Thikana News
১১ জানুয়ারী ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৫

দক্ষিণা  মলয়

দক্ষিণা  মলয়
সন্ধ্যা নামতেই গ্রামের রাত শুরু হয়। গ্রামের সবাই সাজবাতি জ্বেলে রাতের খাবার সেরে ঘুমের প্রস্তুতি নেয়। আজ সারা গ্রামের চিত্র অন্য রকম। চৌধুরী সাহেবের মেয়ের বিয়ে। ধনী ব্যবসায়ী তদুপরি সংসদ সদস্যের মেয়ের বিয়ে বলে কথা। ভোটারদের খুশি করতে গ্রামের বাড়িতে বিয়ের আয়োজন করেছেন। গ্রামের সবাই নিমন্ত্রিত। শহরের গণ্যমান্য অতিথিরাও আসবে। মাসজুড়ে সাজ সাজ কাজকর্ম চলছে। বাড়ির পাশের মাটির রাস্তাও মেরামত হচ্ছে। বরযাত্রীর গাড়ি আসবে। গ্রামে কারেন্ট নেই বিধায় জেনারেটর দিয়ে আলোর ব্যবস্থা হয়েছে। প্রচণ্ড শীত উপেক্ষা করে গ্রামের প্রায় সবাই জেগে বিয়েবাড়ির আনন্দে শামিল হয়েছে। অসুস্থ আজিমউদ্দিনও নিমন্ত্রিত ছিল। কিন্তু হাঁপানির শ্বাসকষ্টটা বেড়েছে, তাই রাতের কুয়াশায় বের হয় না। ঘরের জানালায় বসে বিয়েবাড়ির লোকজনের আনাগোনা দেখছে। গিন্নি তাগাদা করে দিয়ে বিছানায় পাঠায়। বিছানায় শুয়ে হারিকেনের আলোটা কমিয়ে দেয়। স্বল্প আলোতে ঘরের ওপাশের বিছানায় শোয়া মেয়ে পুতুলের দিকে চোখ পড়ে। পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। মেয়েটাকে দেখে মনটা খারাপ হয়ে যায়। ওর বয়সী চৌধুরী সাহেবের কালো মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। ছোটবেলায় পুতুলের মতো সুন্দর ছিল। তাই ওর মা ওর নাম রাখে পুতুল। বয়সের সঙ্গে উজ্জ্বল রঙের দ্যুতি ছড়াচ্ছে। আজিমউদ্দিনের যত চিন্তা এই মেয়েটাকে নিয়ে। ওর কত শখ ছিল ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়বে। এইচএসসিতে ভালো রেজাল্ট করার পরও ভার্সিটিতে ভর্তি করতে পারেনি। রিটায়ারমেন্টের পর গ্রামে চলে আসতে হয়েছে। হলে রেখে পড়ানোর সাধ্য নেই। দু-চার জায়গা থেকে বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। ওদের কথা শুনে মনে হয়েছে, বিয়ে করতে আসেনি, সওদা করতে এসেছে। আমাদের সমাজে মেয়ে সস্তা পণ্য। ছেলের দাম ক্রমেই ঊর্ধ্বগতিতে বেড়ে চলেছে। একটু ভালো চাকরির অবস্থাপন্ন ছেলের যৌতুক চাওয়ার বহর দেখে গরিব মেয়ের বাবার আশাহত হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। আজিমউদ্দিনের বিয়ের আট বছর পর, অনেক চিকিৎসা, মানতের পর পুতুলের জন্ম হয়। কত আদরের মেয়ে পুতুল, ওকে নিয়ে কত স্বপ্ন। আজিমের সংসারে প্রাচুর্য নেই; কিন্তু সুখ আছে। এখন পুতুলের পাত্রস্থ করা নিয়ে যত ভাবনা। পেনশনের টাকা দিয়ে একটা ঘর ঠিক করিয়েছে, বাকি যত সামান্য টাকা মেয়ের বিয়ের জন্য রেখেছে। তাতে যৌতুক হবে না। তদুপরি সুদর্শন মেয়েটার প্রতি চেয়ারম্যানের ছেলের দৃষ্টি পড়েছে। নানাজনকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। আজিম রাজি হয়নি। চেয়ারম্যানের তাঁবেদার মন্টু মোল্লা তো মুখের ওপর শাসিয়ে গেল-দেখব তোমার মেয়েকে কোন রাজপুত্রের সঙ্গে বিয়ে দাও। চেয়ারম্যানের এত পয়সা, ছেলেটা কিসে কম, রংটা একটু ময়লা, একটু মোটা-এই যা। খাইয়ে ঘরের ছেলে ওমন একটু মোটা তো হবেই।
