মানুষ যা ভাবছিল, অবশেষে তা-ই হলো। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার সৃষ্ট গণ-অভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণের পর তার পরিবারের অন্যান্য সদস্য সম্পর্কে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। সে অভিযোগ শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার কন্যা টিউলিপ সিদ্দিক পর্যন্ত পৌঁছে যায়। শেখ হাসিনার দুর্নীতির বড় একটা অভিযোগে টিউলিপ সিদ্দিক অভিযুক্ত হন। টিউলিপ সিদ্দিক নিজেও একজন প্রভাবশালী নারী। ব্রিটিশ মন্ত্রিপরিষদের সদস্য। এত দিন তাকে নিয়ে বাংলাদেশিরা অহংকার এবং গর্ববোধই করতেন। করারই কথা। একে তো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি, তার ওপর একসময়ের প্রভু ব্রিটিশ রাজ্যের মন্ত্রী। এ নিয়ে সাধারণ বাংলাদেশি কেন, স্বয়ং তার খালা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও গর্বের সঙ্গে বলতেন, টিউলিপের মতো মেয়ে সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য তো বটেই, পাশ্চাত্যেও বিরল। তারা লেখাপড়া শিখে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছে নানা অঙ্গনে তাদের নিজেদের অর্জিত সাফল্য দিয়ে। তারা অনেকের মতো ‘এতিমের ধন চুরি করে না’।
একেই বুঝি বলে ভাগ্যের খেলা, নির্মম পরিহাস। সেই নদীর খেলার মতো : নদীর এ-কূল ভাঙে তো ও-কূল গড়ে। প্রথমে টিউলিপ তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করলেও অনেকেই, বিশেষ করে মিডিয়া থেকে তার পদত্যাগের কথা ওঠে। পদত্যাগের পূর্ববর্তী সময়টা ছিল মহাসংকটের। শেষ পর্যন্ত টিউলিপ তার মন্ত্রিত্ব এবং পার্লামেন্টের সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করেন। অনেকেই বলেন, টিউলিপ পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। তবে টিউলিপ তার পদত্যাগের কারণ ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, ‘তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে পদত্যাগ করেছেন। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলে তদন্তকারীরা প্রভাবিত হলেও হতে পারেন।
শেষ পর্যন্ত টিউলিপ সিদ্দিকের পদত্যাগের খবর বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। বাইরের এবং দলীয় চাপ তাকে পদত্যাগে বাধ্য করেছে কী না, কে জানে। তবে টিউলিপের ব্যাখ্যা হচ্ছে সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তিনি পদত্যাগ করেছেন।
লন্ডনে একাধিক ফ্ল্যাট বিনা মূল্যে নেওয়ার খবর রটে যায় বিভিন্ন মিডিয়ায়। বলা হয়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা টিউলিপকে এগুলো উপহার হিসেবে দিয়েছেন। খবরটি এমন সময় প্রকাশ পায়, যখন বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ৯ প্রকল্পে ৮০ হাজার কোটি টাকার অনিয়মের অভিযোগে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, টিউলিপ ও সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে তদন্ত পরিচালনা করছে। এমন তথ্যও প্রকাশ পায়, শেখ হাসিনা, তার পরিবার, আত্মীয়স্বজন এবং দলীয় নেতাকর্মীদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা ব্যবসায়ী চক্র আওয়ামী লীগের গত টার্মের টানা শাসনকালে বাংলাদেশকে শোষণ করে রক্তশূন্য করে তুলেছে। শুধু ব্যবসায়ী গোষ্ঠী নয়; অনেক ডিসি, এসপি, আমলারাও এই পথ ধরে দুর্নীতি করেছেন।
এখন শেখ হাসিনার সব আমলনামাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) হাতে। কেউ কি কখনো ভেবেছিল, বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনাকে এমন দুঃসময়ের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে এলে কেউই হয়তো তা ভাবতে পারেনি। কিন্তু ভাবতে হয়। যারা দূরদর্শী, তারা ভাবেন। লুক বিফোর ইউ শিপ-এ কথা আমরা জেনেও ক্ষমতার দম্ভে ভুলে যাই। ক্ষমতার দম্ভ কি এমনই? সৎ কর্ম, সৎ চিন্তা, ভবিষ্যৎ পরিণতি সব ভুলিয়ে দেয়। ভুলিয়ে দেয় কবির সেই অমর বাণী : ‘আসিতেছে শুভ দিন/ দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা/ শুধিতে হইবে ঋণ। পাপের ঘড়া পূর্ণ হলেই নেমে আসে মহাবিপদ, মহাসংকট।’
সেই সংকট থেকে কারও মুক্তি মেলে না। কেঁদে বুক ভাসালেও না, মাথা কুটে মরলেও না। সাধারণ মানুষ যারা, তাদের প্রশ্ন, অর্থ ও ধন-সম্পদ কি মানুষের পদমর্যাদা, মানসম্মান ক্ষুণ্ন বা দেশের ভাবমূর্তির চেয়েও বড়। সচ্ছল জীবনযাপনের জন্য অর্থ জরুরি অবশ্যই। তাই বলে কি সে অর্থ নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে যেকোনো পন্থায় বা গরিবের ধন লুটে নিয়ে হলেও। একজন মানুষের হাজার হাজার লক্ষ কোটি টাকা অসৎ পথে, লক্ষ লক্ষ মানুষকে পথে বসিয়ে শেষ বিকেলে পালিয়ে থাকার চেয়ে কি মানসম্মান নিয়ে সৎপথে অর্জিত অর্থে জীবনযাপন অনেক বেশি শান্তির নয়? এর উত্তর কেবল তাদের কাছেই আছে, যারা এখন বাংলাদেশকে রক্তশূন্য করে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
তবে এ কামনা আমরা সবাই করি, টিউলিপ সিদ্দিক যে সৎ সাহস নিয়ে তদন্তের স্বার্থে পদত্যাগ করেছেন, তার সেই সততাই যেন শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা পায়। তিনি সম্মানে আবার ব্রিটিশ রাজনীতিতে ফিরে আসুক এবং আরও প্রবলভাবে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ফিরে তিনি তার স্থান আরও নতুন মাত্রায় নিয়ে যান।