Thikana News
২১ নভেম্বর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

এফ ফোর ভিসা

এফ ফোর ভিসা
আমেরিকায় শরৎ এসে গেছে। পাতা ঝরার দিন শুরু হয়ে গেছে, আর সাথে হালকা শীত। আজ আকাশটা মেঘলা, সেই সাথে রেহানার মনটাও যেন মেঘলা। নিজের অজান্তে কীভাবে পাঁচটা বছর কেটে গেল, টেরও পায়নি। মনে হয় এই তো সেদিন আমেরিকায় এসেছিলাম, নিউইয়র্কের সেই জেএফকে এয়ারপোর্টে এমিরেটসের প্লেন ল্যান্ড করেছিল। তারপর ছোট ভাইয়া তার পরিবারসহ এয়ারপোর্টে এসেছিল পিকআপ করার জন্য। সেদিনের সেই ল্যান্ডিং জীবনের অনেক বড় স্বপ্ন পূরণ হওয়ার প্রথম ধাপ ছিল। মনে হয়েছিল আজ এসে গেছি স্বপ্নের এই আমেরিকায়।
ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতাম, যদি কোনো একদিন আমেরিকায় যেতে পারতাম, তাহলে কত কিছুই না করতে পারতাম। বড় ভাইয়া অনেক বছর যাবৎ আমেরিকায় ছিল। এফ ফোর ভিসার জন্য বড় ভাইয়া অ্যাপ্লাই করেছিল ২০০৩ সালে। আজ প্রায় ১৬ বছর পর ২০১৯ সালে ভিসা পেয়েছি। সাথে ছিল আমার বর আর দুই ছেলেমেয়ে।
দেশ ছেড়ে আসার সময় কিছুটা কষ্ট হচ্ছিল। সারা জীবন যে দেশের মাটিতে থেকেছি, সে মাটি আর মানুষ ছেড়ে আসতে খারাপ লাগছিল। কিন্তু এই স্বর্গরাজ্যের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে, এই ভেবে মনের অনেক বড় আশা-আকাক্সক্ষা ও স্বপ্ন নিয়ে এখানে আসা। অনেকটা এক্সাইটমেন্ট কাজ করছিল তখন মনে।
ছোট ভাইয়ের বাসা নিউজার্সিতে, নিউইয়র্কের জেএফকে এয়ারপোর্ট থেকে দুই ঘণ্টার দূরত্ব। দুই ঘণ্টার মধ্যে সবাই বাসায় পৌঁছে গেলাম। বাসায় যেতে যেতে গাড়িতে জানালা দিয়ে আমেরিকার রাস্তাঘাট দেখছিলাম, আকাশ দেখছিলাম, গাছপালা আর বড় বড় বিল্ডিং, বড় বড় সব ব্রিজ। কী সুন্দর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এই দেশ! এটাই বুঝি আমেরিকা।
বাসায় এসে দেখি ভাবি খাবারদাবারের বেশ আয়োজন করে রেখে গিয়েছিল। আসার পর সবাই হাতমুখ ধুয়ে একসাথে খাওয়াদাওয়া করলাম। এর মধ্যে বড় ভাইয়া এবং ভাবির সাথেও ফোনে আলাপ হয়েছে। আসলে আমেরিকায় যে সত্যিই এসে পৌঁছে গেছি, সেটাই মনে হয় বিশ্বাস হচ্ছিল না। বড় ভাইয়া আর ভাবি নিউজার্সির ছোট ভাইয়ের বাসা থেকে চার ঘণ্টা ড্রাইভ দূরত্বে ভার্জিনিয়ায় থাকে। বড় ভাইয়া ভার্জিনিয়ায় যেখানে থাকে, সেখানে লিভিং কস্ট এক্সপেনসিভ। নিজস্ব গাড়ি ছাড়া যাতায়াতের অন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা সেখানে নেই। পরে ছোট ভাইয়া নিউজার্সিতে যেখানে ছিল, সেখানে নতুন অধিবাসীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বেশি ছিল বিধায় কিছুদিন ছোট ভাইয়ের বাসায় থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। মানে চাকরি পাওয়া পর্যন্ত এবং নিজের একটা বাসা পাওয়া পর্যন্ত।
