Thikana News
১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

বই ও বইপড়া : একটি নিরীক্ষাধর্মী বিশ্লেষণ

বই ও বইপড়া : একটি নিরীক্ষাধর্মী বিশ্লেষণ
শিক্ষার মাধ্যমে সম্ভব মানুষের চিন্তাভাবনা ও ব্যবহারকে প্রভাবিত করা। এটাই শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য। যেকোনো কিছু করার উদ্দেশ্য হচ্ছে জানা এবং সেই জানাকে নিজেদের চিন্তা ও কর্মকাণ্ডে সঞ্চালিত করা। এ কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের ঘুম ভাঙানো। অন্য কথায় চিন্তা ও কল্পনার উন্মেষ সাধন।’
তবে সত্যিকারের লেখাপড়া বাদ দিয়ে চাকরির গাইড পড়েছে, এতে পুরো লেখাপড়ার সিস্টেম কলুষিত হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে নিয়মিত ছাত্ররা লাইব্রেরিতে যেতে পারছে না। ফলে এরা বড় ভাইয়ের পড়ালেখার ফটোকপি পড়ার সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে, যা সভ্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে কল্পনাও করা যায় না। এই কলুষিত শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে আমরা কীভাবে আমাদের জাতিকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলব?
তা ছাড়া বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ষষ্ঠ সমাবর্তনে সভাপতির বক্তব্যে বলেছিলেন, সনদসর্বস্ব শিক্ষায় দেশের উন্নয়ন অসম্ভব। অন্যদিকে বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির আলোচনা সভায় শিক্ষা যাতে কোনোভাবেই সার্টিফিকেট-সর্বস্ব না হয়, তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি। কথা হলো খোদ রাষ্ট্রপতিই যদি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সন্তুষ্ট না হয়ে থাকেন, তবে সরকার কিংবা শিক্ষামন্ত্রী বারবার ঢেলে সাজিয়ে কোন ব্যবস্থা নির্মাণ করেছেন?
ব্রিটিশ শাসনামলে জ্ঞানচর্চার প্রতি আগ্রহ এখনকার তুলনায় অনেক বেশি ছিল। শিক্ষার্থীরা পাঠ্যপুস্তকের বাইরে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার ব্যবহার করেছে বিপুল উৎসাহে এবং নিজেদের জ্ঞানের পরিধিকে বিস্তৃত করেছে। জেলা ও মহকুমা শহরগুলোতে পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এসব লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগারে গল্প-উপন্যাস ছাড়াও জ্ঞানসম্ভারে সমৃদ্ধ অনেক গ্রন্থ থাকত। শহরের পাঠকেরা গ্রন্থাগারের নিরিবিলি পরিবেশে যার যার পছন্দমতো বই পড়ে কিছুটা সময় কাটিয়ে দিত। এর ফলে এসব পাঠক মননশীলতার দিক থেকে উন্নত মানুষে পরিণত হতো।
এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার লেখক হয়ে উঠতেন। যারা চাকরি করে তাদের নিয়ে সমাজে নেতিবাচক ধারণা বিদ্যমান। দিনে দিনে এ নেতিবাচক ধারণা আরও প্রকট হয়েছে। আমি যখন কলেজে পড়ি, তখন এক দারোগা সাহেবের সঙ্গে লঞ্চে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। যতক্ষণ আমি তার সান্নিধ্যে ছিলাম, ততক্ষণ তিনি দেশ-বিদেশের সাহিত্যিকদের নিয়ে গল্প করেছেন। তার কাছেই শুনলাম এমিল জেলির কথা, দস্তয়ভস্কির কথা, টলস্টয়ের কথা, বাংলা সাহিত্যের নামজাদা লেখকদের নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন।
একজন পুলিশ এ রকম সাহিত্যপ্রেমিক হতে পারেন, তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। আমি তখন কলেজপড়ুয়া। একদিন লঞ্চে যাচ্ছি। পুলিশের একজন অধস্তন কর্মকর্তার সঙ্গে সেখানে আমার পরিচয় ঘটে। কথা বলতে বলতে তিনি অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে গেলেন। সমাজ, শিল্প, রাজনীতি ও সাহিত্য নিয়ে তিনি তার জানা-পড়া বিষয় আমার সঙ্গে শেয়ার করলেন। ইংরেজি সাহিত্যে তার পাণ্ডিত্য দেখে আমি বিমোহিত ও বিস্মিত হই। তার নীতি-নৈতিকার ধারণা আমাকে প্রচণ্ডভাবে বিমুগ্ধ করে। বইপড়া ও তার ঔচিত্যবোধ আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। আমার ভাবনার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ভাবতে ভাবতে সিদ্ধান্তে এলাম, এ স্বর্ণালি ফসল তার বইপড়ার ফল। এভাবে ভাবতে ভালো লাগছে, আহা! আমাদের বাংলাদেশের সকল সরকারি-বেসরকারি-প্রাইভেট অঙ্গনের কর্মকর্তারা যদি এভাবে বই পড়তেন!
