আর পাব না, কখনো আর ফিরে পাব না, হাজার চেষ্টা করেও আর সম্ভব হবে না, আর কখনো মনভরে মা বলে ডাকতে পারব না।
কী মধু যে জীবন থেকে হারিয়ে ফেলেছি। হঠাৎ মায়ের কথা মনে পড়লে চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ে। কত ফুঁপিয়ে কাঁদি, মনের অজান্তে চোখে চলে আসে পানি। হাউমাউ করে জোরে জোরে কাঁদি। মাথায় হাত রেখে কাঁদি। বুকে থাপ্পড় মেরে কাঁদি। রুমাল দিয়ে চোখ মুছি। আবারও চোখে এসে যায় পানি। কত মনে পড়ে যায় মায়ের স্মৃতি। মায়ের মুখখানি অন্তরে জেগে উঠলে অন্তর ছটফট করে। মনে হয় এখনই মায়ের সঙ্গে কথা বলে আসি।
আমি মা বলে ডাক দেব আর মা উত্তর নেবে। মাকে পেলে কত খুশি হব। আমি এ ঘর খুঁজে আরেক ঘরে খুঁজতে যাব মাকে। মাকে খুঁজে না পেলে জোরে জোরে মা বলে ডাক দেব। আর মা আমাকে ডেকে বলবে, খোকা, আমি এইখানে। এখানে আয় রে বাজান। প্রাণভরে মায়ের মুখ দেখব।
মনে জমা আছে যত কথা, একটাও আর বাদ রাখব না। সব কথাই ব্যক্ত করব। মাঝে মাঝে হো হো করে হেসে দেব। হাসি শেষ না হতেই আবার হাসব। হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে যাবে।
অনেক পানির পিপাসা লাগবে। মাকে বলব গ্লাস দিতে। মা আমার পিপাসা পেয়েছে বুঝতে পেরে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দেবে, পান করে কলিজা ঠান্ডা করে ফেলব। ও মা, ও আমার মা, শুধু তোমাকে মনে পড়ে আর মনে পড়ে।
পৃথিবী অন্ধকার মনে হয় মা তোমাকে ছাড়া। বড় একটা হাই তুলে মা বলে জোরে জোরে কয়েকবার ডাকি, এরপর একেবারে নিশ্চুপ হয়ে যাই। মন আকুলি-বিকুলি করে। ভাবি, কোথায় গেলে তোমায় পাব। তুমি যদি একবার আমার দিকে তাকাও, কলিজা যাবে জুড়ে। মা, আমার হৃদয়মাঝে যে সাগর ছিল, তা শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে তুমি না থাকায়। গা কাঁপে, পা কাঁপে, হাত কাঁপে থরথর করে, গলা শুকিয়ে আসে, একটুও ভালো লাগে না মা।
আকাশের দিকে চেয়ে কী যে ভাবি, কিছুই বুঝি না। তুমি বেঁচে থাকতে আমি কখনো ভাবতে পারিনি মা, তুমি এত দামি। আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আমার হাসি গেছে মরে, থাকি প্রায়ই মন খারাপ করে। ভালো পোশাক, ভালো খাবারÑকোনো কিছুই আর ভালো লাগে না। বাইরে থেকে বাসায় এসে সবার আগে মা তোমাকে ডাক দিতাম। তুমি না থাকায় সবকিছু শূন্য লাগে। সেই ঘর আছে, সেই খাট আছে, তোমার ব্যবহৃত কত জিনিসও পড়ে আছে। ওইগুলো দেখে আরও বেশি মন কাঁদে। ইশ্্, উহ্্, আহা! কত শব্দ করি। চোখ আমার হয়ে যায় নদী। দুঃখ হয় আমার নিত্যদিনের সাথি। মাথা নিচু করে বসে থাকি আর তোমার কথা ভাবি।