আমরা যে সপ্তাহে এসেছিলাম, সে সপ্তাহে বৃহস্পতিবার ছিল ৪ জুলাই, আমেরিকার ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে। বড় ভাবি তার পরের দিনও ছুটি নিয়েছে এবং সবাইকে ভার্জিনিয়ায় বেড়াতে যেতে বলেছে। বুধবার রাতে ছোট ভাইয়া কাজ থেকে আসার পর ছোট ভাইয়ের পরিবার আর আমরা সবাই মিলে চলে গেলাম ভার্জিনিয়ায় বড় ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে। বাসায় পৌঁছে দেখি খাবারদাবারের সে এক বিশাল আয়োজন। বড় ভাবি এত কিছু রান্না করেছে যে বলে শেষ করা যাবে না। ডাইনিং টেবিল পুরো ভর্তি লোভনীয় সব খাবারদাবারে। ভাবিদের নিজের বাড়িটা বেশ সুন্দর। বাড়ির পাশে সামনে পেছনে বেশ খোলামেলা জায়গা, পরিবেশটা এত মনোরম যে এসে খুবই ভালো লাগল। বড় ভাই ও ভাবি অনেক বছর আমেরিকায় থাকে। ভাবি অনেক ভালো জব করে। তারা দুজনই মাটির মানুষ। ভাবি এত বছর আমেরিকায় থাকার পরেও এখানে পড়াশোনা করে এখানে ভালো জব করে। কিন্তু তার মধ্যে বিন্দুমাত্র কোনো অহংকার কখনোই দেখিনি।
তারাই আমাদের জন্য স্পন্সর করেছে। আর ইমিগ্রেশনের সব কাগজপত্র ভাবি নিজের হাতে গোছগাছ করে ঠিক করে দিয়েছে। এমনকি আমেরিকায় আসার এয়ার টিকিট পর্যন্ত তারা করে দিয়েছে। যদিও কয়েক বছরের মাথায় আমি ইমিগ্রেশন ও টিকিট বাবদ যা কিছু ভাইয়ার খরচ হয়েছে, তার টাকা পরিশোধ করে দিয়েছি। কিন্তু সবচেয়ে বড় বিষয়, যখন আমার দরকার ছিল, তখন আপন ভাইবোন ছাড়া কে কাকে সাহায্য করে। দিনশেষে দেখা যায়, নিজের রক্ত নিজেকে টানে আর কেউ না।
বড় ভাবি আমাদেরকে অনেক গিফট দিয়েছে। ভাইয়া আবার আমার মেয়ের জন্য কম্পিউটার কিনে দিয়েছে, ছেলের জন্য আইপ্যাড কিনে দিয়েছে। ভাবির ভাই ও বোনেরা তার বাসার আশপাশে থাকে। আমরা এসেছি শুনে তারাও আমাদেরকে দাওয়াত দিয়েছে। তারাও আমাদেরকে অনেক গিফট দিয়েছে। সেই তিন-চার দিন বেশ ভালোই কেটেছে, এবার আবার ছোট ভাইয়ের বাসায় ফিরে যাওয়ার পালা।