তবে পুলিশ বিভাগের উদ্যোগে এই বাহিনীর লোকদের মধ্যে পাঠাভ্যাস সম্পর্কে যদি একটি জরিপ চালানো হতো, তাহলে আমরা বুঝতে পারতাম পুলিশ কীভাবে জনগণের বন্ধু হয় এবং কেন হয় না। বই পড়ে মানুষের রুচি ও মননশীলতার উন্নয়ন হয়। আমাদের পুলিশ বাহিনীতে যে নেতিবাচক প্রবণতা লক্ষ করা যায়, তা হয়তো কিছুটা হলেও হ্রাস পেত। যদি এই বাহিনীর মধ্যে বইপড়ার অভ্যাস বাড়ানো সম্ভব হতো।
কোনো কাজে সাফল্য অর্জন করতে হলে মনোযোগসহকারে সেই কাজটি করা একান্ত প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে আমাদের বইপড়া যথেষ্ট সাহায্য করে। প্রতিদিন বই পড়লে মস্তিষ্কের কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পায়। ফলে উন্নতি ঘটে মনোযোগ-ক্ষমতার। তা ছাড়া সারা দিন কাজের পর ৬০-৭০ শতাংশ মানুষই মন-মেজাজ চাঙা করতে টেলিভিশন দেখেন। বিজ্ঞানের ভাষ্যমতে, মন ও মস্তিষ্কের ক্লান্তি দূর করতে টেলিভিশনের পরিবর্তে বইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা প্রয়োজন।
তবে বাংলা সাহিত্যচর্চার এক তীর্থক্ষেত্র বাংলাদেশের বাংলাবাজার। বইয়ের সঙ্গে জড়িত সব মানুষের কাছেই বাংলাবাজার অত্যন্ত পরিচিত একটি নাম। কিন্তু এর আসল নামটা হতে পারত বাংলা বইবাজার। বই ভালোবাসেন যারা পুরান ঢাকায় গিয়ে প্রথমেই জিজ্ঞেস করবেন বাংলাবাজারটা কোথায়?
বাংলাবাজারে প্রচুর বাজার আছে। এখনো ঢাকার পাইকারি বাজারের একটা বড় অংশই এখানে থেকে গেছে। গোটা বাংলাদেশের এই টেক্সট বুক গল্প, উপন্যাস এবং অন্যান্য বইপত্রের প্রোডাকশন ও ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টার এই বাংলাবাজার। সেই বাংলাবাজার রোড এবং তার চারপাশের গলিজুড়ে অজস্র বইয়ের দোকান। প্রতিবার একুশের বিখ্যাত বইমেলার আগে কিংবা ধরা যাক একাডেমিক ইয়ার শুরু হওয়ার সময় যখন টেক্সট বুকের সিজন চলে, তখন বাংলাবাজারে নম্বর দেওয়া বিভিন্ন গলিপথে হাঁটাই যায় না। দোকান ছাপিয়ে রাস্তার ওপরও স্তূপীকৃত বইপত্র। ছাপা, বাঁধাই, বিক্রি-বাট্টা সব মিলিয়ে সে এক আশ্চর্য বইয়ের দেশ।
তবে সুলতানি যুগে বাংলাবাজার প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন কিনা বাংলা শব্দটি প্রিয় হয়ে ওঠে। রোমান নাগরিক ১৫০৬ খ্রিষ্টাব্দে লিখে গিয়েছেন, বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সিল্ক ও সুতা তৈরি হতো বাংলানগরে। এর মাধ্যমেই বাংলার কেন্দ্রস্থল বাংলাবাজারের প্রাচীনতা সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়।
ব্রিটিশ আমলে বাংলাবাজার-সংলগ্ন স্থানগুলোতে আভিজাত্যের ছোঁয়া লাগে, তখন বহু ইংরেজ কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ী এর আশপাশেই বসবাস করতেন। ব্রিটিশ আমলে বাংলাবাজার এলাকায় টাকা-পয়সা ভাঙানো বা বদলানোর ব্যবসা শুরু হয়। এ সময় বাংলাবাজার খুব সমৃদ্ধশালী এলাকা হয়ে ওঠে। বর্তমানে বাংলাবাজার ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার একটি। বাংলাবাজার বাংলাদেশের বই বিক্রি, বই ছাপানো ও সরবরাহ করার সবচেয়ে বড় কেন্দ্র। বাংলাবাজার বাংলাদেশের মধ্যে বইয়ের বৃহত্তম মার্কেট। এখানে প্রায় দেড় হাজার থেকে দুই হাজার বইয়ের দোকান রয়েছে।
