বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের একটা বিরাট অবস্থান রয়েছে। বাংলা সাহিত্যের সম্প্রসারণে কল্লোল যুগের লেখকদের হাত ধরে বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্প বেগবান হয়ে ওঠে। তিরিশ ও চল্লিশের দশকের লেখকদের মাধ্যমে সেটির পরিপুষ্টতা প্রকাশ পায়। পঞ্চাশের দশকে বাংলা ছোটগল্প ও কথাসাহিত্যের পটপরিবর্তন ঘটে। যদিও পরবর্তী চার দশকে বাংলা ছোটগল্প মানদণ্ড থেকে দূরে সরে যায়। ছোটগল্পের সংজ্ঞায়ন ও বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, পাঠককে গল্পের ছন্দময়তার আস্বাদনে মাতিয়ে রাখা এবং অন্তহীন জিজ্ঞাসা, অতৃপ্ত পিপাসা ও কৌতূহলী করে তোলা।
বাংলা ছোটগল্পের সার্থক স্রষ্টা হলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের জাগরণ সৃষ্টি হয়। তাঁর রচিত বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পসমূহ অক্ষয় এবং তা বহুলপঠিত। তাঁর ছোটগল্পের সংখ্যা শতাধিক। ঘাটের কথা, রাজপথের কথা, মুকুট, দেনাপাওনা, পোস্টমাস্টার, ব্যবধানসহ অসংখ্য ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। এর মধ্যে ‘ঘাটের কথা’ ছোটগল্পটি বাংলা ভাষার অন্যতম প্রথম সার্থক ছোটগল্পরূপে স্বীকৃত।
তেমনি প্রেম, মানবতা ও স্বাধীনতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম। শিল্প-সাহিত্যে বহুমাত্রিক প্রতিভার মধ্যে তাঁর ছোটগল্প ‘রাজবন্দীর চিঠি’সহ বেশ কয়েকটি গল্প বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।
বাংলা সাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান অবিস্মরণীয়। সমাজের শাসক ও পুঁজিপতিদের হাতে দরিদ্র সমাজের শোষণ-বঞ্চনার স্বরূপকে সাহিত্যের নানান চরিত্রের মাধ্যমে তিনি তুলে ধরেছেন। তাঁর ৪০টি উপন্যাস এবং ছোটগল্পের সংখ্যা তিন শতাধিক। তার লেখা অন্যতম ছোটগল্প হলো ‘মাসি-পিসি’।
এ ছাড়া তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়সহ বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় গল্পকার হিসেবে যাঁরা কথাসাহিত্যে খ্যাতিমান হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, সৈয়দ মুজতবা আলী, আবু রুশ্দ, রশীদ করিম, আলাউদ্দিন আল আজাদ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, সিকান্দার আবু জাফর, আশরাফ সিদ্দিকী, মিন্নাত আলী, শওকত ওসমান, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, আবদুল মান্নান সৈয়দ, ইসহাক চাখারী, বশীর আলহেলাল, রিজিয়া রহমান, হাসান আজিজুল হক, হাসান হাফিজুর রহমান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ শামসুল হক, জহির রায়হান, কায়েস আহমেদ, সেলিনা হোসেন, নাসরীন জাহান, মাহমুদুল হক, সুচরিত চৌধুরী, রাহাত খান, রশীদ হায়দার, আল মাহমুদ, হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, মশিউল আলম, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রমুখ লেখকের রচনানৈপুণ্যে বাংলা ছোটগল্প নতুন দিগন্তে প্রবেশ করে এবং বাংলা সাহিত্যে বিরাট ভূমিকা রাখে।
রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ বিশ শতকের বাংলার নবশিক্ষিত অভিজাত সমাজের এক অনবদ্য জীবনকথা। ব্যক্তিমানুষের মূল্যচেতনার উপাদান যদি অন্তর থেকে আসে, যার সমুন্নতি, আলোকদীপ্তি বুদ্ধিবৃত্তির বৃহৎ পরিমার্জনায় একটা নিজস্ব চরিত্র ফুটে ওঠে। বাস্তবিক চেনা-জানা, চলাফেরা এবং বাহ্যিক অভিজ্ঞতার জগৎ থেকে তা একেবারে অন্তর অভিমুখী। কথাসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের নবতর বিস্তৃতি ও বিস্ময়কর চেতনার অদ্ভুত আবিষ্কার গল্প-উপন্যাস ও সামগ্রিক পর্বে পর্বে দীপ্তি ছড়ায়। শিল্প-সাহিত্যে তাঁর অঙ্কিত এসব পর্বের দু-একটি মুখাবয়বে কল্পনার প্রাধান্য থাকলেও মানুষের মধ্যে তা চির অক্ষয় ও অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। যেমন রবীন্দ্রনাথের পোস্টমাস্টার, নষ্টনীড়, একরাত্রি ইত্যাদি গল্পে সামাজিক প্রতিবেশ ও বিশেষ সমাজের রূপায়ণ ফুটে ওঠে।
তেমনি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত সাহিত্যের সামগ্রিকতায় তাঁর গল্প-উপন্যাসসমূহ আমাদের সমাজ, মাটি ও মানুষের জীবনের বিচিত্র রূপকে গল্পের কারুকাজে বিচিত্রতর করে তুলেছে। তিনিও তাঁর সাহিত্যশৈলীর যথাযথ নৈপুণ্য প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছেন। বিপুল পরিমাণ গল্পরাজিতে কত বিচিত্র স্বাদের গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন, তা পড়ে শেষ করা যায় না।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে গল্প-উপন্যাস রচনার মাত্রা আগের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রবীণ লেখকদের সঙ্গে সৌভাগ্যক্রমে যুক্ত হয় নবীন তরুণ লেখকসমাজ। যাতে দেশের অনেক তারুণ্যোদীপ্ত গল্পকার ও কথাসাহিত্যিক মননশীল সাহিত্যকর্মে বিশেষ ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। বর্তমানে সেটি আরও অগ্রসরমান।
আলোচ্য গ্রন্থের লেখক স্বপন বিশ্বাস সেই সব তরুণ লেখকদের একজন। তাঁর গল্পগ্রন্থে বাংলাদেশের চলমান সমাজস্বরূপের নিরেট সত্যবোধ ও আগামী প্রজন্মের সম্ভাবনার উদার দৃষ্টিসম্পন্ন দিকগুলো চমৎকারভাবে উঠে এসেছে।
গল্পশৈলীর বুনন-প্রক্রিয়া দেখে মনে হয়, তিনি গল্পলেখার টেকনিক আয়ত্ত করতে সক্ষম এবং সেসব লেখা পাঠকের সামনে উপস্থাপনের একটি নিজস্ব আখ্যানের দিকে এগোচ্ছেন। স্বপনের রচনায় এ ধরনের টেকনিক ও পারঙ্গমতা বাংলা সাহিত্যে ভিন্নতর মননশীলতার নতুন মাত্রা যোগ করবে।
বাংলাদেশের সাহিত্যে ছোটগল্পের বিশিষ্ট স্থান সুনির্দিষ্ট হয়েছে সামাজিক-মানবিক ও আর্থ-রাজনৈতিক আবহ ধারণ করে। ছোটগল্পের ভুবনে সঞ্চিত হয়েছে ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক সংকট, সামাজিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক টানাপড়েন আর মানবজীবনের দ্বন্দ্ব-সংঘাত। খ্যাতিমান অনেক গল্পকার-ঔপন্যাসিককে আমরা পেয়েছি। তাঁদের ফলবান সম্ভারে পরিপূর্ণ হয়েছে বাংলাদেশের গল্পলোক। রাজনৈতিক-সামাজিক পরিবর্তনের ধারায় মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা ও সংগ্রাম, দোদুল্যমানতার প্রতিফলন ঘটিয়ে রচিত হয়েছে অনেক গল্প। তেমনি মুক্তিযুদ্ধ, মানুষের সম্ভাবনা, সমাজবাস্তবতা, রাজনৈতিক প্রবণতা ফুটে উঠেছে শৈল্পিক সৃষ্টিশীলতায়।
তবে কবিদের মতো গল্পকারদের দশকওয়ারি বিভাজন রয়েছে। আমি কখনো এ ধরনের সময়কালের সঙ্গে লেখককে বিভাজন করতে চাই না। কেননা, কবি-সাহিত্যিকেরা সর্বকালের। সর্বসময়ের মানুষই তাকে অনুসরণ করতে পারেন। তার কোনো সীমানা নির্ধারণ করা যায় না। দশকের সংকীর্ণতায় তাঁদের চিত্রিত করা উচিত নয়।
