সাংবাদিক নির্যাতন বিশ্বে নতুন কিছু নয়। কেননা সাংবাদিক হলো বস্তুনিষ্ঠ ও সঠিক সংবাদ পরিবেশনের কারিগর। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্য খবর সরবরাহ এবং গণমাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করার ফলে জনমনে প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব পড়ে। এ ক্ষেত্রে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার সহায়ক হিসেবে একজন সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকই মূলত মানবতার পক্ষের শক্তি। কেননা, সাংবাদিক সামাজিক অবক্ষয় ও রাষ্ট্রশক্তির অন্যায় শোষণ-নিপীড়নের সঠিক চিত্রসমূহ তুলে ধরেন। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সঠিক খবর পরিবেশনের ফলেই সাংবাদিকেরা নিপীড়ন, নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এই নিপীড়ন শুধু ব্যক্তিজীবনেই ঘটে না, তাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। অনেকের জীবন বিপন্ন হয় এবং পরিবার সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে।
সত্যের পক্ষে থাকেন বলেই সাংবাদিকেরা সব সময় রাষ্ট্রীয় নজরদারির মধ্যে থাকেন এবং রোষানলে পড়েন। একই কারণে অন্যায়কারী ও অপরাধী চক্র এমনকি রাষ্ট্রপুঞ্জ সরাসরি সাংবাদিক নিপীড়নের জোগান দিয়ে থাকে। ফলে সর্বত্র সাংবাদিকই হন সন্ত্রাসী, অপরাধীর মূল টার্গেট ও নিপীড়নের শিকার।
বিশ্বব্যাপী সাংবাদিক নির্যাতনের ইতিহাস বড়ই করুণ। পৃথিবীর দেশগুলোতে রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্র সর্বদাই সত্য খবর প্রকাশে বাধা দিয়েছে এবং বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় বিরাট প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে। পৃথিবীর একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং স্বৈরতন্ত্রী রাষ্ট্রসমূহের অন্যায় শাসনের সত্য-সঠিক খবর পরিবেশনের কোনো সুযোগ নেই। রাষ্ট্রীয় নজরদারি এড়িয়ে, রাষ্ট্রপুঞ্জ কর্তৃক সংঘটিত অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার-নিপীড়নের খবর প্রকাশ করার অপরাধে সাংবাদিকেরা জেল-জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হন। সর্বত্রই সাংবাদিকের ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন ও নানাবিধ হয়রানি চলছে।
যেসব দেশে যারাই রাষ্ট্রীয় অন্যায় ও গণস্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঠিক খবর প্রকাশ করেন, সেসব দেশে সাংবাদিকেরা নির্যাতনের শিকার হন। কঠোর আইনের অমানবিক প্রয়োগে অনেককে নির্মমভাবে হত্যাও করা হয়ে থাকে। সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই পাক-ভারত উপমহাদেশের সর্বত্র কোনো না কোনোভাবে সাংবাদিক নির্যাতন ও নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। সব সময় রাষ্ট্রশক্তির কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপিত হওয়ায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিঘ্নিত ও খর্ব হয়েছে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। সর্বত্রই সাংবাদিকদের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চলছে। সরকার ও সন্ত্রাসীদের কোপানলে অনেক সাংবাদিক নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা যেমন নতুন নয়, তেমনি পৃথিবীর নানা প্রান্তে, নানা দেশেও সাংবাদিকের ওপর সরকার কর্তৃক নির্যাতনের খড়্্গ নেমে আসে।
বাংলাদেশে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান ও পটপরিবর্তনের পূর্বেকার সরকারের দীর্ঘ সময় মিডিয়ার ওপর তথ্য বিকৃতির অভিযোগে সাংবাদিকদের প্রতি অমানবিক আচরণ ছিল লক্ষণীয়। মিডিয়ার ওপর কঠোরভাবে নানা রকম বিধি-নিষেধ আরোপিত ছিল। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট আইনে সর্বপ্রকার সংবাদমাধ্যমের ওপর ছিল কঠোর বিধি-নিষেধ। সংবাদমাধ্যম ছাড়াও সোশ্যালসহ যেকোনো প্রচার মিডিয়ায় শেখ হাসিনা ও তার সরকারের সমালোচনা করা ছিল দণ্ডনীয় অপরাধ। যার ফলে সাত বছর কিংবা ততোধিক বেশি জেল হওয়ার বিধান ছিল। ফ্যাসিবাদী কায়দায় কঠোর আইনের মাধ্যমে তথ্যপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে। রাষ্ট্র কর্তৃক একপেশে সংবাদের বিপরীতে সত্য-সঠিক খবর পরিবেশন ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। একইভাবে হাসিনা-পূর্ববর্তী সরকারসমূহের আমলেও সাংবাদিক নির্যাতনের অনেক ঘটনা ঘটেছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকারের আমল থেকেই সাংবাদিক নিপীড়ন শুরু হয়। বিশেষ ক্ষমতা আইনে চারটি সংবাদপত্র রেখে সকল সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়া হয়। যার ফলে সমগ্র দেশের হাজার হাজার সাংবাদিক ও সংবাদকর্মী চাকরিচ্যুত হয়ে রাস্তায় ছিটকে পড়েন।
