বিদ্যমান এবং আগামী দিনের সম্ভাব্য বিপর্যয়াত্মক পরিস্থিতি ও নির্বাচন একযোগে মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ১৪ দল। নির্বাচনসহ সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব জোটনেত্রী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর অর্পণ করা হয়েছে।
গত ১৯ জুলাই গণভবনে ১৪ দলীয় জোটের সভা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সামনের নির্বাচন, বিশেষ করে পশ্চিমা কয়েকটি দেশের কূটকৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। তাদের ভাষায়, দেশে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়।
বৈঠক সূত্রে আরও জানা যায়, বিএনপি ও তাদের কোনো কোনো সহযোগীর স্থানীয় প্রভাবশালী গোষ্ঠী, ব্যক্তির বিদেশি যোগাযোগ সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য সংগ্রহের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। রাজনৈতিক গোলযোগ, অস্থিরতা সৃষ্টির মাধ্যমে বিগত ১/১১ এর মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা সম্পর্কে শরিকদের সতর্ক করা হয়। সতর্ক করা হয়, জাতীয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবীসহ একান্ত বিশ্বস্ত অনুগত, দলনিরপেক্ষ অবস্থানে থাকা ব্যক্তিদের সমন্বয়ে জাতীয় সরকার গঠনের পরিকল্পনা নিয়ে নেপথ্যের উদ্যোক্তারা অগ্রসর হচ্ছেন। যাদের সমন্বয়ে যে ফর্মেই এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক, বিএনপির তাতে সমর্থন থাকবে বলেও জানানো হয়। কারণ বর্তমান সরকারের স্থলে যারাই ক্ষমতায় আসুক, লাভবান হবে বিএনপিই। তাই অসাংবিধানিক যেকোনো প্রক্রিয়া, প্রচেষ্টা ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলার সম্মত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ১৪ দল। বৈঠকে অত্যন্ত জোরালোভাবে এই আস্থাও প্রকাশ করা হয়, তাদের ঐক্যবদ্ধ অবস্থানের সামনে দেশি-বিদেশি কোনো ষড়যন্ত্র, ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতা সফল হবে না। কারণ মূলত দেশের মানুষ এ ধরনের অপতৎপরতার সঙ্গে শামিল হবে না, সমর্থন করবে না। স্থানীয় যারাই এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ, পরোক্ষভাবে জড়িত হবে, তারা তাদের রাজনৈতিক অপমৃত্যুকেই ডেকে আনবে বলে উল্লেখ করা হয়।
বৈঠক সূত্রে আরও জানা যায়, ১৪ দলের শরিক দলগুলোকে আগামী নির্বাচনের জন্য দ্রুত প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম সম্পন্ন করার তাগিদ দেওয়া হয়। শরিক প্রতিটি দলকে দলগতভাবে এবং ১৪ দলীয় জোটগতভাবে প্রার্থী তালিকা দিতে বলা হয়েছে। বিএনপি শেষাবধি নির্বাচনে এলে জোটগত তালিকা থেকে মনোনয়ন দেওয়া হবে। তেমনটি না হলে অর্থাৎ বিএনপি নির্বাচনের বাইরে থাকলে শরিকেরা দলগতভাবে নির্বাচন করবে। সে ক্ষেত্রে শরিকেরা পারস্পরিক সমঝোতা ও সমন্বয়ের ভিত্তিতেই প্রার্থী স্থির করবে।
বৈঠকে উচ্চতর পর্যায় থেকে এ কথাও জানানো হয়, বিএনপি এখন পর্যন্ত নির্বাচনবিরোধী কথাবার্তা বললেও শেষ পর্যন্ত অতি নাটকীয় কিছু করতেও পারে। যেমনটি করেছিল গত সংসদ নির্বাচনে। বছরব্যাপী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করে মাত্র ছয়টি আসনের বিনিময়ে বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি এখনো রহস্যাবৃতই রয়ে গেছে। বিএনপির মহাসচিবসহ কোনো নেতাই তা খোলাসা করেননি। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে শর্তাধীনে গুলশানের বাসায় মুক্ত জীবন কাটানোর সুযোগ দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো কিছু রাজনৈতিক মহলে দৃশ্যমান নয়। এবার উন্নত চিকিৎসার নামে খালেদা জিয়াকে শর্তাধীনে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ দেওয়ার সম্ভাবনার বিষয়টি বিএনপির নেতাকর্মীদের কাছে অজানা হলেও দলের যে দু-তিনজন জানেন, তারা পুরোপুরি নিশ্চুপ। বিএনপি নির্বাচনে আসতেও পারে এবং শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের বাইরেই থাকবে-সম্ভাব্য দুই পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখেই আওয়ামী লীগ ও ১৪ দল সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করছে। শরিকেরা তালিকা দিলেও সার্বিক বিচারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব জোটনেত্রী শেখ হাসিনার ওপরই অর্পণ করেছে।
নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি তার সহযোগীদের নিয়ে একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে এবং সে লক্ষ্যেই তাদের বর্তমান কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে বলে উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শরিকদের জোটবদ্ধভাবে তাদের মোকাবিলার জন্য বলা হয়। প্রতিটি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, পৌরসভা, বিশেষ করে নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক প্রতিরোধ কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেওয়া হয়। সতর্ক করা হয়, নির্বাচন ভণ্ডুল করার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নস্যাৎ বা বাধাগ্রস্ত করার পরিকল্পনা নিয়ে তারা অগ্রসর হচ্ছে। ঐক্যবদ্ধভাবে তা প্রতিরোধ করার তাগিদ দেওয়া হয়।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক কমিটি গঠন করা হবে। স্থানীয় সংসদ সদস্য, সাবেক এমপি, শরিক দলগুলোর সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদকদের সম্পৃক্ত করে এই কমিটি গঠিত হবে। ওয়ার্ড, ইউনিয়ন থেকে নিয়ে সকল পর্যায়ে শরিক দলগুলোর স্থানীয় কমিটির নেতারা পারস্পরিক সমন্বয় করে কাজ করবেন। বিরোধীদের তৎপরতা, বিশেষ করে বোমাবাজি, অগ্নিসংযোগ, জীবন-সম্পদ হানিকর সব ধরনের সন্ত্রাসী তৎপরতা মোকাবিলা করবেন তারা। প্রধানত এসব ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বোতভাবে সাহায্য করবেন রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীরা। বিএনপি দৃশ্যত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করলেও তারা সন্ত্রাসী, হিংসাত্মক কর্মসূচিতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে ক্ষমতাসীনরা অভিযোগ করছে। ইতিমধ্যেই তারা সে ধরনের তৎপরতা শুরু করেছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে।
বিএনপি তার কর্মসূচিতে এখনো সহযোগী, সমমনাদের ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করেনি। সরকারের দিক থেকে তৎপরতা চালানো হচ্ছে তাদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টির এবং বিরোধী জোটের শরিক কয়েকটি দলকে নির্বাচনমুখী করার। এ ব্যাপারে প্রকাশ্য, অপ্রকাশ্য কার্যক্রম এগিয়ে চলেছে এবং সময়মতোই তারা তাদের অবস্থান স্পষ্ট করবে বলে সরকারি মহল মনে করে।
বিরোধী ছোট ছোট দল এবং জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামি দলগুলোকে বিএনপি থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রক্রিয়া অনেকখানি এগিয়ে আছে। অনেক ক্ষেত্রে কেবল আনুষ্ঠানিক ঘোষণার অপেক্ষা। বিএনপি অবশ্য দৃঢ়ভাবেই মনে করে, কোনো শরিক দল যদি রাজপথ থেকে সরে দাঁড়ায়, এমনকি নিজ দলেরও কিছু নেতা, সাবেক এমপি নির্বাচনমুখী অবস্থান নিলেও বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। আন্দোলন অভীষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়ার মতো শক্তি বিএনপি যথেষ্ট পরিমাণেই অর্জন করেছে। তবে তারা সবাইকে সঙ্গে নিয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে চায়।
সরকারি জোটের সংসদে প্রতিনিধিত্ব রয়েছে এমন শরিক দলগুলোর কোনো কোনোটির আসন্ন নির্বাচনে আসনসংখ্যা বাড়ানোর জন্য বলেন। শীর্ষ নেতৃত্ব কর্তৃক যথাসময়ে তা যথাসম্ভব বিবেচনার কথা বলেন বলে জানা যায়। অন্যদিকে বিএনপির সঙ্গে সংঘাত এড়িয়ে জোটগত বা দলগতভাবে রাজপথের কর্মসূচি পালনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। আগামীতে বিরোধীদের কর্মসূচির বিপরীতে ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি পালনের কথা বলা হয়।