অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে নতুন নিয়োগ পাওয়া তিন উপদেষ্টার মধ্যে ব্যবসায়ী সেখ বশির উদ্দিন ও চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে নিয়ে
নানা আলোচনা ও বিতর্ক হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে। পাশাপাশি চলছে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন। তাদের অপসারণের দাবিতে ও নতুন করে উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠনের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষও। কেউ কেউ উপদেষ্টা বাছাইয়ে ‘অঞ্চল প্রীতির’ অভিযোগও তুলেছেন।
১০ নভেম্বর রোববার সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বঙ্গভবনের দরবার হলে শপথ পড়ান নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত তিন উপদেষ্টাকে। তারা হলেন ব্যবসায়ী সেখ বশির উদ্দিন, চলচ্চিত্র পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম। তাদের মধ্যে ফারুকী ও সেখ বশিরকে নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত বিভিন্নজনের অভিযোগ, এদের উপদেষ্টা করা গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, আওয়ামী লীগের অনুগত ব্যক্তিরা উপদেষ্টা পদে আসছেন। আবার ছাত্রহত্যার আসামিও উপদেষ্টা পদে শপথ নিয়েছেন, যা ২ হাজার শহীদ ও ৩০ হাজার আহত পরিবারের আকাক্সক্ষার বিপরীত। শিক্ষার্থীরা বলছেন, এভাবে অদৃশ্য সিগন্যালে ছাত্র-জনতাকে না জানিয়ে যদি একের পর স্বৈরাচারের অনুগতদের পুনর্বাসন করা হয়, তাহলে যারা বঙ্গভবনে বসে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, শিগগিরই তাদের বিরুদ্ধেও আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন, ধানমন্ডি ৩২-কে যারা কাফেলা মনে করে, তাদের উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ‘খুনি হাসিনার তেলবাজরাও উপদেষ্টা হচ্ছে’-এমন অভিযোগ করে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে চলচ্চিত্র পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে অন্তর্ভুক্ত করায় উদ্বেগ প্রকাশ করে নিন্দা জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। সংগঠনটির ঢাকা মহানগর সভাপতি মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব ও সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মামুনুল হক এক বিবৃতিতে বলেন, তিনি (মোস্তফা সরয়ার ফারুকী) শাহবাগীদের দোসর। তিনি হেফাজতের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে (রহ.) তেঁতুল হুজুর বলে ব্যঙ্গ করেছিলেন, যা ক্ষমা করা যায় না। তাকে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়ায় হেফাজত তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়।
সেখ বশির উদ্দিন আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি সেখ আফিল উদ্দীনের ভাই ও রামপুরা থানার একটি হত্যা মামলার আসামি-এমন তথ্যও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক মাধ্যমে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সোহান শাহ নামে (৩০) এক যুবককে গুলি করে হত্যার ঘটনায় করা মামলায় আসামির তালিকায় নাম রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হওয়া ব্যবসায়ী সেখ বশির উদ্দিনের। ‘শেখ বশির উদ্দিন ভূঁইয়া’র নামের সঙ্গে শুধু একটি বর্ণের অমিল রয়েছে। সেখ বশিরের বাবার নামের সঙ্গে আসামির তালিকায় থাকা ‘শেখ বশির উদ্দিন ভূঁইয়া’র বাবার নামের আংশিক মিল রয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, ‘শেখ বশির উদ্দিন ভূঁইয়া’ নাম দিয়ে সেখ বশির উদ্দিনকে আসামি করা হয়েছে কি না। বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন। তিনি বলেছেন, নামের আংশিক সংগতি ও অসংগতি থাকলেও তিনি নিশ্চিত নন মামলাটি তার নামে হয়েছে কি না। তিনি আরও বলেন, ‘যারা আন্দোলন করছেন, তাদের আবেগের সঙ্গে আমার দ্বিমত নেই। তবে আমার ধারণা, ওনারা মিস ইনফরমড (ভুল তথ্য পাওয়া)। ওনাদের তথ্যের ভিত্তি সঠিক নয়।’ অন্যদিকে পুলিশ বলছে, শেখ বশির উদ্দিন ভূঁইয়া ও সেখ বশির উদ্দিন একই ব্যক্তি কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মামলার বাদী নিহত সোহান শাহর মা সুফিয়া বেগম সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও পুলিশ তার ছেলে হত্যার জন্য দায়ী।
অন্যদিকে উপদেষ্টা পরিষদে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর নাম ঘোষণার পর থেকেই শেখ হাসিনাবিরোধী আন্দোলনের সংগঠক ও সমর্থকেরা ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুরু করেন। তারা ফারুকীর নিয়োগকে ‘আওয়ামী লীগ পুনর্বাসন’ হিসেবে বর্ণনা করেন। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বিভিন্ন সময় তার লেখায় ও ফেসবুক পোস্টে শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার প্রশংসা করেছেন। গত ১৫ বছর প্রিয়ভাজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের। এই সুবাদে সরকারের বিভিন্ন সুবিধাও নিয়েছে তিনি। শুধু তিনি নন, তার স্ত্রী অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশাও নিয়েছেন নানা সুবিধা। ফারুকীর উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।
এ বিষয়ে সচিবালয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রথম দিন যোগ দিয়ে সাংবাদিকদের এক ব্রিফিংয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় কুরুচিপূর্ণ তথ্য শেয়ারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার শিল্প-সংস্কৃতি চর্চায় বাধা হবে না। তবে যারা শিল্পচর্চা করছে, তাদেরও সচেতন হতে হবে। কুরুচিপূর্ণ, জঘন্য তথ্য যদি সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেন, তাহলে সমস্যা হবে। বিপ্লবের চেতনা বুঝতে হবে। নাটক হচ্ছে, যাত্রা হচ্ছে, কেউ তা বন্ধ করেনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিগত সরকারের সুবিধাভোগী হিসেবে যা বলা হচ্ছে, এ বিষয়ে কিছু বলার নেই। ২০১৩ সালে আমাকে বলা হতো জামায়াত-শিবির। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে তখন বলেছিলাম, এই চেতনা দিয়ে কী করব। সে সময় আমাকে শিবির বলা হয়েছিল। কেউ মনে করে জামায়াতি, কেউ বিএনপি, কেউ আওয়ামী লীগ। কিন্তু আমি কারও লোক নই। আমি আমার। আমি কারও প্রতি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দিইনি।’