২০২৩ সালে বাংলাদেশ সরকারকে জবাবদিহির আওতায় আনতে চাওয়া সাংবাদিক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের ওপর ব্যাপক নিপীড়নে উদ্বিগ্ন বলে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জানানো হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার এ নিয়ে একাধিকবার প্রেস কনফারেন্স করেন। একইভাবে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজেও বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতনে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়া ম্যাথিউ মিলারের বক্তব্যের ভিডিওর সঙ্গে বাংলায় পোস্ট করা ক্যাপশনে বলা হয়, ‘যেমনটা আমরা আগেও বলেছি, আমরা বিশ্বাস করি, গণতন্ত্রে সাংবাদিকেরা অপরিহার্য ভূমিকা পালন করেন। তাদের করা সংবাদে দুর্নীতির মুখোশ উন্মোচিত হয়।’
বিগত দিনে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসনে যে পরিমাণ নিরীহ গণমানুষের প্রাণহানি হয়েছে, পৃথিবীতে হিটলারের মানবতাবিরোধী পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের পর এমন নৃশংসতা অন্য কোথাও সংঘটিত হয়নি। এ-যাবৎ ইসরায়েলের আগ্রাসনে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন অসংখ্য সাংবাদিক। গত এক বছরেই শুধু ইসরায়েলের নির্মমতায় মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারিয়েছেন দুই শতাধিক সাংবাদিক। ইসরায়েলি বর্বরতায় কোনো কোনো সাংবাদিক পরিবারের সকল সদস্য মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারান। সাংবাদিকদের প্রতি নির্মম হত্যাযজ্ঞ শুধু ফিলিস্তিনেই ঘটে না, খোদ ইসরায়েলেও সাংবাদিকের ওপর নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। ইসরায়েলি দস্যুদের প্রতিদিনকার আক্রমণে নিরীহ জনগোষ্ঠী অকাতরে প্রাণ হারায়। আল-জাজিরাসহ ইসরায়েলি গণমাধ্যমে সংবাদ পরিবেশনে বাধাগ্রস্ত করে। এ ছাড়া লেবানন ও তেল আবিবের আল-জাজিরা অফিসগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়।
কয়েক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম শাসনামলে সৌদি বংশোদ্ভূত ওয়াশিংটন পোস্টের প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক জামাল খাশোগি তুরস্কের সৌদি দূতাবাসে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। সৌদি রাজপরিবার কর্তৃক সংঘটিত সেই বর্বর হত্যাকাণ্ডে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। সেই বীভৎস হত্যাকাণ্ডে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানকে দায়ী করে এবং আমেরিকা, তুরস্কসহ অনেক রাষ্ট্র সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে। কিন্তু আজও সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি।
বাংলাদেশের বাইরে মিয়ানমারে সামরিক জান্তার শাসনামলে সাংবাদিক এবং ভিন্নমতাবলম্বীরা হত্যা-নির্যাতনের শিকার হন। একইভাবে আফগানিস্তানে তালেবান সরকার সে দেশের সাংবাদিকদের প্রতি অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে বলেও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমসূত্রে জানা যায়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকেরা কি নির্বিঘ্নে তথ্য সংগ্রহ করে জনগণের কাছে তা পৌঁছাতে পারছেন? সোজা উত্তরÑপারছেন না। সরকারের বিরুদ্ধে সংবাদ পরিবেশন করা মানে নিজের বিপদ ডেকে আনা। তবু বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিক তার লক্ষ্য থেকে পিছপা হন না। বাংলাদেশের মর্মপীড়াদায়ক সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এখনো আমাদের কাঁদায়। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিক সাগর সারোয়ার ও মেহেরুন রুনির রোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড ঘটে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারোয়ার ও মেহেরুন রুনি একটি প্রভাবশালী চক্রের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় ঢাকায় নিজ বাসভবনে সন্ত্রাসী দুর্বৃত্তের আঘাতে উভয়েই (স্বামী-স্ত্রী) মর্মান্তিকভাবে খুন হন। তাদের পাঁচ বছরের একমাত্র শিশুসন্তানের সামনেই ভয়ংকর হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছিল।