বাংলাদেশের ছোটগল্পে রূপায়িত হয়েছে সামাজিক কুসংস্কার, অন্ধতা, পশ্চাৎবর্তিতা, ধর্মান্ধতা, পারিবারিক কলহ, দাম্পত্য সংকট, নিম্নবর্গের অনুভূতি, জীবন জটিলতা, প্রগতিশীলতা, মুক্তির আকাক্সক্ষা, শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা। মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং তৎপরবর্তী রাষ্ট্র, সমাজ ও লোকায়ত সত্তাকে উপলক্ষ করেও শতসহস্র গল্পকাহিনি রচিত হয়েছে।
বাংলাদেশের মানুষ আবহমান বাংলার সৌন্দর্যময় প্রকৃতির চেতনা ধারণ করে বড় হয়েছে। এখানকার নদী, জল, পাহাড়, জলাশয়, বিল, হাওর সজীবরূপে প্রভাবিত করেছে মানুষের চেতনালোকে। সামাজিক সম্পর্কের ঘটনাক্রম, সামাজিক রীতি-প্রথা আর মূল্যবোধের প্রভাবে ক্রমবর্ধিত হয়েছে মানুষের বাঙালি সত্তা। বাংলাদেশের মানুষের রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জনের অভিজ্ঞতা এবং স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের অবস্থা ও পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতনতা। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী ভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক-সামাজিক জীবনপ্রবাহের অব্যাহত প্রভাবেও গড়ে উঠেছে মানুষের মনোচৈতন্য ও সমাজবাস্তবতা। মননশীল চৈতন্য ও সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে মানুষকে চেনার অভিজ্ঞান ও অন্বেষণস্পৃহায় সমকালীন এবং ঐতিহ্যভিসারী মানবছায়া সাহিত্যবোধের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য।
স্বপন বিশ্বাসের গল্পে সেসব বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। যেখানে দেশপ্রেম, দেশাত্মবোধ, আবহমান বাংলার ঐতিহ্য এবং লোকসমাজের নানান বিষয় উঠে এসেছে।
গল্প ও ছোটগল্পের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। অনেক সময় সহজেই ছোটগল্প ও বড়গল্পের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা যায়। এই পার্থক্যের বিষয়টি নির্ভর করে গল্পের বিষয়বস্তু ও ব্যাপকতার ওপর। বাক্যগঠনে যথার্থ শব্দপ্রয়োগ, ঘটনাবলির বর্ণনার বিস্তৃতির ওপর। সেসব বিচারে আলোচ্য বইটিকে ছোটগল্পের বই হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এখানে স্বপন বিশ্বাসের মননচেতনা ও সৃজনশীল সাহিত্যসৃষ্টির বিচক্ষণতার দিকসমূহ ফুটে উঠেছে।
‘গদাধরের ছেঁড়া চটি ও ফুলেশ্বরীর পাখি বৃত্তান্ত’ নামক গল্পটিকে বইয়ের নামকরণ করা হয়েছে। গ্রামের জগাই হলদারের কিশোরী মেয়ে ফুলেশ্বরী অপূর্ব সুন্দরী। গদাধর ওই গ্রামের এক হতদরিদ্র বোকাসোকা মানুষ। পেশা তার মাছধরা। সে জন্য লোকে তাকে জেলে বলে।
স্কুলপড়ুয়া ফুলেশ্বরীকে গদার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া নিয়ে গ্রামের বখাটে মাস্তান আলাই মেম্বারের রাগ ও ক্ষোভের শেষ নেই। কেননা, ফুলেশ্বরীর প্রতি তার কুনজর ও লোলুপ দৃষ্টি ছিল সব সময়। তাই মিথ্যা অজুহাতে গদাধরকে ফাঁসিয়ে চেয়ারম্যানের সহযোগিতা ও অনুকম্পায় থানা হাজতে পাঠানো হয়। অন্যদিকে গভীর রাতে গ্রামের বখাটে সন্ত্রাসীদের দ্বারা গদার বাড়িতে আগুন দেয়। আগুনের লেলিহানে ফুলেশ্বরীর দেহ ভস্মীভূত হয়ে যায়। এই পৈশাচিক, বীভৎস দৃশ্য দেখে হকচকিত একমাত্র ছোট্ট মেয়ে ‘কুনি’ ভয়ে বাঁশঝাড়ের অন্ধকারে লুকিয়ে থাকে। ভোরের আবছা আলোয় তখনো আগুনঝরা অঙ্গারের ভেতর থেকে ধোয়া উদ্গিরণ হচ্ছিল। ওড়ে যাওয়া ছাইয়ের ভেতর থেকে একটি কাক উড়ে গেল। নির্বাক, নিস্তব্ধ কুনি দূর আকাশের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ডাকে, মা মা মা!