আজিম বিরক্ত হয়ে বলে, বিদ্যার দৌড় তো ওই প্রাইমারি স্কুল পর্যন্ত।
মন্টু মিয়া কথাটা হেসে উড়িয়ে দেয়-তুমি তো বিএ পাস করে চাকরি করে কী করতে পারছ। বাপ-দাদার যা ছিল তাই ভাঙাইয়া খাইতাছ। আর চেয়ারম্যানের সম্পত্তি সমানে বাড়তাছে। ছেলেটা মোটরসাইকেল চড়ে ঘুরে বেড়ায়। শুনলাম, চেয়ারম্যান মোটরগাড়ি কিনবে। আজিমউদ্দিন বেশি কথা বলতে চায় না, একটু নরম স্বরে বলে-চাচা মিয়া, আপনি বয়স্ক মানুষ, আমার বাপ-দাদার বংশপরিচয় তো আপনার অজানা না।
মন্টু মোল্লা এবার একটু খেপে যায়-রাখো তোমার বংশ, আজকাল টাকার কাছে বংশটংশ কিছুই লাগে না। উনি চাইলে তোমার মেয়েকে তোমার সামনে তুলেই নিয়ে যাইতে পারে। আজিম কথা বাড়ানোর সাহস করে না, মনের মধ্যে একটা শঙ্কা, ভয় দানা বাঁধে।
দূরদূরান্ত থেকে সব আত্মীয়স্বজন এসে চৌধুরীবাড়ি হাসি-আনন্দে সরগরম, সকাল থেকে সানাই বাজছে। বাঁধভাঙা আনন্দের জোয়ারে ভাসছে গ্রামবাসী সবাই। বড় বড় ডেকচিতে সুস্বাদু খাবারের সুবাস ছড়াচ্ছে। ফুলে ফুলে সাজানো মোটরগাড়ি করে বর আসে। বরযাত্রীদের বরণের জন্য সারিবদ্ধ কন্যাকুমারীদের মধ্যে হুল্লোর ওঠে। চৌধুরী সাহেব বাবুর্চি খানসামাদের টেবিল সাজাতে বলে। বরযাত্রীদের বলে, আপনাদের আসতে একটু দেরি হয়ে গেছে। শীতের রাত, খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, অতিথিরা অপেক্ষা করছে। আপনারা খেয়ে নিন। তারপর বিয়ের কাজ সারা যাবে।
বরযাত্রীদের খাওয়া শেষ হলো। কনের বাবা চৌধুরী সাহেব বরের বাবা ও অন্য মুরব্বিদের নিয়ে বিয়ে পড়ানোর বাদানুবাদ শুরু করেন। কাজি সাহেব বিয়ের নিয়ম অনুযায়ী নাম-ঠিকানা লিখে কাবিন কত লিখব জিজ্ঞাসা করতেই চৌধুরী সাহেব বলেন-আমার সম্মান অনুযায়ী হবে।
আমার মেয়ের কাবিন ১০ লাখ টাকা হবে।
বরের বাবা চমকে উঠে বলেন-কী বলেন। আমার ছেলের আয় কত? সবে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে নতুন চাকরিতে ঢুকেছে। রিজনেবল একটা অ্যামাউন্ট বলেন।
চৌধুরী সাহেবের ওই এক কথা। আমার মেয়ের বিয়ে ১০ লাখ টাকার এক পয়সা কম হবে না। আমি অ্যায়রা-গ্যাইরাদের মতো লাম-সাম কাবিনে বিয়ে দিতে পারি না। ঘটক মাজিদকে ডাকেন, আমি ওকে আগেই বলে দিয়েছি, ১০ লাখ টাকা কাবিন দিতে হবে।
চৌধুরী সাহেব নিজেই উচ্চস্বরে ডাকেন-মজিদ, মজিদ-মজিদ গিয়েছিল গঞ্জের বাজারে বিয়ে পড়ানোর খোরমা আনতে। ঠিক সেই সময় সাইকেল নিয়ে বিয়েবাড়ি ঢুকেছে সে। চৌধুরী সাহেবের ডাক শুনে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। কী হয়েছে স্যার? চৌধুরী রাগে গড়গড় করছেন। চৌধুরী সাহেব রেগে গেলে কী বলতে কী বলে ফেলেন তার ঠিক নেই-কী হয়েছে? এখানে আয় বেটা, মুখ ফসকে একটা বেফাঁস কথা বলে-কী সব ছোটলোকের সঙ্গে আমার মেয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এসেছিস।
