সারা বিশ্বের চোখ এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। কারণ ৫ নভেম্বর মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বহুল কাক্সিক্ষত নির্বাচন। এই নির্বাচনে কে পরবেন বিজয়ের মালা- এ নিয়ে চলছে চুলছেঁড়া বিশ্লেষণ। আগামী চার বছরের জন্য কে হবেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্ণধার- এই অঙ্ক মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন দেশি-বিদেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষকেরা। কারণ নির্বাচন একেবারে দোরগোড়ায় হলেও কেউই অনুমান করতে পারছেন না কার জয়ের পাল্লা ভারী। বিভিন্ন জনমত জরিপও বলছে, বড় দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ডেমোক্র্যাটিক দলের কমলা হ্যারিস এবং রিপাবলিকান দলের ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, এবার কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নারী প্রেসিডেন্ট পাবে নাকি দ্বিতীয় মেয়াদে জয় পেয়ে ক্ষমতায় বসবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। হোয়াইট হাউসে যাওয়ার দৌড়ে কে এগিয়ে- সেই বিষয়ে নজর বিশ্ববাসীর। তাই শেষ মুহূর্তে ফলাফল কী হবে, সেটা সময়ই বলে দেবে।
এদিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ঘিরে শেষ মুহূর্তের প্রচারণা জমে উঠেছে। আটঘাট বেঁধে নেমেছেন দুই প্রার্থী। কমলা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্প উভয়েই প্রচারণায় ঘাম ঝরাচ্ছেন। দুজনই দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোকে টার্গেট করে ভোটারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছেন। এই পরিস্থিতিতে জমে উঠেছে কথার লড়াইও। নির্বাচনকে ঘিরে একে অপরকে বারবার আক্রমণ করছেন ট্রাম্প ও কমলা। এবারের নির্বাচনে প্রচার শুরুর পর থেকে বিভিন্ন সময় কমলাকে অযোগ্য বলে আখ্যা দিয়েছেন ট্রাম্প। কমলাও ছাড় দেননি। সর্বশেষ ট্রাম্পের সাবেক কর্মকর্তার বক্তব্য টেনে তাকে ফ্যাসিস্ট বলেছেন কমলা। এর জবাবে উল্টো ফ্যাসিস্ট তকমা কমলার গায়ে জুড়ে দিয়েছেন ট্রাম্প। আর কমলা বলছেন বিভক্তির রাজনীতিতে বিশ্বাসী ট্রাম্প।
অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে প্রায় সাড়ে চার কোটি ভোটার আগাম ভোট দিয়েছেন। ২৮ অক্টোবর প্রকাশিত এক তথ্যে দেখা গেছে, ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের আগে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪৫ মিলিয়ন বা সাড়ে চার কোটি আমেরিকান আগাম ভোট দিয়েছেন বলে একটি পর্যবেক্ষক সংস্থা জানিয়েছে। ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডার ইলেকশন ল্যাব প্রায় ৪ কোটি ৪০ লাখ ৮৭ হাজার ব্যালট গণনা করেছে। ডাকের মাধ্যমে বা ব্যক্তিগতভাবে সশরীরে উপস্থিত হয়ে ভোটাররা এ আগাম ভোট দিয়েছেন। যারা আগেভাগে ভোটকেন্দ্রে গেছেন এবং যারা তাদের ব্যালটে মেইল করেছেন, তাদের সংখ্যা প্রায় সমান। ৫ নভেম্বর মঙ্গলবার অর্থাৎ সপ্তাহের মাঝামাঝি সময়ে কর্মদিবস হওয়ায় অনেক ভোটার কেন্দ্রে যেতে পারবেন না। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে ভোটারদের আগাম ভোট দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো এই ভোট নিয়ে নিয়মিত জরিপ প্রকাশ করছে। আর সাম্প্রতিক জরিপ খানিকটা ডেমোক্র্যাট শিবিরকে চিন্তায় ফেলেছে। জাতীয় জরিপে গত ১৩ অক্টোবরও ট্রাম্পের চেয়ে সমর্থনে ২ শতাংশ এগিয়ে ছিলেন কমলা। তবে ২১ অক্টোবরে এসে সেই ব্যবধান ১ শতাংশে নেমে আসে। আর সর্বশেষ ২৮ অক্টোবরের তথ্য অনুসারে, এখন দুই প্রার্থীর সমর্থনে ব্যবধান ১ শতাংশ (ট্রাম্প ৪৮ শতাংশ ও কমলা ৪৯ শতাংশ)।
ফোর্বসের প্রতিবেদনে কয়েকটি জরিপের ফল তুলে ধরা হয়। এগুলোর কয়েকটিতে কমলা ও কয়েকটিতে ট্রাম্প এগিয়ে ছিলেন। ২৭ অক্টোবর প্রকাশিত এবিসি ও ইসসোসের জরিপে ৫১ শতাংশ পয়েন্ট নিয়ে ট্রাম্পের ৪৭ শতাংশের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন কমলা। একই দিন সিবিসি ও ইউগোপ তাদের জরিপের ফল প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, কমলা ও ট্রাম্পের ব্যবধান মাত্র ১ পয়েন্ট- যথাক্রমে ৫০ ও ৪৯ শতাংশ। সিএনএন ও এসএসআরএসের জরিপে কমলার চেয়ে ১ পয়েন্টে এগিয়ে ছিলেন ট্রাম্প। এ জরিপে ৪৮ শতাংশ ভোটার ট্রাম্পকে ও ৪৭ শতাংশ কমলাকে সমর্থন করেন। সিএনবিসির সাম্প্রতিক জরিপেও ২ পয়েন্টে এগিয়ে আছেন ট্রাম্প। এ অবস্থায় দুই প্রার্থীর জনপ্রিয়তা অনেকটা ভারসাম্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে অধিকাংশ রাজ্যের ভোটারের পছন্দ মোটামুটি ঠিকই থাকে। কোনো রাজ্য হয়তো ডেমোক্র্যাটদের দখলে, আবার কোনোটি রিপাবলিকানদের। রিপাবলিকান দুর্গ বলে পরিচিত অঙ্গরাজ্যগুলোকে বলা হয় ‘রেড স্টেট‘ বা ‘লাল রাজ্য’ আর ডেমোক্র্যাটদের প্রাধান্য পাওয়া স্টেটগুলোকে বলা হয় ‘ব্লু স্টেট‘ বা ‘নীল রাজ্য’। ফলে জয়-পরাজয় নির্ভর করে মূলত সাতটি দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যের ওপর। ভোট দরজায় কড়া নাড়লেও দুই প্রার্থী দোদুল্যমান এসব অঙ্গরাজ্যে তাদের মধ্যকার ব্যবধান কমিয়ে আনতে পারেননি। সত্যিকারের নির্বাচনী যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত সাত রাজ্য হলো উইসকনসিন, নেভাদা, পেনসিলভানিয়া, মিশিগান, নর্থ ক্যারোলিনা, জর্জিয়া ও অ্যারিজোনা। জরিপের ফলগুলো বলছে, এই সাতটি রাজ্যে দুই প্রার্থী একেবারে হাড্ডাহাড্ডি অবস্থানে রয়েছেন। সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, আধুনিক যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এত নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থায় আর দেখা যায়নি। নর্থ ক্যারোলিনা, অ্যারিজোনা ও জর্জিয়ায় সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন ট্রাম্প। এ ছাড়া উইসকনসিন, নেভাদা, পেনসিলভানিয়া ও মিশিগানে দুই প্রার্থী সমানে-সমান অবস্থানে রয়েছেন।
মার্কিন সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের নিজস্ব ভোট রয়েছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জটিল ইলেকটোরাল কলেজ-ব্যবস্থার অধীন প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্দিষ্টসংখ্যক ইলেকটর (নির্বাচক) থাকেন। ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ৪৮টির জন্য নিয়ম হলো- যিনি পপুলার ভোটে (সাধারণ নাগরিকদের ভোট) জিতবেন, তিনিই সে অঙ্গরাজ্যের সব কটি ইলেকটোরাল ভোট পাবেন, সেখানে পপুলার ভোটের ব্যবধান যত কমই হোক না কেন। নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে জয়ী হওয়ার জন্য ৫৩৮টি ইলেকটোরাল ভোটের মধ্যে ২৭০টি ভোট পেতে হয়। আর এ ক্ষেত্রে দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলো (সুইং স্টেট) বড় ভূমিকা পালন করে।
ট্রাম্পই হবেন পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট : আগামী ৫ নভেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ফের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হবেন বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্বের সেরা অর্থনীতিবিদ ক্রিস্টোপ বারুড। বিশে^র সবচেয়ে ‘নির্ভূল অর্থনীতিবিদ’ হিসেবে সুখ্যাতি রয়েছে বারুডের।
সমসাময়িক নানা প্রেক্ষিত ও বিভিন্ন বিষয় বিশ্লেষণ করে এমন দাবি করেছেন বারুড। মাইক্রো ব্লগিং সাইট এক্সে দেওয়া পোস্টে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘এখন পর্যন্ত বিভিন্ন মেটিক্স যেমন বেটিং মার্কেট, ভোট, নির্বাচনী মডেলারদের হিসাব-নিকাষ, অর্থনৈতিক বাজার দেখে যা বোঝা যাচ্ছে, তাতে নির্বাচনের ফলাফল হলো: ট্রাম্পের জয়। এবারের নির্বাচনে রিপাবলিকানরাই বিশাল ব্যবধানে জিততে যাচ্ছে।’
বারুড মোনাকোর কৌশলবিদ এবং প্রধান অর্থনীতিবিদ হিসেবে কাজ করছেন। তিনি গত ১২ বছরের মধ্যে ১১ বারই ব্লুমবার্গের অর্থনৈতিক পূর্বাভাস র্যাংকিংয়ের শীর্ষ অবস্থানে ছিলেন। বয়স মাত্র ৩৮ বছর হলেও অর্থনৈতিক বিষয়ক বিভিন্ন নির্ভূল পূর্বাভাস দিয়ে সাড়া ফেলেছেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রে ভোটের আর বাকি ৬ দিন। ইতিমধ্যে আগাম ভোট দিয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি ভোটার।
বারুড জানিয়েছেন, ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টি সিনেটের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারলেও মার্কিন প্রতিনিধি সভায় কমালা হ্যারিসের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সাথে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতে পারে।
বিজনেস ইনসাইডারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বারুড বলেন, ট্রাম্পের পরবর্তী আমল, সঙ্গে রিপাবলিকানদের হাতে সিনেটের নিয়ন্ত্রণ- এ দুটি মিলে অর্থনীতিতে অস্থায়ী উন্নতি দেখা যেতে পারে।
এদিকে আগামী ৫ নভেম্বর হবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এতে রিপাবলিকান পার্টির হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। অপরদিকে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির হয়ে লড়ছেন বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমালা হ্যারিস। নির্বাচনে যদি ট্রাম্প জেতেন তাহলে তিনি দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হবেন। অপরদিকে কমালা হ্যারিস জিতলে তিনি দেশটির প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হবেন।