লেখক স্বপন বিশ্বাস এ রকম ব্যবচ্ছেদের করুণ চিত্র অবক্ষয়ী সমাজের মানুষের মধ্যকার প্রেম, ভালোবাসা কিংবা হিংসিত সমাজের সবকিছুকে চিরে চিরে অবলোকন করে তার লেখা গল্পের প্লটকে সাজিয়েছেন। প্রবলতর স্বচ্ছতাপূর্ণ অন্তরবিকাশের রূপরেখায় আমাদের ধনী, দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের স্তরে স্তরে সাহিত্যবোধ এ রকম কত শত নিদারুণ চিত্র, সুখ-দুঃখ ও আনন্দ-বিষাদের নিষিক্ত অভিব্যক্তির ছোঁয়ায় স্বপন বিশ্বাসের গল্পগুলো সাজানো। এসব গল্পে ধর্মকর্ম, সমাজ, জনকোলাহলমুখর লোকমতের স্বাভাবিক জীবনাচারের কথা প্রকাশ পেয়েছে। স্বপন বিশ্বাসের গল্পের নির্মাণশৈলী ও বয়ানের কৌশল মন্দ নয়। তার গল্পে মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের সর্বসত্তার স্তরে স্তরে কঠিন বাস্তবতার ওপর প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের নিবিড়তর সম্পর্কের বিষয়টিও লক্ষণীয়। আলোচ্য গ্রন্থের লেখক স্বপন বিশ্বাস তার গল্পমালায় দেশাত্মবোধ, মুক্তিযুদ্ধ, প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা এবং বিরহ-বেদনাত্মক ঘটনাবলি ছাড়াও কৌতুকপূর্ণ গল্পসমূহের পরতে পরতে মেধা ও মননের উৎসারণ ঘটিয়েছেন। যেমন অনন্ত হিংসা ও রক্তপাত বন্ধের দাবিতে ‘গোরকুই’ নামক গল্পে ভাদুর মায়ের প্রাত্যহিক জীবনের করুণ বাস্তবতার দিকগুলো পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করার মতো। নির্বাচনে রাজনৈতিক সংঘাতের জের হিসেবে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধিয়ে ঘরবাড়ি ভস্মীভূত করে। নির্বাচনের ধ্বংসযজ্ঞের শিকার নাগরিকের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে দশ হাজার টাকা অনুদান আসে। এখানে রমেশ নামের কর্মকর্তা অফিশিয়াল ট্যুরের সময়ে অতীতের স্মৃতিময় অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে উত্তরবঙ্গের ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়ের দিগন্তবিস্তৃত মেঘমালার দৃশ্য দেখার সঙ্গে নিজের মায়ের শূন্যতায় কাতরতার কথা নিখুঁত বর্ণনা ফুটিয়ে তুলেছেন।‘গেদু করাতির যুদ্ধ’ নামক গল্পটি আমাদের লোকসমাজ ও লোকসংস্কৃতির নানা রকম গ্রামীণ কল্পকাহিনির উপাদান দিয়ে রচিত। করাতের সাহায্যে গাছ কাটা এবং প্রতিনিয়ত গাছ ফাড়াই করাই মূলত তার পেশা। গেদু এটি পেয়েছেন তার পৈতৃকসূত্রে। গাছের প্রাণ আছে। গ্রাছের প্রতি গেদুর সখ্য ও প্রেম এতটাই গভীর যে, তিনি গাছের সঙ্গে কথা বলতেন এবং মতবিনিময় করতেন। একবার গাছ না কাটার তাগিদে স্বপ্নও দেখলেন তিনি। একটা সময় তিনি গাছ কাটা বন্ধই করে দিলেন। এ ছাড়া গেদু করাতি মানুষের ভাগ্য নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারতেন। প্রথম প্রথম লোকেরা তাকে পাগল বলে তাড়িয়ে দিলেও পরে ভুল বুঝতে পারল। তার এলাকার কিংবদন্তি ছাই ব্রিজ নিয়েও অনেক কল্পকাহিনি নিয়ে কৌতূহল জন্ম দিয়েছে। এই ব্রিজটির একটা কেরামতি আছে। ওই এলাকায় কোনো জেনা-ব্যভিচার, সামাজিক অন্যায় কিংবা যেকোনো মানবতাহীন অপরাধপ্রবণতা সংঘটিত হলে তারা তাৎক্ষণিক শাস্তি পেয়ে যেত।
