Thikana News
২১ নভেম্বর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

২০২৪ সালের আমেরিকার নির্বাচন

ট্রাম্পের অসংলগ্ন কথার ওপর মানুষের বিশ্বাসে ভাটা পড়ে গিয়েছিল। তার ওপর অনেকগুলো হাই লেভেলের কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি ও কোর্ট-কাছারিতে নানা মামলা-মোকদ্দমা এবং আর্থিক নানা জটিলতায় তার ওপর মানুষের বিশ্বাস কমে গিয়েছে বলে সবার মনে হয়েছিল
২০২৪ সালের আমেরিকার নির্বাচন
(পর্ব-১)
গত ইলেকশনের মতো এবারও আমি ও আমার প্রতিবেশী দুজনে মিলে একই গাড়িতে করে ভোট দিতে গিয়েছিলাম। ভেতরে ঢুকে আমরা একই হলের পাশাপাশি দুই ব্যালট বক্স ব্যবহার করেছি। তবে বেরিয়ে এসে দেখলাম, আমি ভোট দিয়েছি বটে, কিন্তু ও দিয়েছে ‘ওট’। হা হা, উর্দু বনাম বাংলা জবান! জোক বাদ দিয়ে এখন একটু সিরিয়াস হওয়ার চেষ্টা করি।
বাড়িতে ফিরে টিভির ভেতরে চোখ ঢুকিয়ে মিনিট-বাই-মিনিট নির্বাচনের ফলাফল দেখে চলেছি। সবার ধারণা ডেমোক্র্যাট প্রার্থীই জিতবে। কারণ, প্রথমত, ডেমোক্র্যাটরা লিবারেল। সাধারণ্যে তাদের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। দ্বিতীয়ত, কমলা হ্যারিস প্রার্থী হিসেবে অনন্যা। তিনি শুধু একজন নারী প্রার্থীই নন, আমেরিকার ইতিহাসে রাজনীতিতে সর্বপ্রথম কোনো পার্টির সর্বোচ্চ পদপ্রার্থী একজন কৃষ্ণবর্ণা নারী। তার মা শ্যামলা গোপালন দক্ষিণ ভারতের চেন্নাই থেকে আসা একজন ব্রেস্ট ক্যান্সার রিসার্চার। তার বাবার নাম ডোনাল্ড যে হ্যারিস। ১৯৬৪ সালে তার জন্মের তিন বছর পর ছোট বোন মায়ার জন্ম হয়। ১৯৭২ সালে মা-বাবার ডিভোর্স হলে সংসারের দায়িত্ব মায়ের ওপরে গিয়ে পড়ে। ২০০৯ সালে ৭০ বছর বয়সে তিনি নিজেই কোলন ক্যান্সারে মারা যান। ধর্মের দিক থেকে শ্যামলা হিন্দু হিসেবে বেড়ে ওঠেন। কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে আসার পর তার দুই সন্তান কমলা ও মায়াকে তাদের প্রতিবেশী রেজিনা শেলটন নামের এক ভদ্রমহিলা ‘চার্চ অব গড’ নামে এক চার্চে নিয়ে যেতেন। বড় হয়ে হ্যারিস ‘থার্ড ব্যাপটিস্ট চার্চ অব সান ফ্রান্সিসকো’তে যোগদান করেন।
অন্যদিকে লস অ্যাঞ্জেলেস শহরে ডগলাস এমহফ নামের এক ইহুদি কৌঁসুলি, যিনি নিউজার্সিতে প্রথমে বেড়ে ওঠেন, তিনি ‘রিফর্ম সিনাগগ’ নামে ইহুদিদের এক আধুনিক প্রার্থনালয়ে যেতেন। তিনি কমলার সঙ্গে যখন দার পরিগ্রহ করেন, তখন তাদের বাড়িতে ‘ফেস্টিভাল অব লাইট’ বা দীপাবলি হতো দুই ধর্মের দিক থেকেÑইহুদিদের দিক থেকে হানুকা এবং হিন্দুধর্মের দিক থেকে দিওয়ালি। এ ছাড়া ছোটবেলায় ব্যাপ্টিস্ট চার্চে যাওয়া বাবদ খ্রিষ্টধর্মের প্রভাব তার ওপর তো ছিলই। কাজেই কমলার মধ্যে হিন্দু, খ্রিষ্টান ও ইহুদিÑএই তিন ধর্মের একটা ফার্স্টহ্যান্ড প্রভাব, মিশ্রণ, এমনকি এক অপূর্ব সমন্বয় ছিল। এ পর্যন্ত যত আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, তারা সবাই খ্রিষ্টান। সেদিক থেকে দেখলে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী এই কমলা হ্যারিস ছিলেন শংকর ধর্মে মোড়া একজন ‘ইউনিক ক্যান্ডিডেট’।
