর্তে ট্রাম্প যেন সত্যিকার অর্থেই ‘মহাবিপদে’ রয়েছেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই ট্রাম্প একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেন। তিনি প্রথমেই গ্রিনল্যান্ড দ্বীপ কিনতে চাওয়ার ঘোষণা দেন, যা ডেনমার্কসহ ইউরোপীয় নেতাদের তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়।
এরপর তিনি বলেছিলেন, পানামা খাল আবারও মার্কিন নিয়ন্ত্রণে নেওয়া উচিত। এমনকি প্রতিবেশী দেশ কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন অঙ্গরাজ্যে পরিণত করার মতো বিস্ময়কর ঘোষণাও দেন।
ট্রাম্পের অর্থনৈতিক অবস্থানও বিতর্কিত। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানিতে একতরফাভাবে শুল্ক আরোপ করেন, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। সম্প্রতি তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স পাঠানো প্রবাসীদের ওপর কর আরোপের নির্দেশ দেন, যা বিপুল সমালোচনার জন্ম দেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পদক্ষেপ আমেরিকান প্রবাসীদের ওপর আর্থিক চাপ বাড়াবে এবং উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করবে।
ট্রাম্প বরাবরই অভিবাসন নীতিতে কঠোর অবস্থানে ছিলেন। এবারও তিনি নতুন কিছু নিয়ম বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছেন, যা ল্যাটিন আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ আরও কঠিন করে তুলবে।
এই নীতির বিরোধিতা করে সম্প্রতি লস অ্যাঞ্জেলেসে শুরু হয় অভিবাসনবিরোধী বিক্ষোভ, যা দ্রুত সহিংসতায় রূপ নেয়। সরকারি কর্মচারীদের ওপর আক্রমণের ঘটনায় ট্রাম্প ২ হাজার ন্যাশনাল গার্ড সদস্য মোতায়েনের নির্দেশ দেন।
এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, আইন প্রয়োগ প্রতিরোধের মাধ্যমে এই সহিংসতা বিদ্রোহে পরিণত হচ্ছে। যদিও ট্রাম্প ‘আইন ও শৃঙ্খলা’র রক্ষক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন, কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, এই কৌশল দেশের ভেতর আরও বিভাজন তৈরি করছে।
ট্রাম্প ও মাস্কের সম্পর্কেও দেখা গেছে নাটকীয় পরিবর্তন। একসময় ঘনিষ্ঠ এই দুই ব্যক্তিত্ব এখন প্রকাশ্যে একে অপরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। মাস্ক অভিযোগ করেন, ট্রাম্প প্রশাসন তার ব্যবসায়িক তহবিলে হস্তক্ষেপ করছে এবং তিনি স্পেসএক্সের ‘ড্রাগন’ মহাকাশযান প্রকল্প বাতিলের পরিকল্পনা এগিয়ে নিচ্ছেন।
মাস্ক এক্স (সাবেক টুইটার)-এ এক পোস্টে দাবি করেন, যৌন অপরাধী জেফরি অ্যাপস্টেইনের গোপন ফাইলগুলোতে ট্রাম্পের নাম রয়েছে। যদিও পরে তিনি পোস্টটি মুছে দেন, বিষয়টি নিয়ে মিডিয়া ও রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় শুরু হয়।
জবাবে ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, মাস্ক যদি ডেমোক্র্যাটদের অর্থায়ন করেন, তবে তাকে ভয়াবহ পরিণতির মুখে পড়তে হবে। এই উত্তেজনার মধ্যেই টেসলার শেয়ারের দাম ১৪ শতাংশ কমে যায়, যা মার্কিন অর্থনীতিতেও চাপ সৃষ্টি করে।
মধ্যপ্রাচ্য ইস্যু থেকে শুরু করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ - সব জায়গাতেই ট্রাম্পের অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি একদিকে সৌদি আরবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছেন, আবার অন্যদিকে ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমা মিত্রদের সঙ্গে মতবিরোধে জড়িয়েছেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব বর্তমানে আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে উঠছে।
শুধু বিরোধী ডেমোক্র্যাট নয়, নিজ দল রিপাবলিকানের ভেতরেও ট্রাম্পের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়েছে। তার একের পর এক বিতর্কিত বক্তব্য ও পদক্ষেপ দলের অনেক সিনিয়র নেতার অসন্তোষ ডেকে এনেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড্যান অ্যাব্রামস বলেন, ট্রাম্প এখন কেবল বিরোধীদের নয়, বরং নিজ ঘরেও একঘরে হয়ে পড়েছেন।
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বর্তমানে যে বহুমুখী চাপ সৃষ্টি হয়েছে - অভ্যন্তরীণ বিক্ষোভ, ব্যবসায়িক ও কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং রাজনৈতিক হুমকি - তা তাকে এক জটিল পরিস্থিতির মুখে দাঁড় করিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই চাপ সামাল দেওয়া না গেলে আগামী নির্বাচনে তার অবস্থান আরও দুর্বল হয়ে পড়বে।
ট্রাম্পকে এখন শুধু রাজনৈতিক বিরোধীদের নয়, বরং নিজ দলের বিভক্তি, প্রযুক্তি ও করপোরেট লবির আক্রমণ এবং আন্তর্জাতিক নেতাদের সমালোচনার মুখে এককভাবে প্রতিরোধ গড়তে হবে।
এই মুহূর্তে ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘মহাবিপদে’ রয়েছেন - এমন পরিস্থিতিতে প্রতিটি পদক্ষেপ তাকে আরও জটিল সংকটে ফেলছে। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ, সামাজিক অস্থিরতা এবং বৈশ্বিক সমালোচনার আবর্তে পড়া এই প্রেসিডেন্টের ভবিষ্যৎ এখন সবচেয়ে অনিশ্চিত পর্যায়ে পৌঁছেছে। তথ্যসূত্র : বিবিসি, সিএনএন ও নিউইয়র্ক টাইমস
ঠিকানা/এনআই