‘গেদু করাতির যুদ্ধ’ গল্পটিতে একজন খেটে খাওয়া প্রান্তিক মানুষের জীবনাচার, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সামাজিক দিকগুলো ফুটে উঠেছে। এ ছাড়া ভিনদেশি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে, বিশেষ করে স্বাধীনতা হরণকারী হানাদারদের বিরুদ্ধে তার তীব্র ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ লক্ষণীয়। তিনি তখনকার অবহেলিত সমাজের একজন নিম্ন-মধ্যবিত্ত লোক হয়েও মুক্তিযুদ্ধের সময় গণমানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার প্রশ্নে ছিলেন যথেষ্ট দেশপ্রেমিক। দেশ ও মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি খুব ভালোবাসতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনীর অত্যাচার-নিপীড়ন চালিয়ে ফেরার পর ব্রিজ পার হয়ে যাওয়ার চেষ্টাকালে স্বাধীনতাবিরোধী শত্রুসেনার তিনটি ট্রাক ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধে গেদু করাতির অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অবশেষে ছাই ব্রিজের রূপান্তরিত নামকরণ হয় করাতি ব্রিজ। গেদুর এমন অনেক অলৌকিক ভালো কাজের জন্য এলাকার মানুষ বিশ্বাস করতেন, গেদু করাতির আত্মা সর্বদা জাগ্রত রয়েছে এবং সংগ্রামী মানুষের মুক্তি ও অধিকারের যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি।
‘পেন্সিলে আঁকা ছবি’ গল্পটি এক অনাড়ম্বর বিরহকাতর রোমান্টিক গল্প। এতে সমাজের প্রকৃত চিত্রকল্প চমৎকাররূপে তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিদিনকার ট্রেনে হাজারো যাত্রী চলাচলের কোনো একদিন এই গল্পের নায়িকা পুষ্পের একটি ছবি পেন্সিল দিয়ে আঁকছিলেন চিত্রশিল্পী। একই বগিতে অনেকের সঙ্গে গল্পের নায়ক বিষয়টি দেখছিলেন। মেয়েটি চিত্রকারকে ছবির টাকাও শোধ করেন। কিন্তু নির্ধারিত স্টেশনে নেমে যাওয়ার সময় মেয়েটি ভুলক্রমে ছবিটি রেখে যান। কিন্তু তখনো শিল্পী ছবি আঁকছিলেন। অবশেষে শিল্পীর আঁকা ছবিটি নায়ক যুবকের হাতে দেন। তিনি মেয়েটির ছবিটি ব্যাগে নেন। এভাবেই গল্পের রোমান্টিকতা শুরু। একদিন নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে জনকোলাহলের মাঝে সেই মেয়েকে পেয়ে ব্যাগ থেকে সযত্নে রাখা ছবিটি তার হাতে ফেরত দিয়ে নায়ক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। কী যে আনন্দ! তারপর কখনো আবার দেখা এবং এভাবেই ওদের উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। নিবিড়তর জীবনস্রোতের ছন্দময়তার পতন ঘটিয়ে ক্যান্সারে আক্রান্ত মেয়েটির অকালমৃত্যুর মধ্য দিয়ে গল্পের বিয়োগান্ত বিষাদময়তার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে।