মায়ের মতো এত আপন পৃথিবীতে আর কেউ নেই। মায়ের সঙ্গে কথা বললে মন আনন্দে যায় ভরে। হঠাৎ করে যদি মন খারাপ হয়ে যায়, কোনো কিছু যদি ভালো না লাগে, মায়ের সঙ্গে কথা বললে মন যায় ভালো হয়ে।
কেউ যদি মা বলে ডাক দেয়, আমার প্রাণ কেমন যে ছটফট করে। মনের মধ্যে ঝড় ওঠে। হঠাৎ মনমানসিকতা যায় পরিবর্তন হয়ে। ভাবি, মা যদি বেঁচে থাকত, কত মা বলে ডাকতে পারতাম। মায়ের বয়সী নারীদের দেখলে মায়ের কথা বেশি মনে পড়ে। তাদের দেখে মাথা নত হয়ে যায়। তাদেরকে মায়ের মতো শ্রদ্ধা-ভক্তি করতে ইচ্ছা জাগে। সবকিছুর বিকল্প হলেও মায়ের কোনো বিকল্প হয় না।
তাই মা বেঁচে থাকতেই তার যত্ন নিতে হবে। বিশেষ করে, বৃদ্ধ বয়সে বেশি বেশি দেখাশোনা করতে হবে। নিজে না খেয়ে যে সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেয়, তার নাম মা। সন্তান অসুস্থ হলে না ঘুমিয়ে তার পাশে রাত জেগে বসে থাকে মা। মা একটা শিশুর জন্য যে কষ্ট করে, পৃথিবীর কেউ আর এমন কষ্ট করে না। মা একটা শিশুকে ১০ মাস ১০ দিন পেটে রাখে। এ সময় সে যে কী কষ্ট করে। ব্যথায় কত ছটফট করে। কত মা সন্তান প্রসব করতে গিয়ে যায় মরে। মায়ের ঋণ কোনোভাবেই শোধ করা যায় না।
ছোটবেলায় একটা শিশু কতই না অসহায় থাকে। তার সব কাজ মা করে দেন। ছেলেমেয়েরা সারা জীবন মায়ের কাছে শিশুই থাকে। ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলেও মা কত চিন্তা করে। বাইরে থেকে বাসায় না আসা পর্যন্ত রাত জেগে থাকে। ছেলেমেয়েদের উন্নত জীবনের জন্য চেষ্টার ত্রুটি রাখে না। ছেলেমেয়েরা ভালো কিছু করলে মায়ের আনন্দ কে আর ধরে রাখে।
কত পেপার-পত্রিকায় আসে, মায়ের সঙ্গে ছেলেমেয়েরা খারাপ আচরণ করে। নিয়মিত খাবার খেতে দেয় না, এমনকি বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়। এটা কত বড় লজ্জাকর।
ও মা, তোমার জন্য মন কাঁদে। আজ কয়েক বছর কবরবাসী হয়েছ, তোমাকে আর দেখতে পারি না। তোমার মুখে বাজান ডাক আর শুনি না। অহরহ তোমার কথা মনে পড়ে। কাঁদি আর কাঁদি, শেষ হয় না আর চোখের পানি।
মা নিয়ে আছে কত গান। মায়ের গানগুলো শুনলে গা শিউরে ওঠে। মা সম্বন্ধে গানগুলো মা থাকতেও কত শুনেছি, তখন হৃদয়ে এত দাগ কাটেনি। কিন্তু মা মরে যাওয়ার পর মা সম্বন্ধে গান শুনলেই মনে হয়, আমি কোথায় যেন শূন্যে ভাসছি। আমার হাতে-পায়ে একটু শক্তিও নেই। কখন যেন মাটিতে হেলে পড়ে যাব। গানের কলি শুনলেই মনে হয় গা শিরশির করছে। যখন গানে শুনি ‘মায়ের মতো আপন আর কেউ নাই’, তখন মর্মে মর্মে তা উপলব্ধি করি। শুধু মনে পড়ে মায়ের স্মৃতি।