নিউজার্সিতে ফিরে আসার পর ছোট ভাইয়া বিভিন্ন অফিসে নিয়ে গেল। স্টেট আইডি বানানোর জন্য, হেলথ ইন্স্যুরেন্সের জন্য অ্যাপ্লাই করতে, সোশ্যাল সিকিউরিটি কার্ড এবং ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য। ভর্তি হওয়ার সময় তারা বাচ্চাদের পরীক্ষা নেয়। মেয়ে ভর্তি হয়ে গেল ক্লাস টেন হাইস্কুলে এবং ছেলে ক্লাস সিক্সে মিডল স্কুলে। শুরু হয়ে গেল আমেরিকায় তাদের স্কুলজীবন। ইতিমধ্যে আমাদের গ্রিন কার্ডের জন্য অ্যাপ্লাই করা হয়েছিল এবং কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আমরা গ্রিনকার্ডও হাতে পেয়ে গিয়েছি। এদিকে ছোট ভাইয়ের পরিচিত বেশ কিছু লোকের সাথে চাকরির ব্যাপারে কথা বলে রেখেছি। অপেক্ষা করছিলাম সোশ্যাল সিকিউরিটি কার্ড আসার জন্য। সোশ্যাল সিকিউরিটি ছাড়া কাজ শুরু করা যাবে না। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সোশ্যাল সিকিউরিটি কার্ড চলে এল এবং আমি ও আমার বর চাকরি শুরু করে দিয়েছি। তিন মাসের মধ্যে আমরা ছোট ভাইয়ার বাসার কাছে একটা বাসা পাই। তখন থেকেই আমাদের হাজব্যান্ড-ওয়াইফ দুজনের চাকরি এবং ছেলেমেয়েদের স্কুল নিয়ে আমাদের জীবন চলতে থাকে দ্রুত গতিতে। এদিকে আমার মেয়ে হাইস্কুলের পড়াশোনার পাশাপাশি উইকেন্ডে পার্টটাইম জব শুরু করে। একদিন কাজে মেশিনের সঙ্গে হঠাৎ হাত লেগে আমার হাজব্যান্ডের হাত কেটে যায়। সে জন্য তাকে বেশ কয়েক মাস কাজ থেকে বিরতিতে থাকতে হয়। সে সময়টা খুব খারাপ কেটেছে, খুব খারাপ লাগত। নিজেকে অনেক অসহায় মনে হতো। আমার নিজের চাকরি আর মেয়ের পার্টটাইমের চাকরি দিয়ে সংসার চালাতে হতো। দেশের কথা তখন খুব মনে পড়ত। অনেক একাকিত্ব আর নিঃসঙ্গতায় ভুগতে হতো।
কুমিল্লা শহরে নিজেদের ছোট্ট একটা বাড়ি ছিল। আমি ব্যাংকে জব করতাম আর আমার বর ছিলেন অধ্যাপক। ছেলেমেয়েরা ভালো স্কুলে পড়াশোনা করতে। সেই ছোট্ট শহরের সেই মানুষের কোলাহল, প্রত্যেক সাপ্তাহিক ছুটির দিন বাসায় আত্মীয়স্বজনদের আসা-যাওয়া। শ্বশুরবাড়ি এবং বাপের বাড়ির লোকজনের আনাগোনা সব সময় বাসায় লেগেই থাকত।
আর এখন আমেরিকার এই ব্যস্ততম যান্ত্রিক জীবনে সবার ব্যস্ততার শেষ নেই। কারও সঙ্গে বসে একটু সুখ-দুঃখের কথা ভাগাভাগি করব, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বেশ কিছুদিন অনেকটা ডিপ্রেশনে ভুগতে হয়েছে আমাকে।
যা-ই হোক, মানুষের জীবন হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, ভাঙা-গড়ার খেলা। কষ্ট আসে, তারপর আবার সুখ আসেÑএভাবেই চলতে থাকে।
তিন বছরের মাথায় মেয়ে হাইস্কুল গ্র্যাজুয়েশন করেছে। এর মধ্যে মেয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্সও পেয়েছে। একটা নতুন গাড়ি তার জন্য নেওয়া হয়েছে। ছেলে মিডল স্কুল শেষ করে হাইস্কুল শুরু করেছে আর মেয়ে শুরু করেছে ইউনিভার্সিটি।
