Thikana News
২১ নভেম্বর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

ভূমিধস বিজয়ী আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প

মিডিয়া জনমত জরিপ এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতে সব সময় দেখানো হয়েছিল, কমলা হ্যারিস সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে বা সমান সমান। কিন্তু ভোটের ফলাফল হলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ বিশেষজ্ঞরা ছিলেন পক্ষপাতদুষ্ট। সাধারণ মানুষের সঙ্গে নির্বাচনের আগেই আলাপ করে জানা গিয়েছিল, এবার প্রচুর মানুষ ট্রাম্পকে ভোট দেবে।
ভূমিধস বিজয়ী আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
গত ৫ নভেম্বর টানটান উত্তেজনা ও উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হলো আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন।
১৮৯২ সালে প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ডের মতো বিগত নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর হাল না ছেড়ে এবারের নির্বাচনে ১২০ বছর পর দ্বিতীয়বারের মতো আমেরিকার ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এবারের বড় অর্জন হলো হাউস ও সিনেট উভয়েই রিপাবলিকান পার্টি বিজয়ী হয়েছে। সুতরাং ধরে নেওয়া যায়, আগামী চার বছর প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প জনগণ ও দেশের জন্য যদি কাজ করতে চান, তবে কোনো বাধা থাকবে না।
কিন্তু ২০২০ সালের নভেম্বরের নির্বাচনে তিনি জো বাইডেনের কাছে ৭০ লাখ ভোটের ব্যবধানে হেরে যান। যদিও তার প্রতিদ্বন্দ্বীর এই বিজয়কে তিনি মেনে নিতে পারেননি। তিনি ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ওয়াশিংটনে তার সমর্থকদের নিয়ে সমাবেশ করেন এবং তিনি ক্রমাগত ভোট চুরি ও জালিয়াতির অভিযোগ করেন। এই সমাবেশ একপর্যায়ে দাঙ্গায় রূপ নেয়। তার উগ্র সমর্থকেরা যেভাবে ক্যাপিটল হিলে আক্রমণ করে, তা ছিল আমেরিকার ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। শুধু তা-ই নয়, আমেরিকার ইতিহাসে কোনো প্রেসিডেন্টকে এই প্রথম ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে বিগত বছরে আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছে। ব্যতিক্রমী চরিত্রের কারণে আমেরিকার মিডিয়ায় ছিলেন সব সময় সরব।
আমেরিকানদের মতো সারা পৃথিবীর চোখ ছিল এবারের নির্বাচনের প্রতি। কারণ সারা দুনিয়ায় যুদ্ধোন্মাদনা, অস্থিরতা, অর্থনীতি, জলবায়ুসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে আমেরিকা নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। সুতরাং বিশ্ব রাজনীতির ক্ষেত্রে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের গুরুত্ব অপরিসীম।
যদিও এবারের নির্বাচনে মিডিয়া জনমত জরিপ এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতে সব সময় দেখানো হয়েছিল, কমলা হ্যারিস সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে বা সমান সমান। কিন্তু ভোটের ফলাফল হলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ বিশেষজ্ঞরা ছিলেন পক্ষপাতদুষ্ট। সাধারণ মানুষের সঙ্গে নির্বাচনের আগেই আলাপ করে জানা গিয়েছিল, এবার প্রচুর মানুষ ট্রাম্পকে ভোট দেবে। যার অনেক কারণ ছিল। যেমন গত চার বছরে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, চাকরির বাজার ভালো নেই। জিনিসপত্রের দামও বেড়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যয়ভার মার্কিনিদের ঘাড়ে। বিশেষ করে, গত ১৩ মাস ধরে ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচারে গাজায় গণহত্যার পেছনে সবাই মনে করে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। বাইডেন প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিশ্বের খ্যাতিমান বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এবং বিভিন্ন শহরে ব্যাপকভাবে আন্দোলন ও সংগ্রাম