ছাত্র-জনতার ইতিহাস সৃষ্টিকারী অভ্যুত্থানের সাত মাস পূর্ণ হলো। এই সময়ের মধ্যে ঢাকা শহর ও ঢাকা জেলায়ই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ৩৫০টি মামলা হয়েছে। ঢাকায় আওয়ামী লীগ সরকারের ২৫ জনের অধিক সাবেক মন্ত্রী, উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী, এমপি, প্রভাবশালী দলীয় নেতা এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন মহানগর ও জেলায় শেখ হাসিনাসহ সাবেক এমপি-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ছয় শতাধিক মামলা হয়েছে।
জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কারাগারে রয়েছেন সাবেক ৫৭ জন এমপি ছাড়াও ১৪ জন সাবেক আমলা। এ পর্যন্ত ৩১ জন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপদেষ্টাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশের দুজন সাবেক মহাপরিদর্শক গ্রেফতার হয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অন্যায়ভাবে সহযোগিতা করাসহ বিভিন্ন মারাত্মক অভিযোগে। গুলি করে হত্যা, হত্যার প্রচেষ্টা, অপহরণ, অত্যাচার, গুম ও নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে শেখ হাসিনাসহ সাবেক মন্ত্রী, উপদেষ্টা, এমপিদের বিরুদ্ধে।
সরকারি পরিসংখ্যান মতে, জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছেন ৮৪৪ জন। আহত হয়েছেন ১৩ হাজার ২৫৮ জন। এসব হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ৩৫০টি মামলা হয়েছে। রাজধানীর এসব মামলায় আসামি হিসেবে রয়েছেন সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আনিসুল হক, শাজাহান খান, রাশেদ খান মেনন, আমির হোসেন আমু, দীপু মনি, মুহাম্মদ ফারুক খান, এবিএম তাজুল ইসলাম, মোশাররফ হোসেন, হাসানুল হক ইনু, এম এ মান্নান, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, টিপু মুন্সি, সাধন চন্দ্র মজুমদার, নুরুল ইসলাম সুজন, ড. আবদুর রাজ্জাক, ফরহাদ হোসেন, ইমরান আহমদ, উবায়দুল মুক্তাদির চৌধুরী, আবদুস শহীদ, নুরুল মজিদ হুমায়ুন, রমেশ চন্দ্র সেন, সাবের হোসেন চৌধুরী, গাজী গোলাম দস্তগীর, আবদুল লতিফ ও উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। তারাসহ গ্রেফতারকৃত সকল সাবেক প্রতিমন্ত্রী, উপদেষ্টাদের কয়েকজন জামিনে আছেন, অন্যরা কারাগারে। অভিযুক্ত সাবেক এমপি, মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতাদের অধিকাংশ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে রয়েছেন। কয়েকজন আগেই সিঙ্গাপুর, দুবাই চলে যান।
জানা যায়, গণ-অভ্যুত্থানের পর বেশ কিছুদিন সাবেক এমপি, মন্ত্রী, শীর্ষস্থানীয় কেন্দ্রীয় ও মহানগর, জেলা পর্যায়ের হাজারখানেক নেতা আত্মগোপনে চলে যান। অনেকে পালিয়ে ভারতে চলে যান। অধিকাংশই অত্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে ছিলেন। অনেকে আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে ছিলেন। পরে সেখান থেকে কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। স্বল্পসংখ্যক ছাড়া সবাই ভারতে চলে যান। সাবেক এমপি, মন্ত্রী, দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে ঢাকা ও অন্যান্য মহানগরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিকল্পিতভাবেই মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলা দায়েরের পরিকল্পনা ও মামলা রজু করার ব্যাপারে নেপথ্যে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে জামায়াত ও তার পরামর্শমাফিক অপর কয়েকটি ধর্মীয় সংগঠনের লোকজন। মামলা দায়েরকারীরা ধর্মীয় সংগঠনের কেন্দ্রীয় মহানগর, জেলা, উপজেলা কমিটির পদাধিকারী, সদস্যও নন। তবে দলের সঙ্গে জড়িত। গ্রেফতার ও মামলা দায়েরের উদ্দেশ্য আগামী নির্বাচন থেকে তাদের দূরে রাখা, নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা। বিচারের মাধ্যমে দ্রুত দণ্ডিত করা হবে এদের, যাতে দণ্ডিত ব্যক্তিরা উচ্চ আদালতে আপিল করে জামিন ও নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে না পারেন। সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপিসহ আওয়ামী লীগের সম্ভাবনাময় প্রার্থীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি ও তাদের দণ্ডিত করার যথাযথ ব্যবস্থা করা হবে। তারা যাতে উচ্চ আদালতে গিয়ে জামিন নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আইনগত সুযোগ না পান, সে ব্যবস্থাও করা হবে। অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে আপিল নিষ্পত্তি করা হবে। আগামী তিন-চার মাসের মধ্যে শেখ হাসিনার মামলা নিষ্পত্তি করার প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে।
চলতি বছরের অক্টোবর-নভেম্বরের মধ্যেই মামলাগুলোর চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করা হবে। বিএনপি অতিদ্রুত, সর্বাধিক এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়। বিএনপির জোরালো দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জামায়াত নেতারাও এ বছরের মধ্যে নির্বাচন চেয়েছেন। সাবেক এমপি, মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না করে নির্বাচন করা হলে, অর্থাৎ আওয়ামী লীগের লোকজনের জন্য নির্বাচনী দুয়ার অবারিত রেখে নির্বাচন করা হলে পরিবেশ বিএনপি-জামায়াতের অনুকূলে না-ও থাকতে পারে। এদিকে ভারত সরকার বাংলাদেশের পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে রাখার জন্য সম্ভাব্য সব প্রক্রিয়াই অনুসরণ করছে। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে দূরদর্শী জামায়াত নেতৃত্ব এবং বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা একটু সময় নিয়ে হলেও আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও নেতাদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পথ আইনগতভাবেই রুদ্ধ করার কাজটি অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। এ কারণেই প্রধানত এ বছর নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে নয় জামায়াত ও বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা।