দ্যুতিময় : বিশ্বে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা বাড়ছে। সম্প্রতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি সমিতির মহাসম্মেলনে দাবি করা হয়, ভাষার ক্রমতালিকায় বিশ্বে বাংলা ভাষা তৃতীয় স্থানে রয়েছে। প্রবাসী বাংলাভাষীরা এবং নতুন প্রজন্ম কত দিন এই দূর-প্রবাসে বাংলাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন? এই প্রশ্ন এখন সামনে এসেছে।
যেসব বাঙালি মা-বাবা বিদেশে সন্তান জন্ম দিয়েছেন বা দেশ থেকে শিশু অবস্থায় তাদের নিয়ে গেছেন, সেসব বাবা-মায়ের অনেকেই সন্তানদের সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির সম্পর্ক ধরে রাখতে বেশ সচেষ্ট। তাঁরা সন্তানদের বাংলা গান, উপমহাদেশীয় নৃত্য, আবৃত্তি, নাটক ইত্যাদির ওপর প্রশিক্ষণের জন্য অনেক পরিশ্রম করেন। এসব ছেলেমেয়ের অনেকে পয়লা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারি, বসন্ত উৎসব, জন্মদিন, ঈদ-বিয়ে-পূজা-পার্বণে তাঁদের অর্জিত কলা প্রদর্শন করে থাকেন। প্রশংসাও পান। অনেক মা-বাবা, বয়োজ্যেষ্ঠরা সকালে উঠে বা কাজ থেকে ফিরে রবীন্দ্রসংগীতের সিডি ছেড়ে দেন, যাতে তাঁদের নতুন প্রজন্ম ঘরে বাঙালিয়ানার আবহে নিজেদের শিকড়কে ভুলে না যান।
প্রবাসে এ রকম বাঙালির সংখ্যা অনেক হলেও এসব করেন না এমন পরিবারও আছে, যাঁরা বাঙালিপনা দেখানো পশ্চাৎপদতা ভাবেন। ইংরেজি বলা বা ও দেশীয় কেতায় চলাফেরা করার জন্যই তো তাঁরা এ গরিব মাটি ছেড়েছেন। ওখানে গিয়েও বাংলা বাংলা করলে কবে তাঁরা সাহেব-সুবো হতে পারবেন? বাংলাদেশে যাঁরা ইংরেজি মাধ্যমে সন্তানদের পড়ান, তাঁরাও মূলত ভবিষ্যতে সন্তানদের ইউরোপ-আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ তথা স্থায়ী করার উচ্চাকাক্সক্ষা লালন করেন। আর প্রবাসে বাড়িতে বাংলা বলা নিরুৎসাহিত করেন, ছুরি-কাঁটায় খাওয়া শেখান, মাম্মি, ড্যাডি না ডাকলে লজ্জিত হন, তাঁদের শিশুরা বড় হয়ে ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পায়ে ঠেকাই মাথা’ বলে জনান্তিকে মাথা কুটবেন-এ কি বেশি চাওয়া হয়ে যায় না? তারপরও এই প্রবাসে আমাদের আশা দেখায়- বিপা, বাফাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
প্রবাসে জন্ম নেওয়া বা বেড়ে ওঠা বাঙালি নতুন প্রজন্ম অভিবাসী বাবা-মা বা পরিবারের বড়দের চর্চার কারণে হয়তো বেশ কয়েক বছর বাঙালিয়ানা ষোলো আনা না হলেও চার-পাঁচ আনা ধরে রাখতে পারছে। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মকে কতটা সমৃদ্ধ করতে পারবে? তাদের স্কুল, বন্ধু, প্রতিবেশী, পরিবেশের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়াকেই তারা সহজ ও স্বাভাবিক বলে ধরে নেবে। অভিবাসী কিন্তু দেশকানা মা-বাবার কারণে দ্বিতীয় প্রজন্ম হয়তো বাংলাকে ভুলে যাবে না, কিন্তু তৃতীয় প্রজন্মের কাছ থেকে সে উৎসাহ আশা করা দুরাশাই হবে। কারণ, তৃতীয় প্রজন্মের বাবা-মা তত দিনে আর রবীন্দ্র-নজরুল-দেশাত্মবোধক গান আর শাড়ি-লুঙ্গিতে প্যাঁচানো থাকবেন না। শোনা, প্রেম-বিয়ে বা কাজের সুবাদে তাঁরা তখন কে কোথায়? তাছাড়া, জীবন-জীবিকার প্রধান হাতিয়ার যদি হয় ইংরেজি, তাহলে মাতৃভাষা হয় ‘কাব্যে উপেক্ষিত’।
প্রবাসে বাংলা ভাষা যুগের পর যুগ টিকে থাকবে কি থাকবে না, তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। তবে বারবার অধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্তিকামী অসীম সাহসী এ জাতি অর্থনৈতিক রাজনীতিকেও নিজেদের করায়ত্ত করার শক্তি রাখে বলেই আমরা বিশ্বাস করি, ভাষার প্রাধান্যের সঙ্গে যা একেবারেই পরিপূরক। তাই আমরা স্বপ্ন দেখি, বাংলাদেশে দেশপ্রেমিক শিক্ষিত-সচেতন মানুষ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম এ ভাষাটিকে একদিন ফুলেফলে পত্রপল্লবে সমৃদ্ধ করবেন। তখন প্রবাসীরা এর সুরক্ষায় যেমন লাভবান হবেন, বিদেশিরাও এ মধুর ভাষার আস্বাদ নিতে মধুকর হয়ে ছুটে আসবেন।
