গত কয়দিন ধরে গ্রীষ্মের চরম গরম সবাইকে একদম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দিয়েছে। প্রচণ্ড গরমে অস্থির হয়ে পড়েছিল চারদিক। সেই সঙ্গে ছিল উচ্চমাত্রার আর্দ্রতা। ফলে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। দেখা দিয়েছিল স্বাস্থ্য সমস্যা ও রোগব্যাধি। বিশেষ করে বিভিন্ন স্থানে শিশু ও বয়স্করা বেশী অসুস্থ হয়ে পড়েন।
এদিকে তীব্র গরমের পর ১ আগস্ট মঙ্গলবার থেকে নিউইয়র্কের তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে। অর্থাৎ গরমের তেজ কমতে শুরু করেছে। চলতি সপ্তাহে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকতে পারে ৮১ ডিগ্রি ফারেনহাইট। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা হতে পারে ৬৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিস (এনডব্লিউএস) বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে প্রায় ৮০ মিলিয়ন আমেরিকান এই সপ্তাহান্তে ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রার মুখোমুখি হয়েছে এবং এই সপ্তাহের শেষ দিকে তাপমাত্রা আরো বৃদ্ধি পাবে। ফিনিক্স ও অ্যারিজোনায় তাপমাত্রা ১১৪ ডিগ্রি ফারেনহাইটে পৌঁছাবে বলে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। গত তিন সপ্তাহ যাবত এখানে তাপমাত্রা ১০৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়েছে।
১৭ জুলাই বৃহস্পতিবার শহরে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে একটি প্রোপেন (বোতলজাত হাইড্রোকার্বন গ্যাস) ব্যবসা কেন্দ্রে একটি ভয়ঙ্কর অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এতে গ্যাস ট্যাঙ্কগুলো বাতাসে বিষ্ফোরিত হয়ে নারকীয় পরিস্থিতি তৈরি করে।
ফায়ার ক্যাপ্টেন রব ম্যাকডেড কেপিএইচও টেলিভিশন স্টেশনকে বলেছেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত, এইরকম গরমের দিনে, এই প্রোপেন ট্যাঙ্কগুলো তাপের প্রসারণে আক্ষরিক অর্থে ক্ষেপণাস্ত্রে পরিণত হয়। এ গুলো ৫০০ গজ (মিটার) উপরে যেতে পারে।’
ভিজিটর সেন্টারের বাইরে তাপমাত্রা প্রদর্শনসহ সেলফি পোস্ট করার জন্য পর্যটকরা ইতোমধ্যে ক্যালিফোর্নিয়া এবং নেভাদার মধ্যে সীমানা ঘেঁষে ডেথ ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কে ভিড় করছেন।
অনেকেই আশঙ্কা করছেন, তাপমাত্রা ১৫৩ ডিগ্রি ফারেনহাইটটের বিশ্ব রেকর্ড ভাঙবে, যা ১৯১৩ সালের জুলাই মাসে সেট করা হয়েছিল। তবে বেশ কিছু আবহাওয়াবিদের মতে এটি সম্ভবত একটি ত্রুটিপূর্ণ পরিমাপের ফলাফল ছিল।
নাসা’র জলবায়ুবিদ গ্যাভিন শ্মিট বলেছেন, নির্বিশেষে জুলাই ২০২৩ সবচেয়ে উষ্ণতম মাস ছিল। শুধুমাত্র রেকর্ড শুরু হওয়ার পর থেকে নয়, ‘হাজার হাজার বছর না হলেও শত শত বছরের মধ্যে এটি ছিল রেকর্ড তাপমাত্রা।’ প্রভাবগুলোকে শুধুমাত্র এল নিনোর আবহাওয়ার ধরণকে দায়ী করা যায় না, যা ‘সত্যিই কেবলমাত্র আবির্ভূত হয়েছে’ এবং বছরের শেষ নাগাদ এটি শক্তিশালী হবে এমন মনে হচ্ছে না। এল নিনো মধ্য ও পূর্ব গ্রীষ্মমন্ডলীয় প্রশান্তমহাসাগরে সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রার উষ্ণতার সাথে জড়িত।
গ্যাভিন শ্মিট বলেছেন, আশা করছিলাম চরম তাপের প্রবণতা অব্যাহত থাকবে না, ‘বায়ুমন্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ অব্যাহত থাকায় এখন আমরা আশঙ্কা করছি এই তাবদাহ অব্যাহত থাকবে।’
চিকিৎসকেরা বলছেন- গরমের কারণে সবচেয়ে বেশি যে সমস্যা হয়, তা হলো পানিস্বল্পতা। প্রচুর ঘামের কারণে পানির সঙ্গে সঙ্গে শরীর থেকে প্রয়োজনীয় লবণও বেরিয়ে যায়। ফলে শরীরের রক্তচাপ কমে যায়, দুর্বল লাগে, মাথা ঝিমঝিম করে। পানিস্বল্পতা গরমের খুব সাধারণ সমস্যা হলেও অবহেলা করলে তা মারাত্মক হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে, শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ ব্যক্তি এবং যাঁরা বাইরে কাজ করেন ও প্রয়োজনমতো পানি পান করার সুযোগ পান না, তাঁরাই মারাত্মক পানিস্বল্পতায় আক্রান্ত হন বেশি। এ ক্ষেত্রে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া এবং কিডনির সমস্যা হওয়াও বিচিত্র নয়।
