Thikana News
১৪ ডিসেম্বর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪

ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগমনী বার্তায় আতঙ্কিত নথিপত্রহীন অভিবাসীরা

ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগমনী বার্তায় আতঙ্কিত নথিপত্রহীন অভিবাসীরা
৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত আমেরিকার ইতিহাসে নজিরবিহীন নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। ইলেকটোরাল কলেজ ভোট, পপুলার ভোট, ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেট-সব জায়গায়ই তিনি জয়লাভ করেন। শুধু তা-ই নয়, এবার হাউস ও সিনেটেও তার পার্টি জয়লাভ করেছে। সুতরাং দেশের আইন বিভাগ, বিচার ও শাসন বিভাগের ওপর মোটামুটি কন্ট্রোল তারই। এবারের নির্বাচনের ফলাফলে প্রতীয়মান হয়, ট্রাম্প তার শাসনামল একটু সহজভাবেই পরিচালিত করবেন। নির্বাচনের সময় তিনি বেশ কিছু সস্তা স্লোগান দিয়ে আমেরিকার ভোটারদের মন জয় করেন। যেমন অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, চাকরি ও বিনিয়োগ-সুবিধা, নথিপত্রহীন অবৈধদের দেশ থেকে বিতাড়িত করা, বর্ডারকে সিলগালা করা, বেআইনি প্রবেশাধিকার বন্ধ এবং যে দেশ থেকে আসবেন রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার আগেই সে দেশে ফেরত পাঠানো হবে। সে জন্য ১০ হাজার নতুন বর্ডার পেট্রোল এজেন্ট নিয়োগ করবেন। বিশেষ করে, নথিপত্রহীন পিতামাতার সন্তান আমেরিকায় জন্ম নিলে তাদেরকে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না। বর্তমান বিধান বাতিল করবেন। অর্থাৎ ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’-এ ধরনের সস্তা স্লোগান দিয়েই তিনি আমেরিকানদের মন জয় করেন। এখন দেখার বিষয়, এবার সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা নিয়ে ২০ জানুয়ারি সোমবার ২০২৫ ক্ষমতায় বসার পর প্রেসিডেন্ট কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিবাসন নীতিতে কট্টরপন্থী হিসেবে পরিচিত সাউথ ডাকোটার গভর্নর ক্রিস্টি নোয়েমকে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সেক্রেটারি পদে মনোনীত করেছেন। তিনি নথিপত্রহীনদের ধরপাকড়সহ সকল আইনের কঠোর প্রয়োগ করার জন্য সেনাবাহিনীকে ব্যবহার, অর্থাৎ ট্রাম্পের ইমিগ্রেশন ক্র্যাকডাউন প্ল্যান বাস্তবায়নে সর্বশক্তি প্রয়োগ করবেন। যদি তিনি এই কাজে সেনাবাহিনী ব্যবহার করেন, তবে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর জন্য একটি মৌলিক পরিবর্তন আনবে। কারণ সাধারণত তারা দেশের অভ্যন্তরীণ আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে জড়িত থাকে না। তার ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ অবৈধ অভিবাসীর ঘুম হারাম। এভাবে যদি তাড়ানো শুরু করেন, তবে প্রায় দুই কোটি পরিবারের ওপর চাপ পড়বে। অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়ে রাজস্ব কমে যাওয়ার পাশাপাশি শ্রমবাজারে সংকট সৃষ্টি হবে। বিশেষ করে, তিনি যে ঘোষণা করেছেন নথিপত্রহীন পিতামাতার সন্তানদের জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব দেবেন না। এই পদক্ষেপ সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীর সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত বিভিন্ন মহলে আতঙ্ক ও বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। আমেরিকার ইমিগ্রেশন রাইট সোসাইটির রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় ৫.১ মিলিয়ন শিশু অবৈধ অভিবাসীর পিতামাতার সন্তান হিসেবে জন্ম নিচ্ছে। এই বিশাল সংখ্যক শিশুকে তার পিতামাতার বৈধ কাগজপত্রের কারণে রাষ্ট্রের জন্মের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা অমানবিক ও নিষ্ঠুর আচরণ বলে বিবেচিত হবে। কারণ এই শিশুগুলো যখন বড় হবে, তখন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, চিকিৎসা, আবাসস্থলসহ চলার পথে প্রতি পদক্ষেপে বৈষম্য ও বঞ্চনার মুখোমুখি হবে; যা বর্তমান আধুনিক বিশ্ব ও কোনো সভ্য সমাজের ক্ষেত্রে চলে না। ট্রাম্পের এই ইমিগ্রেশন ক্র্যাকডাউনের রূপরেখার ফলে দেশে ব্যাপকভাবে আইনি ও লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ বাড়বে। কিন্তু তিনি তা পাত্তা দিচ্ছেন না। তবে তার নির্বাহী আদেশ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী শিশুর নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া সহজ হবে না। কেবল নতুন সাংবিধানিক সংশোধনী পাস করলেই হবে না, এ জন্য প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের প্রয়োজন হবে এবং তিন-চতুর্থাংশ স্টেটের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে। আইনের এই ধাপগুলো পেরিয়ে আসা খুবই মুশকিল হবে। এ নিয়ে অভিবাসী অধিকার সংগঠনগুলো মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে; যা শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়াবে এবং শেষ করতে দীর্ঘ সময় লাগবে। এ সময় পর্যন্ত ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকবেন না। রাজনৈতিক আবহাওয়া অনুকূলে নাও থাকতে পারে।
১৮৬৮ সালে গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে প্রণীত এই সংশোধনীটি যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী প্রত্যেক ব্যক্তিকে নাগরিকত্ব প্রদান করে, তাদের পিতামাতা যেই অভিবাসন অবস্থায় থাকুক না কেন। মূলত এই আইনটি সংখ্যালঘু এবং আফ্রিকান আমেরিকারনদের জন্য নাগরিকত্বের অধিকার নিশ্চিত করে। ১৪তম সংশোধনীতে থাকা নাগরিকত্ব অনুচ্ছেদটি সময়ের পরীক্ষায় টিকে আছে এবং সুপ্রিম কোর্টের একাধিক মামলার রায়ে সুরক্ষিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটি মামলার রায় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ১৮৯৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বনাম ‘ওয়াং কিম আর্ক’ মামলায় বলা হয়েছে, আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী যেকোনো শিশু আমেরিকার নাগরিক বলে গণ্য হবে। চায়নিজ পিতামাতা ১৮৯০ সালে চীন থেকে আসার সময় বাধা দিলে একটি মামলা হয়। এই মামলা শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টে ৬-২ ভোটের মাধ্যমে নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করা হয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যদি এই পদক্ষেপ নেন, তাহলে শেষ পর্যন্ত কোর্টের আশ্রয় নিতে হবে। তখন অতীত কোর্টের মামলার রায়ের রেফারেন্সের মাধ্যমে তিনি মামলায় হেরে যাবেন।
জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিল একটি সাংবিধানিক, জটিল এবং অসম্ভব প্রক্রিয়া। তা সুপ্রিম কোর্টের রায় ও সংবিধান দ্বারা সুরক্ষিত ও নিশ্চিত করা। ট্রাম্পের রাজনৈতিক প্রচারণার ও পাসের জন্য আবেগিকতায় আমেরিকার জনগণকে প্রভাব বিস্তারের কৌশল। তারা মনে করেন, অবৈধদের বহিষ্কার, বর্ডারকে সিলগালা করে বেআইনিভাবে আসা বন্ধ এবং অবৈধ অভিবাসী পিতামাতার সন্তানদের জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বন্ধ করলে আমেরিকা তথাকথিত নিরাপদ হয়ে যাবে। বর্ডার সিল অথবা ব্যাপক ধরপাকড় করতে পারে, কিন্তু জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিল একটা সময়সাপেক্ষ ও দুরূহ ব্যাপার।
এবারের নির্বাচনে মূলত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের গত চার বছরের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নীতির ব্যর্থতা জনগণকে চরমভাবে হতাশ করেছে। সে কারণেই এই ভরাডুবির     মাধ্যমে ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে খেসারত দিতে হয়েছে। আর এই সুবর্ণ সুযোগটা সফল রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প নিতে ভোলেননি। নির্বাচনী প্রচারণায় অর্থনৈতিক উদ্বেগ, কর্মসংস্থানের সংকট, বিশ্বব্যাপী যুদ্ধবিগ্রহ, আমেরিকানদের নিরাপত্তার বিষয় এবং পুনর্গঠনের বক্তব্য জনগণের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। একজন জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে আবেগ, উন্মাদনা তিনি সৃষ্টি করেছন। নির্বাচনী বক্তৃতা আর রাষ্ট্র পরিচালনা ভিন্ন জিনিস। বিভাজনের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা করা যায় না। এতে রাষ্ট্র শক্তিশালী ও টেকসই উন্নয়ন হয় না। এখানে আবেগের স্থান নেই। যা করার সংবিধান, আইন ও রাষ্ট্রের শত বছরের ঐতিহ্য, ভিত্তি কাঠামোর মধ্যেই করতে হবে। আমেরিকার জনগণ আশাবাদী, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভেবেচিন্তে দেশের কল্যাণ, সকল মানুষের বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্য ও সংহতির দিকে গুরুত্ব দেবেন। লেখক : কলামিস্ট ও রাজনীতিক
 

কমেন্ট বক্স