সাগর-রুনি দম্পতির সেই হত্যাকাণ্ডটির ঘটনায় উচ্চস্তরের রাজনৈতিক মনোযোগ ও গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করা হয় এবং সমগ্র বাংলাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এ ঘটনা বাংলাদেশের সাংবাদিক ইউনিয়নভুক্ত সকল সংগঠনকে একীভূত করে। তারা সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে আসছে। কিন্তু কোনো ফল হয়নি।
জীবদ্দশায় মি. সাগর সারোয়ার জার্মানির ডয়চে ভেলের সাংবাদিক হিসেবে কাজ করতেন। ফলে জার্মানিসহ দেশ-বিদেশের সংবাদমাধ্যমেও সেই হত্যাকাণ্ডের নিন্দায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পায়। পরিতাপের বিষয়, ২০১২ থেকে ১৫ বছরের বেশি আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকেছে। কিন্তু সাগর-রুনি হত্যার বিচার করেনি। ফলে মামলাটি নিয়ে সাংবাদিক মহলসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংস্থাগুলোও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে আসছে। মামলাটি এখনো চলমান রয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের বরাতে আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানায়, ২০২০ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১২৯টি মামলা হয়েছে এবং এসব মামলায় ২৬৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। আলোচ্য সময়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে একজন সাংবাদিক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান এবং ১৫৪ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হামলা-মামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। নির্যাতিত সাংবাদিকদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ৮ জন, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মীদের দ্বারা ১৪ জন, স্থানীয় পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৩ জন, হেফাজতে ইসলামের ডাকা হরতালে ১৩ জন সাংবাদিক আহত হন। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে নোয়াখালীতে আওয়ামী লীগের বিবদমান দুই পক্ষের সংঘর্ষে মারা যান বুরহান মুজাক্কির (২৫)। আওয়ামী লীগের এক পক্ষ তাকে নিজেদের অনুসারী বলে দাবি করে। সেই ঘটনায় মামলা হলেও তার অগ্রগতি নেই। সাংবাদিকদের ওপর যত হুমকি ও হামলা বাড়ে, সাংবাদিকতার স্বাধীনতা তত সংকুচিত হয়। জীবন রক্ষা করতে তারা অনেক জানা তথ্য প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকেন।
আরএসএফের প্রতিবেদনমতে, বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে আরও এক ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। এ বছর ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে ১৫২তম অবস্থানে। অন্যদিকে পাকিস্তান, ভারত ও শ্রীলঙ্কার অবস্থান যথাক্রমে ১৪৫, ১৪২ ও ১২৭। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই মূলত সবার নিচে।
সাংবাদিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান গৌরবজনক ছিল না। স্বাধীনতা কেবল গণমাধ্যমের সংখ্যা দিয়ে বিচার হয় না, বিচার হয় সাংবাদিকতার মান ও নিরপেক্ষতাপূর্ণ বস্তুনিষ্ঠতার পরিবেশন দিয়ে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বে আমাদের দেশের সাংবাদিকেরা অনেক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গুম ও নিখোঁজ হয়েছেন। অনেকে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে অনেক সাংবাদিক নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন। সত্য ও সঠিক খবর প্রকাশের অভিযোগে অনেক সাংবাদিককে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, খোন্দকার আবু তালেব, নিজামুদ্দীন আহমদ, এস এ মান্নান (লাডু ভাই), আ ন ম গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ নাজমুল হক, শহীদ সাবের, আবুল বাশার, শিবসাধন চক্রবর্তী, চিশতী শাহ্ হেলালুর রহমান, মুহাম্মদ আখতার, সেলিনা পারভীনসহ অসংখ্য সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধের সময় শাহাদাত বরণ করেন।
