জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে যোগ দিতে মাত্র চারদিনের সফরে নিউইয়র্কে এসেছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ও নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জাতিসংঘের ইতিহাসে এই প্রথম বাংলাদেশের কোনো সরকার প্রধান এত সংক্ষিপ্তভাবে সফর শেষ করলেন। অন্যদিকে সফর ছোট বা সংক্ষিপ্ত হলেও ড. ইউনূসের ঝুলিতে যোগ হয়েছে অনেকগুলো বড় সাফল্য, যা বাংলাদেশের জন্য আনন্দের ও গর্বের।
তবে, এই আনন্দের মাঝেও ড. ইউনূস প্রবাসীদের জন্য রেখে গেছেন এক বুক হতাশা। প্রবাসীদের কাছ থেকে তিনি দূরত্ব বজায় রেখেছেন। সাধারণ প্রবাসীরা মনে করছেন, ড. ইউনূসকে আলাদা করে রেখেছেন আমলা কূটনীতিকরা। তাদের কারণে নিউইয়র্কে প্রধান উপদেষ্টাকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া যায়নি। এমনকী জাতিসংঘে বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন তিনি। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানে প্রবাসীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এছাড়া বিদেশি বিভিন্ন মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দিলেও নিউইয়র্কে কর্মরত সাংবাদিকদের মুখোমুখি হননি প্রধান উপদেষ্টা।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় দুই কোটি প্রবাসী বসবাস করেন। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা শক্তিশালী হচ্ছে। বাংলাদেশের রিজার্ভে অগ্রণি ভূমিকা রাখছেন তারা। সম্প্রতি রেমিট্যান্সও বেড়েছে। অথচ রেমিট্যান্স যোদ্ধা হয়েও বিগত ৫০ বছরে প্রবাসীদের কোনো দাবিই পূরণ হয়নি।
প্রবাসীদের অভিযোগ-অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে দুই মাসের কাছাকাছি। সরকারের শুরুর দিকে ঢাকায় শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবাসীদের হয়রানি কিছুটা কমে ছিল। কিন্তু বর্তমানে হয়রানি করা না হলেও সেবার মান বাড়েনি মোটেও। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস পার হতে হচ্ছে প্রবাসীদের। এসব যেন দেখার কেউ নেই।
অতীতের রাজনৈতিক সরকারগুলো কখনোই প্রবাসীদের দাবির ব্যাপারে আন্তরিক ছিল না। প্রধান উপদেষ্টা নিউইয়র্কে আসবেন, এই খবরে আশায় বুখ বেধেছিলেন তারা। কত দাবি-দাওয়া লিখে রেখেছিলেন নির্দলীয় সরকার প্রধানের কাছে তুলে ধরবেন। কিন্তু প্রবাসীরা উপেক্ষিত থেকে গেছেন। কোনো প্রবাসী. এমনকী প্রবাসী ব্যবসায়ীদের সাথেও কোনো অনুষ্ঠানে দেখা করার সুযোগ দেননি তিনি। এসব নিয়ে প্রবাসীদের মনে পাহাড় সমান কষ্ট জমাট বেধেছে।
কী অর্জন করলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস : বাংলাদেশের সরকার প্রধান হিসেবে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে অংশ নিয়েছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এই সফরে তিনি বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানদের সাথে বৈঠকও করেছেন।
অধ্যাপক ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ ১২টি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং সাইডলাইনে ৪০টি উচ্চপর্যায়ের বৈঠকেও অংশ নেন। নানা কারণে প্রধান উপদেষ্টার এই সফরটিকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, নানা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের একপ্রকার সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছিল। এই সফরে সেই সংকট অনেকটাই কেটেছে। বিশেষ করে গণতন্ত্র, মানবাধিকারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশের যে ভাবমূর্তি সংকট ছিল, এই সফরে সেটা কাটানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিও তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
এই সফরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে দেশের বাস্তব চিত্র তুলে ধরা গেছে এবং তাদের কাছে আস্থার জায়গাটা তৈরি করা গেছে। এছাড়াও অর্থনৈতিক সংস্কারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিশ্রুতিসহ নানা কারণে এই সফরটিকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছেন তারা। তবে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ভারতের সাথে বাংলাদেশের নতুন সরকারের এক ধরনের সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছিল।
যুক্তরাষ্ট্র সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে বাংলাদেশের একটি বৈঠকের সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়নি সফরসূচীতে মিল না থাকায়। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিবেশী দু’টি দেশের সরকার প্রধানের মধ্যে এই মূহূর্তে একটি বৈঠক হলে তাতে সম্পর্কে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতো।
গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে এবারে জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দেয় বাংলাদেশ।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে মাত্র চার দিনের এই সফরে বাংলাদেশের সরকার প্রধান অধ্যাপক ইউনূসের বৈঠক হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোসহ ১২টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের সাথে। এছাড়াও বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট, আইএমএফের প্রেসিডেন্টসহ অধ্যাপক ইউনূস অংশ নিয়েছেন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদসহ ৪০টি উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অধ্যাপক ইউনূস এই সফরে বিভিন্ন ইস্যুতে যে সব মিটিং করেছেন তা বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের অনেক সম্ভাবনাকে বাস্তবায়নের পথে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে বলেও মনে করছেন এই কূটনীতিক।