আয়নাঘরে বছরের পর বছর অনেকেই বন্দী ছিলেন। অনেকেই জুডিশিয়াল কিলিংয়ের শিকার হয়েছিলেন। অনেককেই খুন করা হয়েছিল। এ ছাড়া নিরীহ আলেম-ওলামাদের জঙ্গি সন্দেহে নির্মম নির্যাতন করা হয়েছিল। অথচ এসব আলেমের শরীর তল্লাশি করে খোদাপ্রদত্ত জন্মগত দুটি বুলেটের একটি বন্দুক ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি, যা দিয়ে জীবন সৃষ্টি ছাড়া কোনো জীবন হরণ করা সম্ভব নয়।
এ রকম হাজার হাজার মানুষের বছরের পর বছর কান্না ও আহাজারিতে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠেছিল। এর ফলে অভাবনীয়ভাবে এসেছিল জুলাই বিপ্লব। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অপমানজনকভাবে বিদায় নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। ১৫ বছর পর মুক্তির আনন্দ পেয়েছিল বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষ। উপভোগ করেছিল নতুন স্বাধীনতা।
কিন্তু স্বাধীনতাকে নিরবচ্ছিন্ন করার জন্য যে দূরদর্শী নেতৃত্ব, রাজনৈতিক ঐক্য দরকার ছিল, তার অনুপস্থিতি দুঃখজনকভাবে বর্তমান। দেশে সুশাসন ও সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য যে কর্মসূচি নেওয়া দরকার ছিল, তা নিতে বিপ্লবের কুশীলবরা ব্যর্থ হয়েছেন।
ফলে দেশে একই সময়ে সমান্তরাল দুটি সরকার ও বহুধাবিভক্ত রাজনৈতিক দলগুলো সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক কাজ হিসেবে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে পুনর্গঠন না করেই কেউ সংস্কার, কেউ নির্বাচন এসব জিকির তুলে বাতাস গরম করে ফেলেন। রাজনীতির গরম বাতাসে জেনারেল ওয়াকারের বক্তব্য ঝোড়ো হাওয়া বইয়ে দিয়েছে। সরকারপ্রধান ড. ইউনূস এ রকম উত্তপ্ত সময়ে কাজের পরিবেশ নেই বিধায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে। সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে তাঁকে কাজের পরিবেশের নিশ্চয়তা যেমন ক্ষমতায় ডেকে নিয়ে আসার সময় দিয়েছিলেন, তেমনি আবার না দিলে তিনি থাকবেন না বলেই ধরে নেওয়া যায়।
তিনি চলে গেলে কার লাভ কার ক্ষতি? রাজনীতির বড় ভাই বিএনপি ভাবছে, এনসিপি ও জামায়াত-শিবিরের ক্ষতি হবে। তাদের আর কেউ সরকারে থাকবে না। এনসিপির নাবালক নেতারা আগেই বিভেদ সৃষ্টি করে এখন খামোশ হয়ে দুঃখ প্রকাশ করছেন, কিন্তু কাজ হচ্ছে না। হঠাৎ ক্ষমতাসীন ক্ষমতাসীন ভুয়া ভাব নেওয়া জামায়াত-শিবির ভাবছে ঐক্যের জন্য চেষ্টা করছি।
কেউ কথা না শুনলে আমাদের কী করার আছে। ক্ষতি যা হওয়ার তা তো বিএনপি আর এনসিপির হবে। আমরা তো আর ভোটে ক্ষমতায় যাচ্ছি না।
আসলে সবার ক্ষতি হবে। কীভাবে তা বুঝতে হলে ওয়ান ইলেভেনে চলে যান। প্রথমে বিএনপিকে ধরল। দুর্নীতির অভিযোগে বিএনপির প্রায় সব বাঘা বাঘা নেতা জেলে গেলেন। তারেক রহমানের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হলো। তখন জামায়াত ভাবল তারা ফেরেশতাতুল্য, তাই তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। মইন উ আহমদের সরকার তারপর বিদেশিদের ছকে একটি নির্বাচন দিয়ে চলে গেল। সেই সরকার প্রথমে জামায়াতের ওপর নির্যাতন শুরু করল। এবার বিএনপি ভাবল, আমরা তো আর যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত নই। তাই এটা একান্তই জামায়াতের বিষয়। প্রথম দিকে একটু নীরব থাকল। এরপর দেখল, এই খেলা এখানেই শেষ নয়। এখানে শুরু মাত্র। খেলার আসল টার্গেট বিএনপি। তখন বিএনপি-জামায়াত একে অন্যের সঙ্গে মিলে একাকার হয়ে হাহাকার শুরু করল। কিন্তু তত দিনে বেশ দেরি হয়ে গেছে। রাজনীতি তাদের কন্ট্রোল থেকে দূরে চলে গেছে।