অন্যদিকে ট্রাম্পের অসংলগ্ন কথার ওপর মানুষের বিশ্বাসে ভাটা পড়ে গিয়েছিল। তার ওপর অনেকগুলো হাই লেভেলের কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি ও কোর্ট-কাছারিতে নানা মামলা-মোকদ্দমা এবং আর্থিক নানা জটিলতায় তার ওপর মানুষের বিশ্বাস কমে গিয়েছে বলে সবার মনে হয়েছিল। তা ছাড়া আরও কিছু জটিল ব্যাপার চতুর্দিক থেকে জড়ো হয়েছিল। যেমন হোয়াইট সুপ্রিমেসিস্ট গ্রুপ, আলট্রা কনজারভেটিভ গ্রুপ, সাদার্ন ব্যাপ্টিস্টস, বিত্তবান ও অত্যন্ত প্রভাবশালী ইহুদিবাদী গ্রুপ আইপ্যাক, বর্ণবাদ-বৈষম্যে নির্যাতিত গ্রুপ, মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধপন্থী ও যুদ্ধবিরোধীদের বিরাট এক গ্রুপ, বিশেষ করে মিশিগান স্টেটের আরব গ্রুপ ও তাদের সমব্যথী অনেক মুসলিমের একটা গ্রুপ ইত্যাদি।
এদিকে আবার ধর্মের দিক থেকে মুখোমুখি দুই দলের মধ্যে অনেকটা মিলও আছে। যেমন ট্রাম্প ও তার স্ত্রী খ্রিষ্টান হলেও তার জামাই (এবং সম্ভবত মেয়েও) জুইশ। অন্যদিকে কমলা মোটামুটি খ্রিষ্টান হলেও যেন অনেকটা হিন্দু-ইহুদি মেশানো। তার স্বামী হলেন জুইশ। তাই হ্যারিসের স্বামী ইহুদি হওয়ায় আরব-প্যালেস্টাইন গন্ডগোলের একটা চিরস্থায়ী সুরাহা বা আপাতত অন্তত একটা সিজফায়ারের কোনো আশা কেউ দেখতে পাচ্ছিল না। এ অবস্থায় এই ভোটের অনেক তাৎপর্য আছে মনে হয়েছে। শেষ কথা হলো, এই ভোট অন্যান্য দেশের ভোট সিস্টেমের সঙ্গে তুলনীয় নয়। কারণগুলো একটু গভীরে গিয়ে ভেবে দেখলে এ রকম দাঁড়ায় :
জনগণ মানে আমরা যে ভোটটা দিয়ে এলাম, যেটা আমাদের দেশেও আছে, তার নাম হলো পপুলার ভোট। এতে জিতলে হারলে এ দেশে কিছু আসে যায় না। আসল যেটা, সেটার নাম হলো ইলেকটোরাল ভোট। প্রতিটি স্টেটের জন্য পপুলেশন অনুযায়ী ইলেকটোরাল ভোট আছে। মোদ্দা কথা, যাদের বড় স্টেট, যাদের পপুলেশন বেশি, তাদের ইলেকটোরাল ভোটও বেশি। এসব স্টেটে যারা জিতবে, তাদেরই ভোটে জিতে যাওয়ার সম্ভাবনা। তাদের বেশির ভাগ স্টেটে জয়ী না হলেও চলবে। কারণ অনেক ছোট ছোট স্টেট আছে। আবার অনেক বড় স্টেটও আছে, যাদের জনসংখ্যা কম। তাই ইলেকটোরাল ভোটও কম।
ব্যাপারটা আরেকটু পরিষ্কার করা যাক। ইলেকটোরাল কলেজ হলো প্রেসিডেন্ট কি পপুলার বা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন, না কংগ্রেসের ভোটে নির্বাচিত হবেন, এই দুটো রাস্তার একটা কম্প্রোমাইজ বা আপস ব্যবস্থা। ইলেকটোরাল কলেজে মোট ৫৩৮ জন ইলেকটর আছেন, মানে এদিকে ২৬৯ জন তো অন্যদিকে ২৬৯ জন। এখন যে দল অন্তত ২৭০টি ইলেকটোরাল কলেজের ভোট পাবে, সে পার্টিই জিতবে। পপুলার বা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে যারাই এগিয়ে থাকুক না কেন, কোনো ম্যাটার করবে না। ইলেকটোরাল ভোটই আসল।
এই নম্বরটা কী করে ঠিক করা হয়? প্রকৃত ব্যাপারটি হলো, এ দেশের একটা খুব ভালো নিয়ম আছে। যত বড় বা যত ছোটই হোক, সিনেটের জন্য প্রতিটি স্টেট থেকে দুজন করে সিনেটর থাকবেন। সেদিক থেকে দেখতে গেলে যে যত স্টেট জিতবে, তারই ভোটে জেতার কথা তো?