ছেলের বাবা এতক্ষণ ধৈর্য ধরে বসে ছিলেন। এবার তিনি মুখ খুললেন-আমি ছেলে বিয়ে করাতে এসে অপমান হতে আসিনি। আমিও দেখিয়ে দেব, আজ রাতেই এ গ্রাম থেকে ছেলেকে বিয়ে করিয়ে নিয়ে যাব, বর সেজে এসেছে আমার ছেলে, ওকে বউ ছাড়া একা ফিরিয়ে নিয়ে যাব না।
মুখের ওপর কথা শুনে চৌধুরী সাহেব তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন। যান পারলে করান, আমার মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হবে না।
মজিদ মিনমিন করে কিছু বলতে চেয়েছিল। চৌধুরী সাহেব উঁচু স্বরে ধমকে ওঠেনÑতুই আমার চোখের সামনে থেকে যা। মজিদ সাইকেল ঠেলে গেটের বাইরে এসে দাঁড়ায়। বরের বাবা ছেলের হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে এসে বলেন, গাড়িতে ওঠ। তখনো চৌধুরী সাহেবের হুংকার শোনা যাচ্ছেÑসানাই বন্ধ কর। স্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, ওদের কাপড়চোপড়, গয়না খুলে ওদের দিয়ে দাও। আমার মেয়ের পাত্রের অভাব হবে না। মেয়ের গা থেকে গয়না, কাপড় খুলতে গিয়ে মায়ের দু’চোখ কান্নায় ছলছল করে; কিন্তু স্বামীর রাগের সামনে মুখ খুলতে সাহস করেন না। স্বামীর কথা অনুযায়ী কাজ করে স্যুটকেসটা কাজের ছেলের হাতে দেন। এটা গাড়িতে তুলে দাও। মজিদ এগিয়ে এসে বরের বাবাকে বিনয়ের সঙ্গে বলে, আমি খুবই দুঃখিত-এটা কী হয়ে গেল!
বরের বাবা মজিদকে ভদ্রভাবে বলেন, আপনার দুঃখের কিছু নেই। আপনি আমার একটা উপকার করতে পারেন, এ গ্রামে আমার এক কলিগের বাড়ি, আপনি তার বাড়িটা চেনেন, নাম আজিমউদ্দিন, দুই মাস আগে রিটায়ার্ড হয়ে গ্রামে চলে এসেছেন। ওনার একটা মেয়ে আছে, তার বাড়ি আমায় নিয়ে চলেন। মজিদ ছোট্ট একটা উত্তর দেয়-চিনি। বলেই সাইকেলে উঠে গাড়ির আগে আগে চলতে থাকে। মুহূর্তেই চৌধুরী বাড়ির আনন্দ থেমে গেল। গ্রামের কিছু লোক তামাশা দেখার জন্য বরের গাড়ির পিছু নেয়। আজিমউদ্দিনের বাড়ির উঠানে অনেকে জড়ো হয়। লোকের শোরগোলে পুতুলের ঘুম ভেঙে যায়। জানালার ফাঁক দিয়ে লোকের ভিড় দেখে ভয় পেয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বাবার কপালে হাত রেখে ডাকে, বাবা হাঁপানির ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছিল। মেয়ের হাতের স্পর্শে ধড়ফড় করে উঠে বসে। কী, কী হয়েছে?
-বাবা আমাদের উঠানে এত লোক কেন জড়ো হয়েছে?
আজিমউদ্দিনের মন্টু মোল্লার কথা মনে পড়ে। গায়ের লোক চৌধুরী সাহেবের মেয়ের বিয়েতে ব্যস্ত, এই সুযোগে চেয়ারম্যানের ছেলে... আর ভাবতে পারে না। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলে-মা, মারে, ভয় পাইস না, তোরে আমি আমার বুকের পাঁজরের মধ্যে লুকিয়ে রাখব।
ততক্ষণে আজিমের দরজায় আঘাত পড়ছেÑচাচা, চাচা, একটু দরজা খোলেন। আমি মজিদ, আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে।
মলিনা উঠে দরজায় কান পেতে বলেÑকে, কে?
