অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার কিছুদিন পর ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতার সঙ্গে একান্ত বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। ভারতীয় হাইকমিশনারের ইচ্ছা অনুযায়ীই বিএনপির চেয়ারপারসনের গুলশানের কার্যালয়ে তারা আলোচনায় বসেছিলেন। অন্যদিকে গত ২৭ অক্টোবর বিএনপির নেতারা ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মার বাসভবনে একান্ত বৈঠকে বসেন এবং বৈঠক শেষে নৈশভোজে তাদের আপ্যায়িত করা হয়। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী আবদুল আউয়াল মিন্টুর মাধ্যমে বিএনপি নেতাদের বৈঠকের ব্যবস্থা করা হয়। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ড. আবদুল মঈন খান, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও আবদুল আউয়াল মিন্টু বৈঠকে অংশ নেন। এই একান্ত বৈঠক ও নৈশভোজের বিষয়টি উভয় পক্ষই গোপন রাখে।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, ভারতের দিক থেকে বিএনপি ও বাংলাদেশের সঙ্গে উন্নততর সম্পর্ক গড়ে তোলার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সামগ্রিক অবস্থা, আগামী নির্বাচন এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য রাজনীতি এবং সরকার ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ভারতের দিক থেকে আগ্রহ প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশে যে ইতিহাস সৃষ্টিকারী ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান, শেখ হাসিনার দেশত্যাগ ও তার সরকারের পতন প্রভৃতি নিয়ে হাইকমিশনারসহ ভারতীয় কূটনীতিকেরা অত্যন্ত সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। সরকার পরিবর্তনের ঘটনা দুই দেশের সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে না বলেও উল্লেখ করা হয়। দুই দেশের অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক সম্পর্ক অধিকতর বৃদ্ধি এবং জনগণের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলার ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়।
বৈঠকে অংশগ্রহণকারী বিএনপির শীর্ষস্থানীয় এক নেতা নাম গোপন রাখার শর্তে জানান, অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকটি ফলপ্রসূ হয়েছে। বিএনপির দিক থেকে অপরিহার্য পূর্বশর্ত হিসেবে সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যা এবং তিস্তাসহ অভিন্ন নদীগুলোর পানিবণ্টন সমস্যা দূর করতে যত দ্রুত সম্ভব যথাযথ পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। সবার আগে অতি দ্রুত ভিসা চালু করার অনুরোধ করা হয়। বিশেষ করে উল্লেখ করা হয়, বিএসএফ কর্তৃক চোরাচালানের অজুহাতে গুলি করে মানুষ মারা কোনো অবস্থাতেই সমর্থনযোগ্য নয়। ফেলানীকে হত্যা করে তার লাশ কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখা, নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পরও স্বর্ণা নামে এক শিশু ও অপর এক অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার ঘটনা উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, এসব ঘটনা বিএসএফের প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও চরম নিষ্ঠুরতারই প্রকাশ। বিশ্বের অনেক দেশেই সীমান্তবর্তী এলাকায় চোরাচালান হয়ে আসছে। কিন্তু এভাবে মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটে না। প্রাণঘাতী বুলেট ব্যবহার না করার প্রতিশ্রুতি বহুবার ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দেওয়ার পরও মানুষ হত্যা বন্ধ হয়নি। কথাবার্তার একপর্যায়ে ভবিষ্যতে বিজিবি আর পিঠ দেখাবে না বলে সরকারি পর্যায় থেকে ব্যক্ত প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ভারতীয় দিক থেকে হতাশা ও অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। বিএনপি থেকে স্পষ্ট করেই বলা হয়, এটা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষেরই মনোভাব। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক বন্ধুত্বের। কিন্তু সীমান্তে বিএসএফের হত্যাকাণ্ড মেনে নেওয়া যায় না। এ ব্যাপারে মৌখিক প্রতিশ্রুতি না দিয়ে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন দেখতে চায় বাংলাদেশের মানুষ। উল্লেখ্য, বিএনপির নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর এ পর্যন্ত বিএসএফ কর্তৃক সীমান্তে প্রাণঘাতী গুলিবর্ষণ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। তবে সীমান্তবর্তী বাংলাদেশিদের মধ্যে শতভাগ আস্থা আসেনি। কখন তারা আবার নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটায়, এ নিয়ে উদ্বিগ্ন সংশ্লিষ্ট সবাই।