পানিস্বল্পতা ছাড়াও গরমের কারণে ত্বকে ঘামাচি ও অ্যালার্জি হতে পারে। গরমে অতিরিক্ত ঘাম তৈরি হয়, যার চাপে ঘর্মগ্রন্থি ও নালি ফেটে যায়। ফলে ত্বকের নিচে ঘাম জমতে থাকে। এটাই ঘামাচি। অনেক সময় ঘাম ও ময়লা জমে ঘর্মনালির মুখ বন্ধ হয়ে যায় এবং সেখানে ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে। এতে ঘামাচি ও অ্যালার্জি বেড়ে যায় এবং ঘামে প্রচুর গন্ধ হতে পারে। ব্যাকটেরিয়া ছাড়াও ঘাম ও ময়লার কারণে ছত্রাকজনিত রোগও এ সময় বেশি হয়।
গরমে যাঁরা সরাসরি সূর্যের আলোর নিচে বেশিক্ষণ থাকেন, তাঁদের ত্বক পুড়ে যেতে পারে। এতে ত্বক লাল হয়ে যায়, জ্বালাপোড়া করে, চুলকায় ও ফোসকা পড়ে। মূলত সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মিই এর জন্য দায়ী। যারা একটু ফরসা বা যাদের ত্বক নাজুক, তাদের এই সমস্যা বেশি হয়।
গরমে সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যা হলো হিটস্ট্রোক। শুরুতে হিটস্ট্রোকের আগে হিট ক্র্যাম্পে দেখা দেয়, যাতে শরীর ব্যথা করে, দুর্বল লাগে এবং প্রচণ্ড পিপাসা লাগে। পরবর্তী সময়ে হিট ইগজোসশন দেখা দেয়, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয়, মাথাব্যথা করে এবং রোগী অসংলগ্ন আচরণ করতে থাকে। এ অবস্থায় দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া না হলে শরীরের তাপনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায় এবং শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে যায়। একে হিটস্ট্রোক বলে। এর লক্ষণগুলো হলো তাপমাত্রা দ্রুত ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে যায়, ঘাম বন্ধ হয়ে যায় এবং ত্বক শুষ্ক ও লাল হয়ে যায়, নিঃশ্বাস দ্রুত হয়, নাড়ির স্পন্দন ক্ষীণ ও দ্রুত হয়, রক্তচাপ কমে যায়, খিঁচুনি হয়, মাথা ঝিমঝিম করে এবং রোগী অসংলগ্ন ব্যবহার করতে থাকে। রোগীর প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায়, অজ্ঞান হয়ে যায়, এমনকি শকেও চলে যেতে পারে।
চিকিৎসকেরা পরামর্শ দিয়ে বলছেন, তীব্র গরমে যথাসম্ভব ঘরের ভেতরে বা ছায়াযুক্ত স্থানে থাকতে হবে। বাইরে বের হলে সরাসরি রোদ এড়িয়ে চলতে হবে। প্রয়োজনে টুপি বা ছাতা ব্যবহার করতে হবে। পরনের কাপড় হতে হবে হালকা, ঢিলেঢালা ও সুতি। শরীর যতটা সম্ভব ঢেকে রাখতে হবে। শরীরের উন্মুক্ত স্থানে সম্ভব হলে সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে, যা রোদে পোড়া থেকে সুরক্ষা দেবে। প্রচুর পানি ও অন্যান্য তরল পান করতে হবে। যেহেতু ঘামের সঙ্গে পানি ও লবণ দুই-ই বের হয়ে যায়, সেহেতু লবণযুক্ত পানীয়, যেমন-খাওয়ার স্যালাইন, ফলের রস ইত্যাদি বেশি করে পান করতে হবে। অবশ্যই বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করতে হবে। চা ও কফি যথাসম্ভব কম পান করা উচিত। প্রয়োজনমতো গোসল করতে হবে এবং শরীর ঘাম ও ময়লামুক্ত রাখতে হবে। শ্রমসাধ্য কাজ যথাসম্ভব কম করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কিছুক্ষণ পরপর বিশ্রাম নিতে হবে। প্রচুর পানি ও স্যালাইন পান করতে হবে। গুরুপাক খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। সাধারণ খাবার, যেমন-ভাত, ডাল, সবজি, মাছ ইত্যাদি খাওয়া ভালো। খাবার যেন টাটকা হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। নানা রকম ফল, যেমন-আম, তরমুজ ইত্যাদি এবং লেবুর শরবত শরীরের প্রয়োজনীয় পানি ও লবণের ঘাটতি মেটাবে। শিশু বা বয়স্ক ব্যক্তিদের বেলায় আরও বাড়তি সতর্কতা নিতে হবে। বাচ্চারা স্কুলে গেলে অথবা মাঠে খেলাধুলা করতে গেলে যেখানে-সেখানে পানি বা শরবত না খায়, আজেবাজে খাবার না খায় বরং বিশুদ্ধ পানি ও পানীয় গ্রহণ করে, তা নিশ্চিত করতে হবে। বয়স্ক ব্যক্তিরা অনেকক্ষণ যেন রোদে চলাফেরা বা কাজকর্ম না করে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।