বই এবং পড়া নিয়ে পবিত্র কোরআন পাঠের প্রথম বাণী হচ্ছে, ‘পড়ো’, অর্থাৎ যা সত্য, তা পড়ো। মানবকল্যাণের জন্য পড়ো। জ্ঞানের দোয়ার খুলে যাবে। পাঠ করতে করতেই সত্যিকার আলোর সন্ধান পেয়ে যাবে। সঠিক আলোকপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে অন্ধকার থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
তা ছাড়া দার্শনিক হোরেসের একটি বিখ্যাত উক্তি মনে পড়েছে। তিনি বলেছেন, ‘বই যে কত আনন্দ দান করে তা অনেক শিক্ষিত লোকও জানে না।’
অথচ আমাদের সমাজে এমন লোক রয়েছেন, যারা বইপড়া নিয়ে অনেক উন্মাদনা প্রকাশ করেন। বইকে আবর্জনা মনে করেন। অনেক মূল্যবান বই ফেলে দেন। আবার অনেকেই জীবনের অমূল্য সম্পদ মনে করেন। বইকে জীবনের সঙ্গী মনে করেন।
বইপড়ার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বিখ্যাত সাহিত্যিক নোমান মেলর বলেন, ‘আমি চাই বই পাঠ্যরত অবস্থায় যেন আমার মৃত্যু হয়।’
তাই আমাদের ছাপা বইয়ের ইতিহাস বা ইতিকথা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। ছাপা বইয়ের ইতিকথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় ছাপা মেশিনের কথা। ১৪৪৫ সালে জার্মানিতে জোহানেস গুটেনবার্গ আধুনিক ধরনের প্রিন্টিং মেশিন বা ছাপা মেশিন তৈরি করেন। পর্তুগিজরা প্রথমে সেই যন্ত্র ভারতবর্ষে নিয়ে আসে। সেটা ১৫৫৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। ভারতের পশ্চিম উপকূলের গোয়ায় বসানো হয়েছিল কাঠের তৈরি ছাপার যন্ত্র। শোনা যায়, সেই বছরে নাকি খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের জন্য ‘ঈড়সঢ়বহফরড় ঝঢ়রৎরঃঁধষ উধ ঈযৎরংঃধ’ ছাপা হয়েছিল। তবে সে বই আজ আর ভারতে নেই, আছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের পাবলিক লাইব্রেরিতে।
বাংলা ভাষায় প্রথম যে বইটি ছাপা হয়, সেই বইটির নাম কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ। সেটাও খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের জন্য। ভাষা বাংলা হলেও রোমান হরফে লেখা। একজন অনুবাদ লেখকের মাধ্যমে পর্তুগিজ লেখক ম্যানোয়েল দা আসসু মসাঁও এই বইটি লেখেন। বইটি প্রকাশিত হয় ১৭৪৩ সালে পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে।
এরপর ১৭৭৮ সালে কোনো এক এন্ড্রোজ সাহেব একটি ছাপাখানা খোলেন পশ্চিম বাংলার হুগলিতে। অর্থাৎ পশ্চিম উপকূলের গোয়া থেকে পূর্ব ভারতের বাংলায় ছাপাখানা আসতে সময় লাগে পাক্কা ২২২ বছর। সেই হুগলি প্রেস থেকে ছাপা হয় ন্যাথানিয়েন্ডন ব্রাসি হ্যালহ্যাদের লেখা ইংরেজি বই ‘আ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’। সেই বই বাঙালিদের জন্য নয়, ইংরেজদের বাংলা শেখার জন্য। তবে সে বইয়ের কিছু বাংলা অক্ষর বসাতে হয়েছিল। এ কাজে উইলকিন্স সাহেবকে বাংলা অক্ষর তৈরিতে সাহায্য করেছিলেন পঞ্চানন কর্মকার।