ওই বৈঠকে তিস্তাসহ অভিন্ন নদীগুলোর পানিবণ্টনের ওপর বিএনপির নেতারা গুরুত্ব দেন। দ্রুত তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদন এবং গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি নবায়নের কথা বলা হয়। জানা যায়, ভারতীয় পক্ষ থেকে পানি সমস্যার সুরাহা করা হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভারত কর্তৃক প্রতিশ্রুত সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়নে যথাযথ সময়ে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানানো হয়। চাল, পেঁয়াজ, আলু, ডাল, চিনি, কাঁচামরিচসহ জনজীবনের জন্য জরুরি পণ্য ভারত থেকে বাংলাদেশের চাহিদামাফিক সরবরাহ করার কথাও বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিকসহ দুই দেশের সম্পর্ক ভবিষ্যতে অধিকতর উন্নত হবে বলে দুই পক্ষ থেকেই আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়।
পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে ভারতের অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক ছিল। ভারতের আঞ্চলিক ও জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজনীয় সকল সুযোগ-সুবিধা বাংলাদেশের কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছে ভারত। নতুন করে উল্লেখযোগ্য কিছু নেওয়ারও নেই। ভারত চায় বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধাগুলো যাতে বাংলাদেশ বহাল রাখে। সামনে নির্বাচিত সরকারের ভূমিকা বৈরী হয় কি না- সে ব্যাপারে চিন্তিত ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আগামীতে কারা ক্ষমতায় আসতে পারে প্রভৃতি বিষয় ভারতের গভীর পর্যবেক্ষণে রয়েছে। আওয়ামী লীগ ও তার নেত্রী শেখ হাসিনার ব্যাপারে তারা দৃশ্যমানভাবে খুব একটা চিন্তিত নয়। নিতান্ত কৃতজ্ঞতা, সৌজন্য হিসেবে মানবিক কারণে জীবনরক্ষায় শেখ হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ভারতের জনগণ ও রাজনৈতিক দলসমূহ থেকেই এ ব্যাপারে সরকারের ওপর প্রচণ্ড চাপ ছিল। শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে হস্তান্তরের কথা ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ভাবছে না বলেই আভাস পাওয়া যায়।
আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ভারত সরকারের জন্য সবচেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয়। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা নতুন করে সক্রিয় হতে পারে, তাদের কাছে অত্যাধুনিক অস্ত্র আসতে পারে- এমন আশঙ্কা প্রবলভাবেই রয়েছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে নতুন করে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে উচ্চমাত্রায় সতর্ক রাখা হয়েছে। জানা যায়, বিএনপি থেকে এ ব্যাপারে ভারত সরকারকে সব রকম, সর্বোচ্চ সহযোগিতার পূর্ণ আশ্বাস দেওয়া হয়। লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানের সঙ্গে ভারতীয় কূটনীতিকের একান্তে কথা বলারও ব্যবস্থা করা হয় বলেই জানা যায়। এ ব্যাপারে ভারতের মধ্যে কোনো রকম দ্বিধা, সংশয় না রাখার একান্ত অনুরোধ করা হয়। অদূর ভবিষ্যতে ভারতের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব, সুপারিশ বিশেষ বিবেচনায় নেওয়ার কথাও জানানো হয়।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর থেকে এ পর্যন্ত বিএনপি ভারত সরকার, তার অতীতের আধিপত্যবাদী ও কর্তৃত্ববাদী আচরণ সম্পর্কে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা থেকে সতর্কে বিরত রয়েছে। তবে স্থানীয় বা দীর্ঘমেয়াদে উন্নত সম্পর্কের বিষয়টি নির্ভর করবে সীমান্ত হত্যা বন্ধ করাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারতের মনোভাব ও কার্যকলাপের ওপর।
আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির জয়লাভের ব্যাপারে ভারতের কাছে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য রয়েছে। যে কারণেই তারা বিএনপির সঙ্গে দ্রুত উন্নত সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। বিগত সময়ে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালেও ভারতের সঙ্গে তাদের সুন্দর সম্পর্ক ছিল। এই সম্পর্ককে অধিকতর উচ্চ পর্যায়ে নিতে চায় তারা। ভারত সরকার এবং সে দেশের সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহও প্রবলভাবে পাকিস্তান ও পাকিস্তানপন্থী কোনো রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের বিরোধী। জামায়াতে ইসলামীকে তারা পাকিস্তানপন্থী এবং পাকিস্তানের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক দল মনে করে। ভারত জামায়াতকে কোনো অবস্থাতেই মেনে নিতে পারছে না। যদিও ভারতের সঙ্গে দূরত্ব ঘোচাতে, আস্থাহীনতা দূর করতে জামায়াত নানাভাবে চেষ্টা করছে।