প্রবাসে বাংলা ভাষার প্রসারে প্রত্যেকটি বাংলাদেশি দূতাবাসের মাধ্যমে এখনই সুনির্দ্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এ ব্যাপারে আঞ্চলিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর তেমন কোন সমন্বিত ও ঐক্যবদ্ধ সাংগঠনিক প্রয়াস চোখে পড়ে না।
প্রবাসীরা বিভিন্ন দিবস বা উৎসব পালন করার মতো শোক ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ২১ ফেব্রুয়ারিকেও বেশ ঘটা করে পালন করেন। বেশ কয়েকটি দেশে শহীদ মিনার গড়ে তোলার গৌরবও অর্জন করেছেন। যেসব দেশ পিছিয়ে ছিল, তারাও এখন আর কম এগিয়ে নেই। এখন একুশ পালিত হয় জমজমাটভাবে। ভাষা দিবস সামনে রেখে প্রবাসীরা যা করছেন, তা সবই সময়োপযোগী ও প্রশংসনীয় কার্যক্রম। কিন্তু ওই একটি বিশেষ দিনে কেবল সভা-সমাবেশের ভেতরেই যেন একুশের চেতনা আটকে না থাকে, সেদিকে আমাদের বিশেষ নজর দিতে হবে। বাঙালিয়ানা কণ্ঠ বজায় রেখেও যে শুদ্ধ ইংরেজি বলা সম্ভব, সেটাও দরদ দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে। মেকি ইংরেজিতে বলীয়ান হয়ে মাতৃভাষার মর্মমূলে যেন আমরা নিজের অজান্তেই আঘাত না হানি।
যারা প্রবাসে কর্মরত, তারা ব্যক্তিগতভাবেও বিভিন্ন উপায়ে বাংলাভাষার পরিচিতি তুলে ধরতে পারেন। একজন প্রবাসী যে কোনো দেশেই বসবাস করুন না কেন, সেখানে ভিন্ন ভিন্ন দেশ থেকে আগত বিভিন্ন সহকর্মীর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। দিনে দিনে ভাব বা সখ্য গড়ে ওঠে। তার সুবাদে একজন প্রবাসী ব্যক্তি যদি দশ জন ভিনদেশির কাছে আমাদের ভাষার ঐতিহ্য, একুশের অহংকার ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার গৌরব বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হন-সে ক্ষেত্রে প্রচার ও প্রসারের মাত্রা এক বিরাট পরিসংখ্যানে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে, এমন ইতিহাস কি পৃথিবীর ইতিহাসে আরেকটি আছে?
অনেক প্রবাসী মা-বাবা সন্তান-সন্ততির সঙ্গে বাসাবাড়িতেও কথা বলার ক্ষেত্রে ইংরেজিকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। একুশের চেতনা সমুন্নত রেখে বাংলা ভাষার গৌরবোজ্জ্বল অবদান ধরে রাখতে হলে এ ধ্যান-ধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। শুধু তাই নয়, বিদেশে জন্ম নেয়া এমন অনেক শিশু-কিশোর আছে, যারা ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতে পারলেও লেখা বা পড়ার ক্ষেত্রে একেবারেই অক্ষম। সে অক্ষমতা তাদের নিজের দোষে নয়। অনেক মা-বাবার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কর্মব্যস্ততা বা সীমাবদ্ধতার দরুন বাংলায় হাতেখড়ি দিয়ে উঠতে পারেন না।
পৃথিবীর কোনো ভাষাই সম্ভবত আঞ্চলিক ভাষার প্রভাবমুক্ত নয়। এমনকি ইংরেজি ভাষাতেও রয়েছে আঞ্চলিকতার ব্যাপক প্রভাব। হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী আমাদের মাতৃভাষা বাংলাও এর প্রভাবমুক্ত নয়। সন্দেহ নেই, আঞ্চলিক ভাষা যোগ হয়ে কখনো কখনো মূল ভাষাকে অলংকারের সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ করে তোলে। কিন্তু সে আঞ্চলিক ভাষা যদি মূল ভাষার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াতে চায়, সেখানেই যত আশঙ্কা।
সব সীমাবদ্ধতা বা প্রতিবন্ধকতা থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের মা-মাটি ও প্রকৃতির ভাষা বাংলাকে এক মহানক্ষত্রে রূপান্তরিত করার চেষ্টায় ব্রত হওয়া সবারই উচিত। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী বাংলাভাষার যে আবেগঘন জোয়ার, একে কাজে লাগানোর প্রকৃষ্ট সময় এখনই। আর এভাবেই বেঁচে থাকবে বাংলা ভাষা।