ড. ইউনূস চলে গেলে এবার কি এর ব্যতিক্রম হবে? প্রথমে কার ওপর নির্যাতন আসবে? তারপর কার ওপর? বিএনপি হয়তো ভাবছে তারা বড় দল, তাদেরকে কেউ কিছু করতে পারবে না। এনসিপি ও জামায়াতকে সাবাড় করার পর সারা দেশে চাঁদাবাজি, দখলসহ বিভিন্ন অপরাধের জন্য মামলার জালে বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীদের ফেলে আটক করলে কেউ পাশে দাঁড়ানোর মতো থাকবে না। অতীতে বেগম জিয়ার পাশে ছিলেন একমাত্র কাজের মেয়ে ফাতেমা। এখন তারেক রহমানের পাশে কে থাকবে বলে আপনি মনে করেন? এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হোক, তা কারও কাম্য হতে পারে না।
উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠন না করে ড. ইউনূসকে বিদায় করার চিন্তায় তারেক রহমানকে কে, কীভাবে কনভিন্স করল, তা জানি না। তিনি আসলেই কনভিন্সড কি না, তাও জানা নেই। জেনারেল মইন তারেক রহমানের মেরুদণ্ডের যেখানে আঘাত করেছিলেন, সেখানে জেনারেল ওয়াকার তেল মালিশ করে প্রায়শ্চিত্ত করার ওয়াদা করেছেন কি না, তাও জানা নেই। শুধু জানি, সেনাবাহিনী রাজনীতি থেকে যত দূর সম্ভব দূরে থাকলে ভালো। রাজনীতিকেরা দেশের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ থেকে গণতন্ত্র ও সুশাসনের পথে এগোলে দেশের মানুষের ভালো হয়।
ড. ইউনূসের চলে যাওয়ার পায়ের আওয়াজ শুনে অনেক রাজনীতিক এখনই জেনারেল ওয়াকারের পক্ষে কথা বলতে শুরু করেছেন। এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। কোনো রাজনীতিকের তো আর শরীরে মেরুদণ্ড দুটো নেই যে একটি ভেঙে ফেলা হলে আরেকটি দিয়ে দাঁড়াতে পারবে। তারেক জিয়ার মতো বিদেশে গিয়ে ভালো চিকিৎসার সুযোগও যে সবার জুটবে, তাও নিশ্চিত নয়। তাই সত্যিই যদি ড. ইউনূস চলে যান, তাহলে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে রাজনৈতিক নেতারা জেনারেল ওয়াকারের কথায় লেফট-রাইট করবেন। ডানে ঘুরো-বামে ঘুরোÑযখন যেভাবে দাঁড়াতে বলবেন সেভাবেই দাঁড়াবেন। কিন্তু দিন শেষে জেনারেল ওয়াকারকেও মইন উ আহমেদের মতো কারও সঙ্গে দরকষাকষি করে কোনো রকমে একটি নির্বাচন করে পশ্চিমা কোনো দেশে পালাতে হবে।
বাস্তবে দেশের জন্য দরকার এই চক্র ভেঙে ফেলা। যে দেশের রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা থাকে, সেখানে উন্নয়ন ও সুশাসন পালিয়ে বেড়ায়। এখন ব্যক্তিগত ও দলীয় লাভ-লোকসানের চিন্তার সময় নয়। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সবার ঐক্য দরকার। দরকার একজনের পাশে আরেকজন দাঁড়ানো। এই কর্তব্য পালনে দেশের মানুষ ও রাজনীতিকেরা ব্যর্থ হলে সবার ভাগ্যই নিয়তির হাতে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া কারও সামনে কোনো পথ খোলা থাকবে না। তখন আফসোস করেও লাভ হবে না। সবার শুভবুদ্ধির উদয় হোক। ভালো থেকো বাংলাদেশ।
লেখক : রিয়েলটর ও মর্টগেজ ব্যাংকার, মিশিগান।