মায়ের মতো বড় জ্যোতির্বিজ্ঞানী পৃথিবীতে আর কেউ নেই। মন খারাপ থাকলে মা কীভাবে যে টের পায়। কাছে এসে আদরের হাত মাথায় বুলিয়ে দেয় আর শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, তোর মন কি খারাপ, কী হয়েছে বাজান? কোনো কিছু নিয়ে এত চিন্তা করবি না, আমি আছি, বাজান। আমি যদি অসুস্থ হয়ে বেডে পড়ে থাকতাম, মায়ের খাওয়াদাওয়া সব বন্ধ হয়ে যেত। কী করবে আর কী করবে না, ভেবে পেত না। এই এটা খা, ওটা খা। কাঁথা গায়ে দে। মাথায় পানি দিত। ঔষধি গাছের পাতার রস মাথায় দিত। রাই বেঁটে দিত। মাথায় জলপট্টি করে দিত। ঝাড়-ফুঁক দিত, হুজুরের কাছ থেকে পানি পড়ে আনত। তাবিজ ভরে এনে হাতে বেঁধে দিত। মুখে রুচির জন্য লেবুর রস খাইয়ে দিত। আম ও বরই আচার খেতে দিত। করলা ভাজি দিয়ে ভাত খেতে দিত। কত কী যে করত!
একবার মনে পড়ে, গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে মা মা করে এমনি কয়েকবার করে ডাকছি আর মা ঘুম থেকে উঠে তাড়াতাড়ি আমার কাছে চলে এসেছে। আরও মনে পড়ে, একবার হাতে ছেঁচা খেয়ে যেই মাকে বলছি আর মা কাছে ছুটে এসেছিল।
আমার সেই মা জননী কোথায় এক নিঝুম পরিবেশে ঘুমিয়ে রয়েছে। মা কীভাবে হঠাৎ না ফেরার দেশে পাড়ি দিল। প্রবাস-জীবন এক নিষ্ঠুর জীবন। এমনিই কত কষ্ট-বেদনার মধ্যে দিন পার হয়। এরপর দেশ থেকে যদি দুঃসংবাদ আসে কেমন যে লাগে আর যদি মায়ের মৃত্যুসংবাদ আসে, তাহলে যাই পাগলের মতো হয়ে। মনে হয় বিদেশ থেকে এখনই দেশে যাই চলে। কিন্তু যাওয়া আর হয় না। মায়ের ছবি চোখে ভেসে ওঠে।
মা মা বলে কত আকুলি-বিকুলি করি। কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলি। চোখ যায় লাল হয়ে। চার দেয়ালের মাঝখানে বসে কত ছটফট করি। কত কথা ভাবি। একবার ছুটে যাই এদিকে আবার ছুটে যাই ওদিকে। কোনো কিছু খেতে ইচ্ছা করে না। একটুও ভালো লাগে না। শুতে গেলে ঘুম ধরে না, বসে থাকতেও ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে জোরে জোরে হাই তুলি। মায়ের কথা মনে করে হাউমাউ করে কাঁদি। দুঃখ আর শেষ হয় না।
দেশে গেলেও ভালো লাগে না। মাকে দেখতে না পেরে দুঃখ যায় শতগুণে বেড়ে। মনে পড়ে কী হারালাম জীবনে। যেখানে যাই নিঃসঙ্গ মনে হয়। মায়ের কবরের কাছে গেলে বুক যায় ফেটে। মা মা বলে কত ডাকি। মনের দুঃখে কত কথা বলি। মা, তুমি এখনই কবর থেকে উঠে এসো, আমি তোমার খোকা।
মা একটা কথাও বলে না, কোনো সাড়াশব্দও দেয় না। দোয়া-দরুদ পড়ে প্রভুর দরবারে মোনাজাত করি। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে পানি, ও আমার মা জননী।
মা থাকতে বুঝিনি, মা পৃথিবীর কী অমূল্য রতন। এখন শুধু মায়ের কথা মনে পড়ে আর মনে পড়ে।