ব্যক্তিজীবনে স্বপন বিশ্বাস একজন মননশীল লেখক এবং প্রতিভাবান সংস্কৃতিমনস্ক। তার লেখার মধ্যে আমাদের লোকজ সাহিত্যের বিষয় উপাত্তও কম নয়। সৃজনশীল সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে তার ভেতরে একধরনের ক্যারিশম্যাটিক মেধা ও মননক্ষমতা আছে। বাংলাদেশে সেই তরুণতম সময় থেকেই তিনি সাংবাদিকতার পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন সৃজনকর্মে ন্যস্ত ছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসজীবনেও তিনি সদর্পে তার সাহিত্যচর্চা, লেখালেখি এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন। একধরনের স্নিগ্ধতা ও মুগ্ধতার ছাপ লক্ষণীয়। মনে হয়, এসব কোনো কল্পকথার গল্প নয়, আমাদের জীবনচিত্রের সপ্রাণ উদ্ভাসের ছায়াঘন ক্যানভাস।
‘গদাধরের ছেঁড়া চটি ও ফুলেশ্বরীর পাখি বৃত্তান্ত’ নামক তার ছোটগল্পের বইটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। এই বইয়ের প্রতিটি গল্পের লিখনশৈলীতে লেখকের মননশীল প্রতিভা, শিকড়সন্ধানী মন ও মানসের পরিস্ফুটন ঘটেছে। একজন রুচিমান লেখক হিসেবে তিনি তার গল্পসমূহে মননশীলতা ও ঈর্ষণীয় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।
‘লকডাউনের হাঁসপাখি’ গল্পটির পরিণতি শোককাতর আক্ষেপ ও অনুভবের সিঞ্চিত অধ্যায়। প্যান্ডামিকের ভয়ংকর করোনাভাইরাসের ধকলে পৃথিবীর অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। একই সময় পিয়াস তার মাকে হারানোর বেদনায় মাঝে মাঝে আত্মভোলা হয়ে যায়। পার্কে বসে গাছে পাখি আর লেকের জলে ভাসমান হাঁসের বিচরণ দেখতে দেখতে সহসা হারিয়ে যায় অন্য কোনো অনুভবে। সতৃষ্ণ আকাক্সক্ষা ও স্বপ্ন নিয়ে পিয়াস-তৃষ্ণা আমেরিকায় এসেছিল। এ রকম মানুষের অন্দর-বাইরের দ্বন্দ্ববিহারী বহু রকম দৃষ্টান্ত গল্পের বইটিতে তুলে ধরা হয়েছে।
গল্পকার অত্যন্ত নিষ্ঠা ও গভীর চৈতন্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের এবং প্রবাসের মানুষজনের জীবনাচারের মেলবন্ধন ঘটানোর জন্য খুবই তৎপর ও আন্তরিক। সাহিত্যনির্ভর রচনায় এখানে তার বুদ্ধিদীপ্ত পারঙ্গমতা বিদ্যমান।
‘আমরা এমনি এসে ভেসে যাই’ গল্পটিও প্রবাসজীবনের যন্ত্রণাদগ্ধ গ্লানিকর কাহিনিতে ভরপুর। কারও ভাগ্যে বড় কিছু জুটলেও কতজনের জীবন করুণভাবে নির্বাপিত হয়ে যায়। কেউ সুখ পায়, কেউ পায় না। তেমনি বাংলাদেশি ভাগ্যহত হানিফ রঙিন চিপসের প্যাকেট দেখতে দেখতে ভাবে, গড়াই নদীতে যেন বানের জল ঢুকে পড়েছে।’
যেমন গুয়াতেমালা থেকে আমেরিকায় আসা ক্যারোলিনা কঠিন শ্রম দিয়ে জীবনযাপন করেন। কিন্তু নিজ জন্মভূমির স্মৃতি সর্বদা তাড়িয়ে বেড়াত। বল্টের পাশে দাঁড়ানো সারিবদ্ধ শ্রমিকের দল সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাত চালাচ্ছে। চেরিওস সিরিয়ালের ব্যাগ সাজাতে সাজাতে ক্যারোলিনার মনে পড়ে যায় তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলা ডিলস নদীর কথা। স্বদেশের বিলম্বিত ভাগ্যচাকা কীভাবে নতুন নতুন