Ñআমি মজিদ, চাচার সঙ্গে একটু কথা আছে, দরজাটা একটু খোলেন।
মজিদকে সবাই ভালো লোক বলে জানে। মলিনা তবু দরজা খুলতে সাহস করে না। বলেÑবাবা, তোমার সঙ্গে এত লোকজন কেন? কী কথা বলো, তোমার চাচার শরীর ভালো না। মজিদ অভয় দেয়Ñভয়ের কিছু নেই। আমি চাচার সঙ্গে একটু কথা বলব। মলিনা দরজা খুলে দেয়, মজিদ ঘরে ঢোকে। আজিমউদ্দিন তখনো মেয়েকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ছিল। মজিদ ওদের ভয়টা আঁচ করতে পেরে বলে, তোমার কোনো ভয় নেই, তুমি ওই চৌকিটাতে গিয়ে বসো, আমি চাচার সঙ্গে একটু কথা বলব। মজিদ আজিমউদ্দিনকে সব ঘটনা সবিস্তারে বলে বরের বাবা হাসান সাহেবকে ডেকে নিয়ে আসে। আজিমউদ্দিন ওর মেয়ের জন্য এমন উপযুক্ত পাত্রের প্রস্তাবে আনন্দে কেঁদে ফেলে। এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। কাজি সাহেবও ওদের সঙ্গ নিয়েছিল। একটু তড়িঘড়ি করেই পুতুলকে বউ সাজিয়ে বিয়েটা সেরে ফেলে। মজিদ সাইকেলের হ্যান্ডেল থেকে খোরমার প্যাকেট নিয়ে বাইরে সমবেত লোকদের খোরমা দিতে থাকে। আজিমউদ্দিন ব্যস্ততার সঙ্গে মেয়ের বিদায়ের আয়োজন করতে থাকে। মেয়েকে জামাই-শ্বশুরের হাতে সঁপে দেয়। আজিমউদ্দিন আবেগে কথা বলতে পারে না, দু’হাতে হাতগুলো ধরে কাঁদতে থাকে। হাসান সাহেব পরিস্থিতিটা হালকা করার জন্য বলেনÑআজিম, তোমার মনে আছে আমাদের ব্যাংকে সেই পিকনিকের কথা, ছোট্ট পুতুল কাঠি লঞ্জেন্স খাচ্ছিল, কোথা থেকে রাসেল ছুটে এসে টুক করে ওর লঞ্জেন্সটা ছিনিয়ে নিয়ে দৌড়ে পালাল। আমি ওর পিছু পিছু ছুটে আসি। পুতুল কান্না জুড়ে দিয়েছে। আমি পুতুলকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলাম, আমি ওকে ধরে নিয়ে আসছি। তুমি কেঁদো না। ছোট্ট পুতুল আমার কথা বিশ্বাস করেছিল। তাই কান্না থামিয়ে আমার দিকে বোকার মতো তাকিয়ে ছিল। আমি আমার কথা রেখেছি। আজ ওকে ধরে এনে আমি তোমার আর তোমার বাবার হাতে মুষ্টিবন্দী করে দিয়েছি। তবে ধরে আনতে বেশ কয়েক বছর লেগেছে, এই যা। এবার তুমি তোমার কাঠি লঞ্জেন্স আদায় করে নিয়ো। আজিমউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বলেনÑবেয়াই সাহেব, আমার ছেলে কিন্তু তেমনি দস্যি আছে, দেখলেন এবার আর লঞ্জেন্স নয়, লঞ্জেন্স যে খাচ্ছিল তাকেই কেমন হুট করে নিয়ে চলল। অশ্রুসজল চোখে আজিমউদ্দিন হেসে বলে, ঠিকই বলেছেন। আনন্দাবেগে হাসানকে বুকে জড়িয়ে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয় ওরা দুজন। পুতুল চলে গেল জীবনের খেলাঘরে। মেয়েটা চলে গেলে আজিমউদ্দিনের বুকটা খালি খালি লাগলেও বুকের ওপর থেকে একটা পাষাণভার সরে গেল। শেষ রাতের একরাশ দমকা দক্ষিণা মলয় উড়িয়ে নিয়ে গেল আজিমউদ্দিনের বুকের সব ভয়, সব সংশয়।
 

কমেন্ট বক্স