চার বছর কঠোর পরিশ্রম করার পর কিছু টাকা জড়ো করেছি একটা বাড়ি কিনব বলে। আশপাশে বাড়িও দেখা শুরু করেছি। তত দিনে আমি এবং আমার বর দুজনই ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে গাড়ি নিয়েছি। একদিন সকালে হঠাৎ করে কাজে গিয়ে শুনি বাজেট কাট হয়েছে, সে জন্য তারা অনেক কর্মীকে ছাঁটাই করছে। আর সেই লিস্টে আমার নামও ছিল। যদিও প্রথম দিকে খারাপ লেগেছে শুনে, পরে নিজেকে সংযত করে নিয়েছি। বাসায় এসে আন-এমপ্লয়মেন্ট বেনিফিটের জন্য অ্যাপ্লাই করে দিয়েছি। এখানে চাকরি চলে গেলে ছয় মাস পর্যন্ত বেকার ভাতা পাওয়া যায়। কিন্তু হঠাৎ করে চাকরি চলে যাওয়ার কারণে বাড়ি কেনার স্বপ্নটা মনে হয় শুধু স্বপ্নই থেকে গেল।
এদিকে দেশ থেকে একটা সুখবর এসেছে। আমার ছোট বোনের যে এফ ফোর ভিসার কেস ছিল, তাদেরকে এমবাসিতে ইন্টারভিউয়ের জন্য ডেকেছে। কয়েক মাসের মাথায় ছোট বোনের ইন্টারভিউ হয়ে গেল এবং তারা আমেরিকায় আসার ভিসা পেয়ে গেল। যদিও তারা আরও তিন বছর আগে ২০২০-এ আসার কথা ছিল। কিন্তু করোনার জন্য তার কেস তিন বছর পিছিয়ে গিয়েছিল, ২০২৩-এ এসেছে।
ছোট বোন তার বর ও এক ছেলেকে নিয়ে এসেছে। বোনকে নিজের বাসায় রেখেছি বেশ কয়েক মাস, তারা সবাই চাকরি পেয়ে বাসায় পাওয়া পর্যন্ত। এদিকে আমরা এসেছি পাঁচ বছর পার হয়ে গিয়েছে। পুরো পরিবারের সবাই মিলে সিটিজেনশিপের জন্য অ্যাপ্লাই করেছি। কিছুদিনের মধ্যে সেজো ভাই সপরিবারে ভিসা পেয়ে আমেরিকায় এসেছে। তারা এসে ছোট ভাইয়ের বাসায় উঠেছে। এখন আসলে এখানে নিজেদের এত আত্মীয়স্বজন হয়ে গেছে যে সবার সঙ্গে বসে কথা বলার সময় খুঁজে পেতে কষ্ট। আসলে মানুষের জীবনটা এমনই। যেখানে রয়েছে উত্থান-পতন আর সুখ-দুঃখের খেলা।
কিছু কিছু কষ্টের কথা ভুলতে খুব কষ্ট হয়। যখন নিজেরা ড্রাইভিং জানতাম না, গাড়ি ছিল না, তখন শীতের ভোরে আরেকজনের রাইডের জন্য অপেক্ষা করতে হতো। সেই সময়টা খুব বেশি কষ্টের ছিল। যখন দেশে নিজের আপন ভাইবোনদের কথা মিস করতাম, তখন একাকিত্বের যন্ত্রণায় অনেকটা ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলাম, বুকের ভেতর চাপা কষ্ট আর কান্নার কথা বাইরে কারও কাছে কখনো প্রকাশ করতে পারিনি।
ব্যবধান হচ্ছে শুধু সময়ের। একসময় মনে করতাম, আহা, আমেরিকা যদি যেতে পারতাম কোনো একদিন, কত কিছুই না করতে পারতাম। হ্যাঁ, এটা হচ্ছে ল্যান্ড অব অপরচুনিটি, করা সম্ভব, সবকিছুই করা যায়, কিন্তু তার পেছনে লুকিয়ে থাকে না-বলা অনেক দুঃখ-কষ্ট, কান্না-যন্ত্রণা আর হাড়ভাঙা কঠোর পরিশ্রম।
লেখক : কলামিস্ট, মেরিল্যান্ড
 

কমেন্ট বক্স