১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারি আইরিশ জেমস অগাস্টাস হিকি কলকাতায় শুরু করলেন ‘হিকিস বেঙ্গলি গেজেট’। ১৮০০ সালের ১০ জানুয়ারি গড়ে উঠল শ্রীরামপুর ব্যাপ্টিস্ট মিশন, যেখানে ছাপাখানাও তৈরি হলো। ১৮১৮ এর ২৩ মে শ্রীরামপুরের মিশনারি বই প্রকাশ করল বাংলার প্রথম সংবাদপত্র ‘সমাচার দর্পণ’। পরবর্তীকালে বই প্রকাশনায় আসে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। তারা তুলনামূলক সস্তা দামে সাধারণ মানুষের জন্য বই ছাড়া শুরু করে। বাবুরাম নামের একজন বাঙালি কলকাতায় প্রথম প্রেস স্থাপন করেন। তবে বাংলা বই প্রকাশের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন গঙ্গা কিশোর ভট্টাচার্য। তা ছাড়া প্রথম বাংলা সচিত্র গ্রন্থ ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল তিনি প্রকাশ করেন। সেটা ১৮১৬ সালে কলকাতার ফেরিস কোম্পানির প্রেস থেকে।
সেই সময় কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়ীর বিশ্বনাথ দেব নামের একজন ব্যবসায় নামেন। তিনি সাধারণ মানুষের চাহিদা অনুযায়ী পুঁথি, পাঁচালি, পঞ্জিকা, পুরান লোককাহিনি ইত্যাদিসহ ঘরোয়া কেচ্ছাকাহিনি নিয়ে সস্তা বই প্রকাশ শুরু করেন। তার পথ অনুসরণ করে আরও অনেকেই এগিয়ে আসেন। পরে কলেজ স্ট্রিটে প্রথম বইয়ের দোকান খোলেন গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়। নাম বেঙ্গল মেডিকেল লাইব্রেরি। তারপর ১৮৪৭ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এলেন বই ব্যবসায়। তিনি ৬০০ টাকা দিয়ে আর্মহার্র্স্ট স্ট্রিটে একটি কাঠের প্রেস কিনে আরপুলি লেনে একটা বইয়ের দোকান খুললেন। তিনি নিজের প্রেসে ছাপানো বইয়ের সঙ্গে অন্য প্রেসে ছাপা বইও বিক্রি করতেন। বই বিক্রি হলে কমিশন কেটে রেখে লেখক প্রকাশককে টাকা দেওয়ার নিয়মও তিনি চালু করেন।
কলকাতার মতো ঢাকাতেও বই ব্যবসা শুরু হয় বিদেশিদের হাত ধরে। আলেকজান্ডার ফারবেক নামের এক ব্যাপটিস্ট মিশনারি ১৮৪৭ সালে পুরান ঢাকার ছোট কাটরায় একটি ছোট ছাপাখানা বসান। নাম ঢাকা প্রেস। সে প্রেস থেকেই বের হয় ঢাকার প্রথম সংবাদপত্র ‘ঢাকা নিউজ’। তবে ঢাকায় বই ছাপার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটে ১৮৬০ সালে। ব্রজসুন্দর মিত্র ও ভগবান চন্দ্র বসু নামের দুজন বাঙালি একটি ছাপাখানা বসান এবং সেখান থেকে ছাপা হয় দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটক। নীলদর্পণ নাটক হলো বাংলা ভাষার প্রথম নাটক, যা ইংরেজি ভাষায় অনূদিত। এর ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং প্রকাশিত হয় পাদ্রি রেভারেন্ড জেমসলং-এর নামে। সেই অপরাধে জেমসলংকে হাজতবাস করতে হয়। তবে জেমসলং সাহেব মাইকেল মধুসূদন দত্তকে দিয়ে নীলদর্পণ নাটক অনুবাদ করিয়েছিলেন ঠিক, তবে তিনি দুঃখ করে লিখেছিলেন, কলকাতায় কোনো বইয়ের দোকান নেই, আছে শুধু ফেরিওয়ালা। তারা মাথায় ঝাঁকা নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় বই ফেরি করে বেড়ায়। সেই সময় ফেরি করে বই বিক্রির রেওয়াজ শুধু বাংলায় চালু ছিল, তা নয়। খোদ ইউরোপেও ফেরি করে বই বিক্রি হতো।
