...আমার গল্পটা বলি।
আমাকে ঠেলে বাড়ির বাহির করল। শোবার ঘর থেকে বসার ঘর, বসার ঘর থেকে বারান্দা, বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়ি, সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাগান, এরপর বাগান পেরিয়ে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ি। আমাকে নিয়ে টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তুলল। তুলেই গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিল, যাতে কেউ আমাকে বের করতে না পারে। শুধু যে গাড়িতে রেখে গেল, তা নয়। মোটাসোটা একটা শক্ত দড়ি দিয়ে আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা হলো, যাতে আমি হেলে না পড়ি।
এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে আমার একটুও মন চাইছিল না। যেখানে এত দিন ছিলাম, সে জায়গাটির প্রতি মায়া পড়ে গিয়েছিল। আমার আশপাশে অনেক বন্ধু ছিল। তারা দেখতে আমারই মতো অথবা আমার চাইতে ভিন্ন, গায়ের রং আলাদা, লম্বায় একটু বড় বা খাটো।
আমার যাত্রা কত দূর হবে, কিছুই জানি না। শুধু এইটুকু জানি, এখানে আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছে। তাই আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে অন্য আরেকটি দেশে। সেই দেশের মানুষগুলো কেমন, আবহাওয়া কেমন, ঠান্ডা না গরম, তাও জানি না। আমি কোন ধরনের বাড়িতে থাকব, সেটাও জানি না। ছোট্ট একটা ছিমছাম বাড়ি নাকি বিশাল বড় কোনো অট্টালিকা। একতলা বাড়ি নাকি দোতলা-কিছুই জানি না।
আচ্ছা, আমাকে কোন রুমে রাখা হবে? শোবার ঘরে নাকি গেস্ট রুমে? দিনের পর দিন একই জায়গায় থাকতে থাকতে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। জানের ভেতর কেমন জানি ফাঁপর লাগে। এটা যদি কেউ বুঝত, তাহলে আমাকে দিনের পর দিন বন্দিশালায় রেখে দিত না।
একই জায়গায় থাকতে থাকতে আমার যেমন খুব বোরিং লাগে, তেমনি আবার অনেক কিছু জানতেও পারি। বাড়ির মানুষগুলো কেমন, তারা কী নিয়ে কথা বলে, তাদের জীবনযাত্রা কেমন, তারা কী পছন্দ করে না করে, সবকিছু জানতে পারি। কারণ আমি খুব মন দিয়ে এদের কথা শুনি।
আপনাদেরকে একটা গোপন কথা বলি। এরা বাইরে দিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক চলছে দেখালেও আসলে এদের মনের ভেতর খুবই অশান্তি। কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। মুখে একটা বলবে তো মনের ভেতর অন্য কিছু লুকানো থাকবে। মনের ভেতর একটা কিছু লুকানো থাকবে তো পেটের ভেতর থাকবে অন্য কিছু। আন্তরিকতা, সততা, মায়া-মমতা, ভালোবাসা খালি বাইরে দেখায়। ওগুলো সব মেকি, ভেতরে কিছুই নেই, সবই ফাঁকা। সবাই খুব বেশি স্বার্থপর, খালি নিজেরটা বোঝে। আর সব সময়ই নিজের সুবিধা আদায় করার চেষ্টায় থাকে।
আমি যে বাড়িতে থাকি, সে বাড়ির সবাই সারা দিন ব্যস্ত। কাজকর্ম, সামাজিকতা, পাবলিসিটি, সোশ্যাল মিডিয়া, পরনিন্দা, পরকীয়া, অন্যের ক্ষতিসাধন-সবকিছু নিয়ে ব্যস্ত। বাড়ির সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য থেকে শুরু করে সবচেয়ে কনিষ্ঠ পর্যন্ত সবাই ব্যস্ত। অনেক সময় ব্যস্ত না থাকলেও ব্যস্ত থাকার অভিনয় করে। ওদের ভাষায় এটাকে ‘ভাব’ বলে। সবাই কমবেশি ভাবে চলে আর কি। শুনেছি, ভাব না থাকলে এরা গুরুত্ব পায় না, কেউ এদের পাত্তা দেয় না।
একবার কী হলো বলি, সে এক দারুণ গল্প।
এ বাড়ির মেয়েটি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করল। অনেক দিন থেকেই প্ল্যানিং চলছিল। যে ছেলেটির সঙ্গে প্রেম করত, সে থাকে বিদেশে। খুব সম্ভবত অস্ট্রেলিয়ায়। ছেলেটির সঙ্গে অনলাইন চ্যাটিংয়ের মাধ্যমে পরিচয়। ছেলেটি তাকে বিয়ে করে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়েছিল। সব সময় ভিডিও কল করে কথা বলত, আমি শুনতাম। এদিকে ওর বাবা-মা তো কিছুই জানত না। মেয়েটি ও তার প্রেমিক ছেলেটি মিলে দিন-তারিখ সব ঠিক করল কবে বাড়ি থেকে পালাবে। আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। আমি ভাবলাম, হায় আল্লাহ, এ কী বিপদ! তোর যেখানে যেতে মন চায়, তুই যা। আমাকে সঙ্গে নেওয়ার দরকার কী?
তারপর তো হলো আরেক হুলুস্থুল কাণ্ড। পালানোর দিন মেয়েটি ধরা পড়ে গেল। বাড়ির বাগানের মালি টের পেয়ে খবর দিয়েছিল বাবা-মাকে। ওনারা তো সারাক্ষণ ক্লাব, পার্টি, সমাজসেবা আর সোশ্যালাইজিংয়ে ব্যস্ত থাকে। এই খবরে তো ওনারা আকাশ থেকে পড়ল। ওনারা ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখল, মেয়েটি একটি নারী পাচারকারী দলের খপ্পরে পড়তে যাচ্ছিল। বাড়িতে পুলিশটুলিশ এসে একাকার অবস্থা। তাতে অবশ্য কোনো অসুবিধা হয়নি। এই মহল্লার পুলিশের এসি ওনাদের দীর্ঘ দিনের চেনা। ওই ঘটনার পুরোটাই ধামাচাপা দেওয়া হলো। কী বাঁচান না বাঁচল মেয়েটি। আমি তো ভয়ে অস্থির। আরেকটু হলেই আমিসহ পাচার হয়ে যাচ্ছিলাম।
এবার আরেকটা গল্প বলি। এ বাড়ির বড় ছেলে বহুদিন থেকে চেষ্টা করছিল বিদেশে যাওয়ার। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা-যেকোনো দেশে। শিল্পপতি বাবা ছেলেকে বুঝিয়েছিলেন, বিদেশ থেকে যদি কোনো রকমে একটা উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে আসতে পারে, তাহলে আর চিন্তা কী। ওনার মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ছেলেকে এমডি করে বসিয়ে দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে শহরের রাজনৈতিক ক্ষমতাধারী কোনো প্রভাবশালী পরিবারের মেয়ের সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধও ঠিক করা যাবে। কিন্তু বড় ছেলের আবার লেখাপড়ায় কোনো মন নেই। ওঊখঞঝ নাকি যেন বলে, সেই পরীক্ষা পাঁচবার দিয়েও পাস করেনি। অবশেষে ছেলেটি টাকা দিয়ে অন্য লোক দ্বারা পরীক্ষা দিয়ে পাসের রেজাল্ট আনিয়েছে।
কিন্তু তার পরও যখন ছাত্র-ভিসা মিলল না, তখন মাঠে নামলেন স্বয়ং বাবা। ওনার কিন্তু বিভিন্ন মহলে প্রচুর কানেকশন আছে। উনি অঢেল টাকাপয়সা খরচ করে একেবারে বিদেশে যাওয়ার ইমিগ্র্যান্ট ভিসা কিনে ফেললেন। এই খবরে ছেলেটির মা যেমন খুশি হলেন, তেমনি অতিরিক্ত রকমের কাঁদতেও শুরু করলেন। মায়ের অবিরাম কান্না চলল, ছেলে আমার কোন দূরদেশে চলে যাবে। সেখানে কি দশ-বারোটা কাজের মানুষ, ড্রাইভার, দারোয়ান, মালি, পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট মিলবে। বিদেশ বিভুঁইয়ে ছেলেটা কী খাবে, না খাবে, তার কি ঠিক আছে।
মায়ের কান্না দেখে বাবা মনস্থির করলেন, ছেলেটা যে শহরে থাকবে, সে শহরে তার জন্য একটা ফ্ল্যাট কিনে ফেলবেন। যথারীতি ফ্ল্যাট কেনা হলো। তারপর এক মাস ধরে চলল বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি। বাড়ি সাজানোর কত কিছু কেনা হলো। আলাদা করে প্রতি ঋতুতে যা যা কাপড়, জুতা, ব্যবহার্য জিনিস লাগবে, তার সবকিছু কিনে ফেলা হলো। দুটি দামি মোবাইল ফোন ক্রয় করা হলো, একটা দিয়ে বন্ধুবান্ধব ও অন্যটা দিয়ে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ চলবে। সেই সঙ্গে দামি ল্যাপটপ, যাতে পড়াশোনার কোনো অসুবিধা না হয়।
অবশেষে বিদেশ যাওয়ার দিনটি উপনীত হলো। অসংখ্য জিনিসপত্রের ভারে আমার প্রাণ যাওয়ার জোগাড়। তার ওপর দিয়ে আবার মোটা রশি একেবারে গায়ের ভেতর বসে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ আগেই আমাকে লোক মারফত গাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
পরিবারের সঙ্গে কান্নাকাটি পর্ব শেষ হলে তবেই বিদেশগামী ছেলেটি নিচে নামবে। আমার মনের ভেতর কেমন জানি আনচান করছে। আর কোনো দিন এই বাড়িতে ফেরত আসব কি না জানি না।
আসলে, স্যুটকেসের জীবনটাই এমন। খালি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তর। মানুষের সেবায় লেগে থাকা। মনুষ্য সমাজে যত দিন সার্ভিস দিতে পারব, তত দিনই শুধু আমার কদর। ভাঙাচোরা হয়ে গেলে আমাকে এক নিমেষে ছুড়ে ফেলা হবে। আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। আমার কথা কেউ আর মনে রাখবে না।
আপনারা জানেন নিশ্চয়, মানবসমাজেও একই নিয়ম বিদ্যমান। যত দিন কাজে আসবে, তত দিনই তারা একে অপরকে মনে রাখবে, এর বাইরে নয়। মানুষ মরে গেলে অবশ্য বড় করে শোকসভা করা হয়। আমাদের স্যুটকেসের জন্য তাও করা হয় না।
...ওই যে ওরা এসে পড়েছে গাড়িতে। এবার তাহলে চলি।
লেখক : ব্লগার ও কলামিস্ট, টেক্সাস।