হয়েছে। ইহুদি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মতো আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকেও দোষী মনে করে সবাই। বিশ্বে ইসরায়েলিদের সঙ্গে জো বাইডেন এবং আমেরিকার ইমেজ প্রশ্নের সম্মুখীন। সুতরাং গাজায় নিরীহ ৪৫ হাজার নারী, শিশু, পুরুষ হত্যা ও লক্ষাধিক আহত মানুষ এবং সমস্ত গাজা ধ্বংসের দায় বাইডেন প্রশাসন এড়াতে পারে না। যে কারণে আমেরিকার মুসলিম কমিউনিটি এবার ছিল ক্ষুব্ধ। মিশিগানের মুসলিম ভোটাররা প্রকাশ্যে ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়ে কাজ করেন। অন্যান্য রাজ্যের ভোটের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। তা ছাড়া অবৈধভাবে গত চার বছরে বর্ডার দিয়ে যেভাবে লাখ লাখ মানুষ আমেরিকায় ঢুকেছে; হোটেল, মোটেল, স্কুল বন্ধ দিয়ে তাদের স্থান সংকুলানসহ তাদের খরপোষ দিতে হয়েছে, যা এ দেশে তার সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
এ ছাড়া একজন সাবেক প্রেসিডেন্টকে কোর্টের দ্বারে দ্বারে ঘোরানোর বিষয়টি মিডিয়া ব্যাপকভাবে প্রচার করায় আমেরিকার অনেক মানুষের সহানুভূতি ট্রাম্পের প্রতি বেড়ে যায়। সর্বোপরি অনেকে মনে করেন, বাইডেন প্রশাসন বিগত চার বছর অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, দৃঢ়তার সঙ্গে দেশ চালাতে সফল হননি। সে জন্যই জুনের দিকে সাংবাদিক ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুখোমুখি হয়ে জো বাইডেন প্রশ্নবাণে জর্জরিত হলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে শারীরিক অবস্থা, বয়স ইত্যাদি বলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন থেকে সরে গিয়ে কমলা হ্যারিসকে সমর্থন দেন। কিন্তু তার চিন্তা করা উচিত ছিল, আমেরিকান ভোটাররা একজন নারী ও কৃষ্ণাঙ্গকে প্রেসিডেন্ট করতে রেডি আছে কি না? যেহেতু এর আগে হিলারি ক্লিনটনও পরাজিত হয়েছেন। তার ওপর নির্বাচনের বাকি ছিল মাত্র তিন-চার মাস। এই সময়টা ছিল আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য খুবই কম সময়। অন্যদিকে ট্রাম্পের প্রচার চলছিল গত চার বছর যাবৎ এবং তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে বাইডেন প্রশাসনের দুর্বল দিকগুলো তুলে ধরেন। ট্রাম্প আগের সেই জাতীয়তাবাদী স্লোগান ‘আমেরিকা ফাস্ট, গ্রেট আমেরিকা মেক অ্যাগেইন’ ইত্যাদি দিয়ে কিছু কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দেন। যেমন তিনি নির্বাচিত হলে অবৈধভাবে প্রবেশের পথ বন্ধে প্রথম পদক্ষেপ নেবেন। বৈধভাবে যারা আসবেন, তারা এ দেশের জন্য বোঝা না হয়ে দেশের সম্পদ হিসেবে কাজ করবেন। প্রয়োজনে তার গত প্রশাসনের ৩১৪৫ কিলোমিটার লম্বা অসমাপ্ত দেয়াল নির্মাণের কাজ সমাপ্ত করবেন। ১০ হাজারের অধিক নতুন বর্ডার পেট্রোল এজেন্ট নিয়োগ দেওয়ারও পরিকল্পনা আছে। আগে যেভাবে মেক্সিকো বা অন্য কোনো বর্ডার দিয়ে অবৈধভাবে লোক প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে সেই দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হতো, রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার সুযোগ দেওয়া হতো না, ঠিক এ কাজই করা হবে। অর্থাৎ ‘মেক্সিকোতেই থাকুন’Ñএই নীতি প্রয়োগ করা হবে।
অভিবাসন নীতির মধ্যে তিনি তার নির্বাহী আদেশ দিয়ে কোনো অবৈধ নাগরিকের সন্তান যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নিলে জন্মসূত্রে সন্তানের যে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়, সেই বিধান বাতিল করবেন। শুধু বৈধ পিতা-মাতার সন্তান (যাদের গ্রিন কার্ড আছে বা সিটিজেন) তাদের সন্তানেরা নাগরিকত্ব পাবেন। এই আইন বাস্তবায়িত হলে এ দেশে জন্ম নেওয়া লাখ লাখ শিশু নাগরিক অধিকার হতে বঞ্চিত হবে। এই নির্বাহী আদেশ সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীর সরাসরি লঙ্ঘন। এ নিয়ে ইতিমধ্যেই সমাজে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধের শুরু থেকেই ট্রাম্প কড়া সমালোচক। তিনি অভিযোগ করেন, এই যুদ্ধে ইউক্রেনকে সহায়তার মধ্য দিয়ে ব্যয়ভার আমেরিকার জনগণ বহন করছে। সুতরাং তিনি নির্বাচিত হলে ইসরায়েল-গাজাসহ সকল যুদ্ধ বন্ধের পদক্ষেপ নেবেন। ট্রাম্পের এই ঘোষণায় শান্তিপ্রিয় মানুষের মনে আশার সঞ্চার সৃষ্টি হয়েছে।
