জুলাই বিপ্লব নামে পরিচিত ছাত্র-জনতার আন্দোলন হচ্ছে বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক গণঅভ্যুত্থান, যা ২০২৪ সালের ৫ জুন থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত অগণিত প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার মধ্য দিয়ে বিগত ১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটিয়েছে। ঐতিহাসিক এই বিপ্লবের বিজয়ের ধারার সূচনা হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতি বাতিলের দাবির আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এটি পরে সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে আরও প্রবল হয়ে উঠেছিল, যা ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। প্রায় ১৫০০ মানুষকে হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে বিগত প্রায় ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশকে শাসন করার পর শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান।
শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল তাদের শিক্ষা-সংক্রান্ত বিষয়ে। আওয়ামী লীগ সরকার এক বছর বা তারও আগেই এর সুরাহা করতে পারত। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অযোগ্য, অদূরদর্শী তরুণ নেতৃত্ব তা করেনি। মূলত শেখ হাসিনা ও তার সরকারেরই বিষয়টি নিয়ে আগ্রহ ছিল না। আদালতে গড়ানোর আগেই মন্ত্রণালয় সম্মানজনক নিষ্পত্তি করতে পারত। শেষ পর্যন্ত আদালত কর্তৃক বাস্তবে রূপ দেওয়া হলো কেন? প্রশ্ন উঠেছে, এর পেছনে কারা, কেন ইন্ধন দিয়েছে, কারা আর্থিকসহ প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা দিয়েছে? বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা কারা, কী তাদের পরিচয়? কারও মতে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ২০০ কোটি টাকা চাওয়া হয়। কারও মতে, হাজার কোটি। পরিমাণ যা-ই হোক, নিঃসন্দেহে তা বিশাল অঙ্কের। শিক্ষার্থীরা কোথা থেকে এই অর্থ পেল। ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হকের সঙ্গে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের যোগাযোগ পত্রিকায়ও এসেছে। তৎকালীন সরকার বিষয়টি খতিয়ে দেখেনি। কারা বা কোন দেশ কী স্বার্থে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছে, তা পরিষ্কার করে জানা না গেলেও বোঝা যায়, শেখ হাসিনা সরকারের অপসারণই ছিল অনেকের উদ্দেশ্য। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সম্ভাব্য ভয়ংকর রাজনৈতিক দুর্যোগের আভাস দিয়েছিলেন। কূটনৈতিক সূত্র জানায়, শেখ হাসিনা এই সতর্কবার্তা আমলে নেননি। হাসিনা সরকারের পতনের দুই মাস আগে হঠাৎ করেই ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর ঝটিকা সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। সকালে এসে বিকেলেই ফিরে যান। জানা যায়, শেখ হাসিনাকে ভারত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছিল। শেখ হাসিনা সবকিছু তার নিয়ন্ত্রণে বলে তেমন একটা আমলে নেননি। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস, অনেকের মতে অহংকার থেকেই শেখ হাসিনা দেশি-বিদেশি পরামর্শ কখনোই তেমন একটা আমলে নেননি।
এদিকে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষরা সরকার হটানোর সর্বাত্মক প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম দ্রুত গুছিয়ে আনে। জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের ওপর আওয়ামী লীগ জেল-জুলুম, হামলা-মামলা-নির্যাতন অব্যাহত রাখে। অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে জামায়াতও সর্বাত্মকভাবে সরকার পতনের আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়। জুলাইয়ের মাঝামাঝি শিক্ষার্থীদের দাবিকে ইস্যু করে আন্দোলন শুরু করার তিন মাস আগে থেকেই নেপথ্যের উদ্যোক্তারা সক্রিয় ছিলেন। নেপথ্যের এই উদ্যোক্তারা হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের নেতৃত্বাধীন ইসলামী কয়েকটি সংগঠন। সরকার পতনের এক দফা যে হঠাৎ করে এল, তা নয়। মূল লক্ষ্য, উদ্দেশ্যই ছিল তা। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাসংক্রান্ত দাবি ছিল বাহ্যিক ইস্যু মাত্র। শিক্ষার্থীদের দাবি আদালত কর্তৃক স্বীকৃত ও সরকার মেনে নেওয়ার পর আর কোনো আন্দোলনের প্রয়োজন ছিল না। জামায়াত ও তাদের সহগামী ধর্মীয় কয়েকটি সংগঠন রাজধানী ও এর পাশের গাজীপুর, টাঙ্গাইল, সাভার, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জের সব মাদ্রাসা শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের প্রস্তুত রাখে। ঢাকা শহরে ও আশপাশের মেসে, হোটেলে, বাসাবাড়িতে, আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে তাদের অবস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। পরিকল্পনা মাফিক একযোগে তারা রাজপথে নামে। বিশাল এই জনস্রোত সামাল দেওয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে সম্ভব ছিল না। পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা চরম অসহায়ত্বের মধ্যে প্রাণ নিয়ে বাঁচার পথ খোঁজেন। থানা, ফাঁড়িতে হামলা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোবল ভেঙে দেওয়া ছিল তাদের অন্যতম লক্ষ্য। তাতে তারা সফল হয়।
শেখ হাসিনা দলের ও জোটভুক্ত প্রবীণ অভিজ্ঞ নেতাদের ন্যূনতম মূল্যায়ন করেননি। সরকার গঠন করেন নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী। দেশ পরিচালনা নিয়ে অনেকের মতে শেখ হাসিনা রীতিমতো ছেলেখেলা করেছেন। কোনো পর্যায়েই তিনি তাদের ডাকেননি, বুদ্ধি-পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। তাদের যখন ডাকেন, তখন আগুন ছড়িয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। পতনের কয়েক দিন আগে আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমদ, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু প্রমুখ প্রবীণ নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন। এতেই সিদ্ধান্ত হয় সেনা মোতায়েনের। মাদ্রাসার শিক্ষার্থী, সাধারণ শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ ততক্ষণে রাজপথে শক্ত অবস্থান নিয়ে নিয়েছে। বিভিন্ন স্থানে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় আরও অসংখ্য মানুষ। সরকারি, বেসরকারি কর্মজীবী, শ্রমজীবী মানুষ, বেকার যুবকরাসহ সর্বস্তরের মানুষ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে রাজপথে নেমে আসেন। সমাজের সর্বস্তরের মানুষই ছিল অসন্তুষ্ট, ক্ষুব্ধ। তারা এই দুঃশাসনের কবল থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজছিল। শেষ মুহূর্তে বাঁচার শেষ চেষ্টা হিসেবে সেনাবাহিনীকে মোতায়েন করা হয়। কিছু সেনাসদস্যেরও সরকারের পক্ষে ভূমিকা রাখার উপায় ছিল না। হাজার হাজার মানুষকে গুলি করে হত্যা করে সরকারকে রক্ষা করার তাগিদ বোধ করেননি দেশপ্রেমিক সেনাসদস্যরা। তারা বন্দুকের নিচের দিকে রাখা নল আর উঁচিয়ে ধরেননি। উত্তাল জনবিদ্রোহে পালাতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবির ও কয়েকটি ইসলামী সংগঠন ছাড়াও সরকারের বিপক্ষে মানুষকে পরিকল্পিতভাবে সংগঠিত করতে বিশাল ভূমিকা রাখে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা।



ঠিকানা অনলাইন


