বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, আর তা হলো ‘নিজের নামের জন্য সবকিছু করা’। শেখ হাসিনা সরকারের মোট চারবারের শাসনামলের কুড়িটা বছর ধরে তিনি এবং তার সরকার সেই কাজটাই করেছে পরম নিষ্ঠার সঙ্গে। এ বিষয়ে পিতা ও কন্যা দুজনই সমানে সমান। এ ছাড়া কতটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সড়ক-মহাসড়ক, সেতু-কালভার্ট, দ্বীপ-স্টেডিয়াম, স্মারক সংস্থা কিংবা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে এই দুই ব্যক্তিত্বের নামে, তার কোনো হিসাব নেই। এতই অগণিত ও সীমাহীন সেই তালিকা, তার মধ্য থেকে কিছুসংখ্যক তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
বাংলাদেশের রাজধানী শহরের নামকরা একটি চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রথমেই আসত পিজি হাসপাতাল বা আইপিজিএমআর-এর নাম। শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণ করে পিতার নামে এর নামকরণ করেন ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়’।
এ ছাড়া আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয় শেখ সাহেবের নামে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি, গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নারায়ণগঞ্জে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, লালমনিরহাটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পে বিশ্ববিদ্যালয়, পিরোজপুরে বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেহেরপুরে মুজিবনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং নওগাঁয় বঙ্গবন্ধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়।
এ ছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু হলের নামও রয়েছে বঙ্গবন্ধুর নামে। যেমন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু ইন্টারন্যাশনাল হল, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান হল, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হল ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু হল। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ এবং সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একইভাবে রয়েছে বঙ্গবন্ধু হল।
এ ছাড়া বাংলাদেশের যেসব কলেজের নাম পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধুর নামে করা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে ঢাকায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কলেজ ও টাঙ্গাইলে বঙ্গবন্ধু টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। একইভাবে গাজীপুর, চাঁদপুর, কুমিল্লা, খুলনা, মাদারীপুর, রাজশাহী, নীলফামারী, গোপালগঞ্জ, জামালপুর, পঞ্চগড় ও চট্টগ্রামে কয়েকটি কলেজের আগের নাম পরিবর্তন করে শেখ সাহেবের নামে নামকরণ করা হয়।
শুধু বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজই নয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের তালিকায়ও রয়েছে বঙ্গবন্ধুর নাম। যেমন নারায়ণগঞ্জ, নীলফামারী, চট্টগ্রাম, গোপালগঞ্জ, পটুয়াখালী, সাতক্ষীরা, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন জেলায় এই নামকরণের আওতায় রয়েছে অর্ধশতাধিক বিদ্যালয়।
এ ছাড়া গাজীপুর জেলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর সাফারি পার্ক ও কক্সবাজারে রয়েছে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক। ফরিদপুরে রয়েছে মুজিব উদ্যান। মুজিববর্ষ হিসেবে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ গেমসের নবম আসরের নামকরণ করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ গেমস কিন্তু করোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন খেলাটি স্থগিত করে। ওই সময়ে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগকে (বিপিএল) বঙ্গবন্ধু পিপিএল নামে নামকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। ২০০৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার তেজগাঁওয়ের বিজয় সরণিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ভাসানী নভো থিয়েটার। সেখানে নভোমণ্ডল সম্পর্কে বিস্তারিত জানার সুযোগ ছিল। এটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়ে থাকে। স্থপতি আলী ইমাম ওই স্থাপনার নকশা প্রণয়ন করেছিলেন। বলা হয়ে থাকে, প্রাচীন ধ্রুপদি ও আধুনিক নির্মাণশৈলীর মিশ্রণে ওই নভো থিয়েটারের নকশা করা হয়েছিল। ২৭৫ আসনবিশিষ্ট একটি স্পেস থিয়েটার গেম ছাড়াও রয়েছে ৩০ আসনের অপর একটি রাইড সিমুলেটর। ওই নভো থিয়েটারের তিনটি তলা রয়েছেÑএকটি মাটির নিচে এবং দুটি মাটির ওপরে। এটির নির্মাণব্যয় ছিল ১২০ কোটি টাকা। সময়ও লেগেছে বহুদিন। প্রথম পর্বে ২০০০ সালের ১৭ জুলাই কাজ শুরু হলেও মাঝখানে বন্ধ ছিল কিছুদিন। তারপর ২০০২ সালের মাঝামাঝি আবার কাজ শুরু করে ২০০৩ সালের মে মাসে শেষ হয় এবং ২০০৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এটির উদ্বোধন করেছিলেন। তখন এটির নামকরণ করা হয়েছিল মাওলানা ভাসানী নভো থিয়েটার।
শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে ওই নভো থিয়েটারের নামের প্রথম অংশ মাওলানা ভাসানী বাদ দিয়ে তার পিতার নামে নামকরণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভো থিয়েটার। আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল ওই নভো থিয়েটারে যেখানে নভোমণ্ডলের ধারণা পাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে কৃত্রিম নভোমণ্ডলের আদলে আবহ তৈরি করা হয়েছিল, সেসব চিহ্ন মুছে দিয়ে ওই স্থানে শেখ মুজিবের জীবনী দেখানো হতো। একইভাবে দেশজুড়ে শেখ মুজিবের ভাস্কর্য তৈরি হয়েছে প্রায় ১০ হাজার। যমুনা নদীর পাড়ে তৈরি করা হয়েছিল তার দুটি বইয়ের ম্যুরাল। তবে পাবনার বেড়া উপেজেলায় ‘শেকড় থেকে শিখরে’ শিরোনামের স্মৃতি ভাস্কর্যটি ছিল স্টেইনলেস স্টিলের তৈরির বঙ্গবন্ধুর সর্ববৃহৎ ভাস্কর্য। ১০ ফিট উচ্চতার কংক্রিটের স্তম্ভের ওপর নির্মাণ করা হয়েছিল ১৮ ফিট উচ্চতার শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য। ওই ভাস্কর্যের দুই পাশে রয়েছে তিনটি করে স্তম্ভ, যাতে সিমেন্ট দিয়ে অঙ্কিত করা হয়েছে ৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির উত্থান-পতনসহ উন্নয়নের ধারাবাহিকতা। মূলত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণে যারা বিরোধিতাকারী ছিল, তাদের সম্পর্কে আওয়ামী লীগের মুখপাত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছিল, যারা এর বিরোধিতা করে তারা হচ্ছে ‘স্বাধীনতাবিরোধী’।
মুজিববর্ষ উপলক্ষে সারা দেশে ওইসব ম্যুরাল ও ভাস্কর্য নির্মাণ করেছিল লীগ সরকার। উল্লেখ্য, শেখ সাহেবের জন্মশতবার্ষিকী পালনের জন্য ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ৩১ মার্চ সময়কালকে মুজিব শতবর্ষ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল লীগ সরকার।
ওই সময়কালের ভিত্তিতে নির্মিত হয়েছে অনেকগুলো ভাস্কর্য। ওইসব ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্দেশ্যে যে বাজেট নির্ধারণ করা হয়েছিল, তার পরিমাণ ছিল প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে মোট কুড়িটি সংস্থা, যার প্রতিটি কার্যালয়ে ম্যুরাল স্থাপন করা হয়েছিল। এমনকি কোনো কোনো আঞ্চলিক কার্যালয়ের সামনেও ম্যুরাল স্থাপন করা হয়েছিল। শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যে ম্যুরাল স্থাপিত হয়েছিল, তার ডিজাইন ও তৈরিতে খরচ হয়েছিল মোট ৫০ লাখ টাকা। আর অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে ওই কাজে খরচ হয়েছে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। দেশের বিভিন্ন স্থানে ভাস্কর্য ও ম্যুরাল স্থাপনায় ব্যয় হয়েছে চার হাজার কোটি টাকারও বেশি। এভাবে পদ্মা সেতুতে দুটি ম্যুরাল বানাতে ১১৭ কোটি টাকা ব্যয়ের একটি হিসাব রয়েছে লীগ সরকারের আমলের। আসলে মুজিববর্ষ পালনের নামে সরকারের ভেতরে খরচের একটা মহোৎসব শুরু হয়েছিল। পুরো ১৫টি বছর ধরে এই উৎসবকে জিইয়ে রেখেছিল হাসিনা সরকার। এ ছাড়া টাঙ্গাইলের যমুনা সেনানিবাসের নামকরণ করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু সেনানিবাস। বানৌজে বঙ্গবন্ধু নামে রয়েছে ফ্রিগেট ক্ষেপণাস্ত্র। ঢাকায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ঘাঁটিও রয়েছে বঙ্গবন্ধুর নামে। ঢাকার জাতীয় স্টেডিয়ামের নামের আগে যুক্ত করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শব্দটি।
নভো উপগ্রহযানের শুরুতে যুক্ত করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু-১। সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইলের যমুনা নদীর ওপর যমুনা সেতু একইভাবে বঙ্গবন্ধুর নামে নামকরণ করা হয়েছে।
লীগ সরকারের আমলে শেখ হাসিনা তার এবং তার পরিবারের সদস্যদের নামে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ছয়টি পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু জনপ্রশাসন পদক, শেখ রাসেল পদক, বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড ফর ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন পদক এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প পুরস্কার। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক শান্তি পদক নীতিমালা অনুযায়ী, ওই পুরস্কারের মূল্যমান ছিল এক লাখ মার্কিন ডলার এবং ৫০ গ্রাম ওজনের স্বর্ণপদক। একইভাবে জনপ্রশাসন পদকের নীতিমালা অনুযায়ী, ২০২২ সালে প্রণীত ওই পদকের মূল্যমান ছিল ব্যক্তিগত অবদানের জন্য দুই লাখ এবং দলগত অবদানের জন্য পাঁচ লাখ টাকা, সঙ্গে সম্মাননা স্মারক হিসেবে স্বর্ণপদক ও ক্রেস্ট।
শুধু নিজের পরিবারের সদস্যদের নামে স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠানের নামকরণে হাসিনা উৎসাহী ছিলেন তেমন নয়, তিনি তার দলীয় অনুগত ব্যক্তিদের নামের প্রতিও আনুগত্য দেখিয়েছেন। যেমন দেশের ছয়টি সরকারি মেডিকেল কলেজের নামের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন ওই সব ব্যক্তিত্বদের, যেমন মানিকগঞ্জ কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ, আব্দুল মালিক উকিল মেডিকেল কলেজ নোয়াখালী, জামালপুর শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ, শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ টাঙ্গাইল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ ফরিদপুর এবং এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ দিনাজপুর। উল্লেখ্য, অন্তর্বর্তী সরকার প্রাথমিক পর্যায়ে এই ছয়টি মেডিকেল কলেজের নামের সঙ্গে যুক্ত ছয়জন ব্যক্তিত্বের নাম বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।