বাইডেন প্রশাসনের উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনবেন ট্রাম্প। নতুন চাকরির বাজার সৃষ্টি, কর ও শুল্কের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবেন। বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে বেশির ভাগ বিদেশি পণ্যের ওপর ১০% শুল্ক এবং চীন থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে ৬০% কররোপ করবেন। দেশীয় গাড়িশিল্পকে সহায়তা করতে সমস্ত বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করবেন। তিনি জাতীয় গর্ভপাত নিষেধাজ্ঞা আইনে স্বাক্ষর করবেন না। গর্ভপাত নিষিদ্ধের পক্ষে নন। তিনি মনে করেন, গর্ভপাত ইস্যু আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে রাজ্যেগুলোর সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
২০২১ সালে ক্যাপিটল হিলে সহিংসতা হামলার মামলায় অভিযুক্ত দোষী সাব্যস্তকারীদের সাধারণ ক্ষমা করবেন।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চীন, রাশিয়া, ভারত মিলে আমেরিকার বিপরীতে যে বলয় সৃষ্টি করেছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে ভারতকে কাছে টানার চেষ্টা করবেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের গত শাসনামলে প্যারিস চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করেছিলেন। সে নীতিতে এখনো অটল। কিন্তু জলবায়ু বিধিনিষেধ শিথিল করবেন।
বাংলাদেশের ব্যাপারে রিপাবলিকান পার্টি ইতিমধ্যেই নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছে। তারা এ ব্যাপারে বেশি কিছু না-ও করতে পারে। আমেরিকার এই অভিমতের কারণে নরেন্দ্র মোদি এ ব্যাপারে যথেষ্ট প্রভাব খাটাতে পারেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘুদের নিয়ে ট্রাম্প টুইট করেছেন। তিনি হয়তো এ দেশের সংখ্যালঘু লবিস্টদের মাধ্যমে খবর পান। এর আগেও আওয়ামী লীগের শাসনামলে প্রিয়া সাহা নামের এক নারীকে ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ করতে দেখা যায়। তখন বলা হয়েছিল, জামায়াত, বিএনপি এবং ভারতীয় লবিস্ট দিয়ে তা করানো হয়েছে। এখনো নির্বাচনের এই ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের দেশের এই ইস্যু নিয়ে ট্রাম্প টুইট করলেন। এর মধ্যেও কোনো অদৃশ্য হাতের ছোঁয়া থাকতে পারে বলে সচেতন মহল মনে করেন।
পরিশেষে আমরা আমেরিকার নাগরিক হিসেবে প্রত্যাশা করি, যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও সুন্দরভাবে সমাপ্ত হয়েছে। নির্বাচনে জয়-পরাজয় থাকবেই। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী কমলা হ্যারিস নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং দেশে আগামী চার বছর নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে সুন্দরভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেন। এটাই হলো গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। জাতীয় প্রশ্নে এ ধরনের সংহতি বজায় থাকলে দেশ ও জাতি অবশ্যই এগিয়ে যাবে। আমরাও কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, দেশ ও জাতির উন্নয়নে এবং বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় পৃথিবীর বৃহৎ শক্তিধর দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবেন। ২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারি ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথের পর দৃশ্যমান হবে ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনের সময় দেওয়া জনগণের সঙ্গে ওয়াদা কতটুকু পালন করছেন। আমরা মহামান্য প্রেসিডেন্টের সর্বাঙ্গীণ সফলতা কামনা করি।
লেখক : কলামিস্ট ও রাজনীতিক
 

কমেন্ট বক্স