স্বপ্নে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে জীবনের মোড় ঘুরে যায়। আবার কারও জীবন চিরকালের জন্য নির্বাপিত হয়ে যায়। বিদেশ-বিভুঁইয়ের যাপিত জীবনের কত যন্ত্রণাদগ্ধ অজানা কাহিনি আড়ালে পড়ে রয়েছে। আবার কিছুটা বেরিয়ে আসছে গল্প থেকে গল্পান্তরে। আমরা জানি, বাংলা সাহিত্যের নানান পর্বে গদ্যসাহিত্যের শক্তিমত্তা প্রদর্শনের ক্ষেত্রগুলো যুগের বিভিন্ন সময় নানাভাবে প্রকাশিত হয়েছে। গল্প-উপন্যাসে সাধারণত কল্পনাবিলাসী উপাত্তের চেয়ে আমাদের বাস্তবমুখিন সামাজিক অবস্থিতি এবং চলমান জীবনের পারিপার্শ্বিকতার নিখুঁত বর্ণনা ফুটিয়ে তুলতে পারলেই সার্থকতা। মানুষের জীবনবোধ-বিষয়ক গল্প দ্বারাও অনেক গল্পকার পৃথিবী, প্রকৃতি, প্রেম-বিরহ, ভালোবাসা, মাটি এবং ইহজাগতিক পটভূমিকেও নির্মলভাবে চরিত্রাঙ্কন করা যায়। এ ছাড়া কৌতুকপূর্ণ গল্পসমূহের পরতে পরতে মেধা ও মননের উৎসারণ। আমার মনে হয়, সাহিত্যের নিগূঢ়তর শাখায় স্বপন বিশ্বাসের বিস্তর যোগাযোগ আছে। চাইলে তিনি একজন মননশীল গল্পকার হতে পারবেন। কেননা, একজন গল্পকারের কাহিনি জনজীবনের সকল বিষণ্নতাকে কাটিয়ে আপন শব্দবোধের ঝংকৃত অলংকারের মুগ্ধতায় পাঠককে নাড়া দেয়। মানুষের ভেতরকার কৌতূহল, অভিজ্ঞতা এবং কৌতূহলোদ্দীপক চিন্তা ও কল্পনার কক্ষপথে বিচরণের ফলে পারস্পরিক মৈত্রী ও দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে নানা রকমের গল্প বেরিয়ে আসে। এখানে স্বপন বিশ্বাসের সাফল্যই আমাদের কাম্য। ভবিষ্যতে এই গল্পকার সে পথেই এগিয়ে যাবেন এবং সাহিত্যকর্মে তার সাফল্যের স্বাক্ষর রাখবেন। ধূসরছোঁয়া খড়িমাটির রংমিশ্রিত মলাটে ১৫১ পৃষ্ঠায় ১৮টি গল্প সমন্বিত বইটির প্রতিটি গল্পের লেখকের মেধা ও মননের ছাপ এবং নিজস্ব স্বকীয়তা ফুটে উঠেছে। অফসেট কাগজে ছাপা, টেকসই বাঁধাইকৃত বইটির মূল্য বাংলাদেশে ৪৬০ টাকা। বইটির মুদ্রণে একতা প্রিন্টার্স, প্রকাশনায় ঢাকার তাম্রলিপি। প্রজ্ঞা পারমিতা বিশ্বাসের কভার ডিজাইনটি ব্যতিক্রম এবং অর্থবোধক অবয়ব লক্ষণীয়। তবে, রং মিশ্রণে গ্রাফিকসের আনাড়িপনার ফলে প্রচ্ছদটি ফুটে ওঠেনি। আশা করি, একজন মননশীল লেখক হিসেবে স্বপন বিশ্বাস তাঁর ভবিষ্যৎ প্রকাশনায় নিজস্ব রুচিবোধ ও নির্দেশনার বিষয়টি প্রকাশককে জানিয়ে রাখবেন। আমাদের প্রত্যাশা, সৃজনশীল লেখার কৌশলপটুত্বে স্বপন বিশ্বাস সৃষ্টিশীল সাহিত্য রচনা এবং তার কর্মকুশলতার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারবেন। যার ফলে কৌতূহলোদ্দীপক পাঠক, তাঁর কাছ থেকে আরও অনেক ঝরঝরে লেখা পাবেন। আরও বেশি জীবনধর্মী রোমান্টিক লেখা ও চমকপ্রদ গল্প পড়ার সুযোগ পাবেন। কথাসাহিত্যে স্বপন বিশ্বাসের বহুমুখী প্রতিভা আরও বিকশিত হোক। একজন রুচিমান লেখক হিসেবে তাকে শুভেচ্ছা ও শুভকামনা।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক
(লেখাটি নিউইয়র্কের কুইন্স লাইব্রেরিতে নীরা কাদরী পরিচালিত ‘লেখকের অঙ্গন’ অনুষ্ঠানে পঠিত।)