এরপর অল্প সময়ের মধ্যেই ঢাকায় আরও অনেকগুলো প্রেস বসে। সেসব প্রেস থেকে পুঁথি, পুস্তক, কিচ্ছাকাহিনি প্রকাশিত হতে শুরু করে। এসব প্রকাশনাকে কেন্দ্র করে চকবাজার ও কাছাকাছি এলাকায় গড়ে ওঠে মুক্ত প্রেস পুঁথি পট্টি। সেই সময় থেকে প্রায় ১৯০০ সাল পর্যন্ত কলকাতার বটতলা সাহিত্যের মতো নানান রকম বইপত্র ছাপা হতে থাকে ঢাকায় এবং সেসব বই বিক্রি হতো বাংলাবাজারে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ, এরপর ১৯২১-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর গোটা পূর্ব বাংলা নতুন করে জেগে ওঠে। সেই জাগরণের ঢেউ বাংলাবাজারেও লাগে। তবে ১৯৪৭ এর দেশভাগ বাংলাবাজারকে নতুন করে গড়ে তোলে। আগে ঢাকার ব্যবসায়ীরা কলকাতা থেকে বই এনে বিক্রি করতেন। দেশভাগের পর কলকাতা থেকে এপারে এসে দোকান খোলে মল্লিক ব্রাদার্স, ইসলামিয়া লাইব্রেরির মতো অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান।
উনিশ শতকে একটি বইয়ের মলাট বাঁধাই করা হয়েছিল মানুষের চামড়া দিয়ে। ১৯৩০-এর দশক থেকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হাফটন লাইব্রেরিতে রয়েছে ‘দে দেসতিনে দো লাসো (ডেসটিনিজ অব দ্য সোল)’ শীর্ষক বইটি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই গ্রন্থাগারের ৯০ বছরেরও বেশি সময় ধরে রাখা ছিল বইটি। ইদানীং বই থেকে মানব চামড়ার মলাট সরিয়ে নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
১৮৮০ এর দশকে আর্সিন হসে আত্মা ও মৃত্যু-পরবর্তী জীবন নিয়ে মেডিটেশন-বিষয়ক বই, ‘দে দেসতিনে দো লাসো’ লিখেছিলেন। তিনি বইটি তার ডাক্তার বন্ধু লুডোভিক বোল্যান্ডকে দিয়েছিলেন বলে কথিত আছে। তিনি মানুষের চামড়া দিয়ে বইটি বাঁধাই করেছিলেন। প্রাকৃতিক কারণে মারা যাওয়া এক নারী রোগীর শরীরে চামড়া দিয়ে বইটি বাঁধাই করেছিলেন। ওই নারীর লাশের কেউ দাবিদার ছিল না।
১৯৩৪ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আনা হয় ‘দে দেসতিনে দো লাসো’। তখন এই বইয়ের সঙ্গে ছিল চিকিৎসক বোল্যান্ডের একটি চিরকুট। সেখানে লেখা ছিল, ‘মানব আত্মা নিয়ে লেখা একটি বইয়ে মানব মলাট থাকাটাই উপযুক্ত।’ বই থেকে খুলে নেওয়া মানব দেহাবশেষটির সম্মানজনক ব্যবস্থা করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া অজ্ঞাত ওই নারীর জীবন নিয়েও গবেষণা করেছে হাফটন লাইব্রেরি।
বোল্যান্ড তার এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ষোড়শ শতাব্দী থেকে ‘এনথ্রোপ্রোডার্মিক’ শব্দটি প্রচলিত, যার অর্থ হচ্ছে মানুষের চামড়া দিয়ে বইয়ের মলাট করা। ওই শতকে এর প্রচলন ছিল। তখন কেউ অপরাধ করলে তার চামড়ায় তা লিখে দেওয়া হতো। অনেক সময় কেউ কেউ মরে যাওয়ার পর তার চামড়া দিয়ে বইয়ের মলাট বানিয়ে তাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের অনুরোধ করে যেতেন। সম্প্রতি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা দিয়েছে, বইয়ের উৎপত্তি ও পরবর্তী ইতিহাসের নৈতিকভাবে বিতর্কিত প্রকৃতির কারণে তারা ওই মলাট খুলে নিয়েছে। (ক্রমশ)

কমেন্ট বক্স