অত সোজা নয়, চান্দু। এই দুজন করে সিনেটর কেবল সিনেট হাউস থেকে আসে। এটা ইন্ডিয়ার রাজ্যসভার মতো। কিন্তু কংগ্রেস হলো দুটো হাউস নিয়ে। অন্য হাউসটার নাম হলো হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস। অনেকটা ইন্ডিয়ার লোকসভার মতো। এই হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ থেকে একেকজন হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভের জন্য একেকটা ইলেকটোরাল ভোট থাকে। কাজেই স্টেট বড় হোক বা ছোট হোক, স্টেট-প্রতি দুজন করে সিনেটর থাকবে। সিনেট ভোট মাত্র দুটো করে হলেও হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস যে স্টেট যত বড় তাদের রিপ্রেজেন্টেটিভও তত বেশি হয়। একেকজন রিপ্রেজেন্টেটিভের একটি করে ইলেকটোরাল ভোট থাকে। তার মানে যে স্টেটের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ যত বেশি, সেই স্টেটের ইলেকটোরাল ভোটও তত বেশি হয়। এই গন্ডগোলের ব্যবস্থাটা আজ নয়, সেই ১৮২৪ সালে শুরু হয়েছিল। নানা মামলা-মোকদ্দোমা করেও এই ব্যবস্থা থেকে রেহাই পাওয়া যায়নি।
এ পর্যন্ত পাঁচটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে (১৮২৪, ১৮৭৬, ১৮৮৮, ২০০০ ও ২০১৬) জনপ্রিয় ভোটে বিজয়ী প্রার্থী সরাসরি ইলেকটোরাল ভোটে হেরে গিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে আছেন অ্যান্ড্রু জ্যাকসন, যিনি ১৮২৪ সালে পপুলার ভোটে জিতেছিলেন, কিন্তু ইলেকটোরাল ভোটে জন কুইন্সি অ্যাডামসের কাছে হেরে যান।
এরপর ১৮৭৬ সালে ডেমোক্র্যাট স্যামুয়েল টিলডেন রিপাবলিকান রাদারফোর্ড হেজের কাছে হেরে যান।
১৮৮৮ সালে ডেমোক্র্যাট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড ও রিপাবলিকান বেঞ্জামিন হ্যারিসনের মধ্যে একই অবস্থা দাঁড়ায়। ক্লিভল্যান্ড সাউথ স্টেট ঝেঁটিয়ে ৯০ হাজারের বেশি পপুলার ভোট পেলেও বেঞ্জামিন হ্যারিসন ২৩৩-১৬৮ ইলেকটোরাল ভোটে জিতে যান।
এরপর আমাদের কাছাকাছি যুগে, ২০০০ ও ২০১৬ সালে একই ধরনের ঘটনা ঘটে।
২০০০ সালে ডেমোক্র্যাটিক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর রিপাবলিকান ক্যান্ডিডেট জর্জ বুশের থেকে ৫ লাখেরও বেশি পপুলার ভোট পান। কিন্তু ইলেকটোরাল ভোট গণনার পর ফ্লোরিডার সেক্রেটারি অব স্টেট ক্যাথরিন হ্যারিস প্রকাশ করেন যে বুশ ৫৩৭ ভোটে জিতে গেছেন।
সবশেষে ২০১৬ সালের নির্বাচনে আসি। ৮ নভেম্বরের ইলেকশনে রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প ডেমোক্র্যাট হিলারি ক্লিনটনের কাছে ২.৮ মিলিয়নের বেশি পপুলার ভোটে হেরে যান। কিন্তু ট্রাম্প ৩০টি স্টেট থেকে ইলেকটোরাল কলেজের ভোট পান ৩০৪টি, যেখানে ক্লিনটন পান মাত্র ২২৭টি ইলেকটোরাল কলেজের ভোট এবং এভাবেই ট্রাম্প আমেরিকার ৪৫তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
যাক, যে কথা বলছিলাম। ভেবেছিলাম, কমলা সমান সমান বা একটু কম পপুলার ভোট পেলেও ইলেকটোরাল ভোট যখন গণনা হবে, তখন কমলা হ্যারিসই জিতে যাবেন। কিন্তু ভোটের আধাআধি সময়ের পর থেকে দেখা গেল, অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কমলা হ্যারিস সন্দেহাতীতভাবে হেরে গেলেন। শেষমেশ দেখা গেল, ট্রাম্প পেয়েছেন ৩১২ ভোট আর কমলা পেয়েছেন ২২৬ ভোট। অনেক ব্যবধান!
(নোট : পর্ব-২-তে বিশ্লেষণ করা হয়েছে : ‘যেভাবে অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তন করলেন ট্রাম্প’)

 

কমেন্ট বক্স