সবার প্রত্যাশা ছিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সাংবাদিকসহ কোনো পেশাজীবীর ওপর আর কোনো জুলুম-নিপীড়ন ও নির্যাতন হবে না। গণতান্ত্রিক নীতি অনুযায়ী সবার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পথ অবারিত থাকবে। কিন্তু স্বাধীনতার অব্যবহিত পর বাংলাদেশে সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকদের ওপর নেমে আসে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ ও নিপীড়ন। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার প্রতি সরকারি নীতিমালায় অনেক পরিবর্তন ঘটানো হয়। কঠোর বিধি-নিষেধের আওতায় সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের ওপর নানা রকম হয়রানি ও নিপীড়ন শুরু হয়।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বেশ কটি সংবাদপত্র ও টেলিভিশন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সাংবাদিকেরা চাকরি হারিয়েছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে জুন-এই ছয় মাসে দেশে ১১৯ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি, হুমকি, মামলা ও পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাধার শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ঢাকা জেলায় সর্বাধিক ২৯ জন এবং চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা জেলার ৮ জন করে সাংবাদিক রয়েছেন। ২০২৩ সালের জুন মাসে জামালপুরের বকশীগঞ্জে সাংবাদিক গোলাম রব্বানি নাদিমের ওপর ১৫ জুনের ভয়াবহ হামলা ও হত্যার রেশ না কাটতেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সাংবাদিক ভয়ংকরভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। নাদিমকে আক্রমণ করে, পিটিয়ে হত্যা করেছেন আওয়ামী লীগ নেতা সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবু ও তার পুত্র ছাত্রলীগ নেতা রিফাত। তার সঙ্গে জড়িত বিরাট এক অপরাধী চক্র। জামালপুরের সাহসী সাংবাদিক নাদিমের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর গণমানুষের প্রতিবাদের মুখে অবশেষে বাবু চেয়ারম্যানকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। একইভাবে খুনিদের কয়েকজনকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু হত্যায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া চেয়ারম্যান-পুত্র থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে!
সাংবাদিক নিপীড়নের ঘটনায় বাংলাদেশে অনেক ভয়ংকর হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। সাগর-রুনি হত্যা মামলার মতো অনেক খুনের মামলা বছরের পর বছর ঝুলতে থাকে। একেকটি হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ যখন বছরের পর বছর ঝুলতে থাকে, অন্যান্য অপরাধও বল্গাহীনভাবে সমাজকে বিষাক্ত করে তোলে।
এদিকে ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশে নিপীড়িত ও নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করার লক্ষ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করেছে পেশাগত অধিকার সংগঠন ‘জার্নালিস্টস ফর জাস্টিস’ (Journalist for Justice)। সংগঠনটি চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পূর্বেকার শেখ হাসিনার বিগত ১৫ বছরে নিপীড়িত ও নির্যাতিত সাংবাদিকদের তালিকা করবে। নতুন বাংলাদেশের বর্তমান পরিবর্তনের পর আমরা আশা করছি, সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে, সবার মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। মানুষের স্বাধীন মতামত প্রদান ও কথা বলার স্বাধীনতার ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ কাম্য নয়। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পথ সুগম হবে-সেটি সবার প্রত্যাশা। লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক