ঘটনাটা ঘটেছিল ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পুরো দুই দিন ধরে। ঢাকার পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ নামে সংঘটিত এক ভয়াবহ আত্মঘাতীমূলক হামলায় নিহত হয়েছিলেন ৫৭ জন সেনাসদস্য ছাড়াও নারী-শিশুসহ আরও ১৭ জন মানুষ। কিছু বিপথগামী সৈনিকের হাতে ওই সময় বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমদ ও তার স্ত্রী নিহত হওয়া ছাড়াও নিহতের তালিকায় ছিলেন দুজন মেজর জেনারেল, দুজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, ১৬ জন কর্নেল, ১০ জন লেফটেন্যান্ট কর্নেল, ২৩ জন মেজর, দুজন ক্যাপ্টেন এবং মেডিক্যাল কোরের আরও তিনজন অফিসার। বাংলাদেশের ইতিহাসে সেনাবাহিনীর ওপর এত বড় দুর্যোগের ঘটনা আর কোনো দিন ঘটেনি। যদিও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন সেনাবাহিনীর পরিচয় ছিল পাকিস্তানি বা পাক সেনাবাহিনী, যারা জন্মসূত্রে ছিলেন বাংলাদেশি। নির্মম সত্য হলো, বাঙালি সেনাদের সেই সময়ে পাকিস্তানের সেনাসদস্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছিল এবং সেই যুদ্ধে বাঙালি সেনাসদস্যদের মধ্য থেকে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৫১ জন অফিসার। সেদিক থেকে বিডিআর বিদ্রোহে সেনা কর্মকর্তাদের প্রাণ হারানো এক অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতির ইতিহাস। এতজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার এভাবে বেঘুরে প্রাণ হারানোর ঘটনা দুনিয়ার কোথাও ঘটেছে বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় না।
মইনুদ্দীন-ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপিকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসেছিল আওয়ামী লীগ। ওই ভোটে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৩০টি আসন, বিপরীতে বিএনপি পেয়েছিল মাত্র ৩০টি। ওই সময়কালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলাকে অসাড় করে দিয়ে রাজনীতির ময়দানে দুই বেগমের আধিপত্যবাদের সূচনা হলেও মূলত শেখ হাসিনার একচ্ছত্র সাম্রাজ্য বিস্তারের বড় একটা সুযোগ করে দিয়েছিল ওই নির্বাচনের ফলাফল। যদিও বিএনপি নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছিল। কিন্তু তাতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে কোনো প্রভাব পড়েনি, বরং আওয়ামী লীগকে দানব লীগে পরিণত করার ক্ষেত্রে ওই সময়কালের ভোটের ফলাফল মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। বিশেষ করে, ভারতীয় প্রশাসন ওই ফলাফলকে তাদের অসদুদ্দেশ্য চরিতার্থ করার হাতিয়ার হিসেবেই গ্রহণ করেছিল। তার জন্য তাদের দরকার ছিল আওয়ামী লীগকে অন্যতম তাঁবেদার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার বিষয়টি। আর ওই নির্বাচনে জয়লাভ করার পর সরকার গঠনের মাত্র ৪০ দিনের মাথায় যখন বিডিআর বিদ্রোহের মতো এত বড় ঘটনা ঘটল, তখন বিষয়টাকে বিএনপির কারসাজি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার সুযোগটা হাতছাড়া করল না আওয়ামী লীগ। তারা জোর দিয়ে বলতে শুরু করল, আওয়ামী লীগকে অস্থিতিশীল করার উদ্দেশ্যেই এই কাজ করেছে বিএনপি।
কিন্তু প্রকৃত ঘটনা ছিল অন্য রকমের। যেমন ২০০১ সালের ২০ এপ্রিল কুড়িগ্রামের রৌমারী সীমান্তে বিডিআর ও বিএসএফের মধ্যে একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। সেই যুদ্ধে বিডিআরের হাতে বিএসএফের বহু সৈন্য নিহত হয়েছিল। এই ঘটনার আরও কিছুদিন আগে পাদুয়ায় সংঘটিত আরও এক যুদ্ধে বিএসএফের আরও ১৬ জন সদস্যকে হত্যা করেছিল বিডিআর সদস্যরা। এই দুই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতের রাজনীতির ময়দান উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল এবং ভারতের তৎকালীন ডিফেন্স মিনিস্টার যশবন্ত সিং লোকসভার এক মিটিংয়ে বলেওছিলেন, ভারত এই ঘটনা সহজে মেনে নেবে না। তারা তার বদলা নেবে। বিডিআর হত্যাকাণ্ড হলো সেই বদলা নেওয়ার ঘটনা। ‘র’-এর সহযোগী হিসেবে তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদের নাম সেই ঘটনা-পরবর্তী সময়ে খুব জোরের সঙ্গে উচ্চারিত না হলেও অনেকের কাছে বিষয়টা স্পষ্টই ছিল, ওই বিদ্রোহে অনুপ্রেরণাদায়ী হিসেবে অন্তরালে কাজ করেছিল আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্ব। আসলে এত সব কাণ্ড ঘটানোর পেছনে যদিও পরোক্ষভাবে দায়ী ছিল সীমান্ত সংঘাত, কিন্তু পেছনে ক্রিয়াশীল ছিল পাদুয়া ও রৌমারী সীমান্ত সংঘর্ষের বিষয়টি। যেখানে বিডিআরের কাছে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়েছিল বিএসএফ। সেই পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের মাধ্যমে এত বড় ঘটনা ঘটানোর প্ল্যান করেছিল ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী সরকার।
এমনিতে একাত্তর সালের পর থেকে সীমান্ত সমস্যাটি দুই দেশের জনগণের জন্য গলার কাঁটার মতো সমানে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছিল। ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির দুই দফা অনুযায়ী সিলেটের সীমান্তবর্তী পাদুয়া হচ্ছে একটি অপদখলীয় এলাকা। একাত্তর সালের পর থেকে পাদুয়ার ওপর দখলীয় স্বত্ব আরোপ করে রেখেছিল ভারত। ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ওই অঞ্চলের ৩২১৮.৫৬ একর জায়গা দখল করে রেখেছিল ভারত এবং ওই দখলীয় স্বত্বের দোহাই দিয়ে তারা পাদুয়ায় একধরনের আতঙ্কের জন্ম দিয়ে রেখেছিল। বিডিআর ওই কারণে বিএসএফের বিরুদ্ধে এক অলিখিত হামলার ঘটনা ঘটায়। দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বেধে গেলে কার্যত বিএসএফকে পিছু হটতে হয়েছিল। বিডিআরের তিনজন সদস্য শহীদ হলেও বিএসএফ তাদের ১৬ জনের লাশ ঘটনাস্থলে ফেলে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করেছিল। এই পাদুয়া ছাড়াও সীমান্তবর্তী আরও কিছু অঞ্চল নিয়ে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে দ্বন্দ্ব চলমান ছিল যুগ যুগ ধরে। এসব সমস্যা নিয়ে সমানে ফ্ল্যাগ বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও গত ৫৩ বছরে তার কোনো একটিরও সম্মানজনক সমাধান হয়নি। যদিও বিডিআর ২০০১ সালের ১৫ এপ্রিল পাদুয়া গ্রামটি পুনরুদ্ধার করে সেখানে তিনটি ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। কিন্তু অল্প দিন পরে ভারতীয় পক্ষের ঊর্ধ্বতন মহলের চাপে নতি স্বীকার করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার পাদুয়া সীমান্ত থেকে দখলি স্বত্ব তুলে নিতে বিডিআরকে নির্দেশ দেয়।
আরও বড় ঘটনার সূত্রপাত হলো, এই ঘটনার চার দিন পরে কুড়িগ্রামের রৌমারী সীমান্তে বিএসএফের সঙ্গে বিডিআরের সীমান্ত সংঘর্ষের ঘটনাটি। ২০০১ সালের ২০ এপ্রিল এই দুই সীমান্তে সংঘটিত সংঘর্ষে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৎকালীন বিডিআরের মহাপরিচালক আ ল ম ফজলুর রহমান। তিনি একজন সরাসরি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। যার কারণে এই দুই সংঘর্ষকে তিনি দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের কাতারে ফেলে মোকাবিলা করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। পাদুয়া অপারেশনের মাত্র দিন কয়েকের মধ্যে কুড়িগ্রামের রৌমারীতে দ্বিতীয় যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল বিডিআর ও বিএসএফের মধ্যে, বাংলাদেশের বিগত ৫৩ বছরে দুই দেশের মধ্যে এত বড় সংঘর্ষের আর কোনো ইতিহাস নেই। যে দুই ঘটনাকে উপজীব্য করে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্কে একটা ফাটল দেখা দিয়েছিল আর ভারতের ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠার ঘটনায় তৎকালীন হাসিনা সরকারের উদ্বেগের কোনো সীমা-পরিসীমা ছিল না। এ অবস্থায় যখন ভারত শর্ত সাপেক্ষে সীমান্তে ফ্ল্যাগ বৈঠকের অনুরোধে রাজি হলো, তখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক ঘণ্টার নোটিশে বিডিআরের মহাপরিচালকের পদ থেকে আ ল ম ফজলুর রহমানকে সরিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলেন। তার পেছনের অন্যতম কারণ ছিল ভারতের সর্বোচ্চ প্রশাসন চেয়েছিল রৌমারী ও পাদুয়ায় সংঘটিত এই দুই যুদ্ধের কারণে নিজ দেশের সর্বোচ্চ প্রশাসন থেকে বিডিআরের মহাপরিচালককে যেন সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়ে অপমানিত করা হয় এবং ভারতের ইচ্ছায় সেটাই করেছিলেন শেখ হাসিনা। তিনি একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধার অবদানকে অস্বীকার (চলবে)