হিংসা-প্রতিহিংসার ভেতর থেকেই হিংস্রতার উৎপত্তি। রাষ্ট্রপুঞ্জের ক্ষমতা কিংবা সামাজিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে আধিপত্য বিস্তারের জন্যই মানুষ ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়। বাংলাদেশের অবক্ষয়ী সমাজের ভেতর হিংস্রতার কোনো শেষ নেই এবং মনে হয় কখনো শেষ হবে না। হিংস্রতা শুধু যে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘটেছে, তা নয়। সর্বস্তরের মানুষের মধ্যকার লোকের মধ্যে এমন কিছু হিংস্রক আছে, যারা হন্তারকের ভূমিকা পালন করে। তাদের পশুত্ব, বর্বরতা ও পাশবিকতা মধ্যযুগের বর্বরতাকেও হার মানায়। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ছত্রচ্ছায়ায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক জীবনের বাইরেও শিক্ষাঙ্গনে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, হিংস্রতা ও পাশবিক নির্যাতনের বহু ঘটনা চলে আসছে দীর্ঘকাল থেকে।
স্বাধীনতার পর থেকে পর্যায়ক্রমে প্রতিটি বছর ও দশকের ভয়ংকর হিংস্রতা ও পাশবিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। কিছু মানুষের বিবেকবর্জিত কার্যকলাপ এবং নির্দয় আচরণ একটি মানবিক ন্যায়পরায়ণতাসম্পন্ন সমাজকে ধ্বংসের মুখোমুখি করে। অন্ধ, নির্বোধ আত্মতৃপ্তির খোরাক হিসেবে প্রতিহিংসাকে বেছে নেয় এবং মানুষের ওপর বর্বর পাশবিকতার মাধ্যমে নিষ্ঠুর উন্মাদনায় মেতে ওঠে। দম্ভ-দাম্ভিকতায় ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সামগ্রিক ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তারের জন্য নিষ্ঠুরতম পাশবিকতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়। বর্তমান বিশ্বে হত্যার প্রতিকারে হত্যা, রক্তের প্রয়োজনে রক্তস্রোত বইয়ে দেওয়ার ভয়ংকর প্রতিযোগিতা চলছে। স্বার্থান্বেষণে মানুষ যেকোনো কিছুই করতে পারে। দয়া-মায়া, প্রেম-প্রীতির পরিবর্তে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালিয়ে একে অপরের ওপর আধিপত্য বিস্তার করাই তাদের কাছে মুখ্য।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে প্রতিটি সরকারের সময় আধিপত্যবাদের হিংস্র থাবা পরিলক্ষিত হয়েছে। তবে বিগত সরকারের প্রতিহিংসা ও নিষ্ঠুরতম হিংস্রতা সর্বকালের পরিস্থিতিকে হার মানিয়েছে। গুম, হত্যা, নির্যাতন, নিপীড়নমূলক দমন-পীড়ন এবং বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও সহিংসতা বীভৎস রূপ ধারণ করেছিল। শিক্ষাঙ্গন থেকে শুরু করে সমাজের সর্বত্র আইনকে নিজের হাতে কুক্ষিগত করে চরম নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারে জঘন্য ঘটনাবলির অবতারণা করেছিল। নির্মমতার চরম পর্যায়ে বহুমাত্রিক অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। কয়েক বছর আগে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মেধাবী তরুণ ছাত্র আবরারের ওপর রাতব্যাপী পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে। এমন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই, যেখানে দলীয় ছাত্র নামধারী সন্ত্রাস ছিল না। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের প্রতি বর্বর নির্যাতনের বহু ঘটনার অবতারণা ঘটানো হয়েছিল। সর্বত্রই বখাটে ছাত্রনেতাদের আধিপত্য ও নিপীড়ন বলবৎ ছিল।
যা-ই হোক, তাদের পতনের পর দেশে আইনশৃঙ্খলার যথেষ্ট অবনতি ঘটে। চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর যখন প্রশাসন এবং সমস্ত আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে, তখন দেশপ্রেমিক ছাত্র-জনতা ট্রাফিক কার্যক্রমসহ বিভিন্ন জনহিতকর কাজে স্বেচ্ছাশ্রম নিয়োগ করেছেন। এরই মধ্যে মহাপ্রলয়কারী বন্যায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ছাত্র-জনতাসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
এর মধ্যেও সুবিধাবাদী চক্র থেমে নেই। চতুর্দিকে ষড়যন্ত্রের ফণা তোলার চেষ্টা করছে। চক্রান্তকারীদের রাষ্ট্রপুঞ্জে বিভিন্ন অজুহাতে নানা রকম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে দেশব্যাপী শান্তি বিনষ্টের অপচেষ্টাও চলছে। অন্যদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল জনতা বিচারের নামে আইনকে নিজের হাতে তুলে নিয়ে নিষ্ঠুর পাশবিকতা প্রদর্শন করছে।
এরই মধ্যে পত্রিকায় দেখলাম, ৪০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত দাগী খুনি ও সন্ত্রাসী আসামিও ইতিমধ্যে মুক্ত হয়ে জেল থেকে বেরিয়ে গেছে। চতুর্দিকে সন্ত্রাস ও অপরাধপ্রবণতা ফেনিয়ে উঠছে। পুলিশ তাদের আগেকার নিষ্ঠুরতম কার্যক্রমের যবনিকা টেনে কর্মে যোগদান করেছে এবং সরকারি বেতন-ভাতাও নিচ্ছে। কিন্তু ঠিকঠাকমতো দায়িত্ব পালন করছে না। ফলে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতায়ন ঘটিয়ে সারা দেশে সেনাবাহিনী নিয়োগ করা হয়েছে! কার্যত ভালো উদ্যোগ হলেও সন্দেহ দানা বেঁধে উঠছে অনেকের মাঝে। জনমনের সন্দেহ, উৎকণ্ঠা দূরীকরণে এসব বিষয় খোলাসা করা প্রয়োজন।
সাম্প্রতিক কালের বেশ কিছু নির্মম ও নিষ্ঠুর কার্যক্রমের অবতারণা সবাইকে উৎকণ্ঠিত করে তুলেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকজন শিক্ষার্থী ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে চোর সন্দেহে এক যুবককে ধরে ফজলুল হক মুসলিম (এফএইচ) হলের অতিথিকক্ষে নিয়ে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। একপর্যায়ে বিরতি পর্বে ‘তোফাজ্জল হোসেন’ নামের সেই যুবককে হলের ক্যানটিনে রাতের ডিনার খাওয়ানো হয়। তারপর কী ধরনের ভয়ংকর নিষ্ঠুরতার মাধ্যমে লোকটিকে রাতভর নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। কী বীভৎসতা (!) ও অসভ্যতা? এটা মানবতার চরম বিপর্যয়! আমাদের বিবেক আর কত প্রতারিত হবে? কী করছে কর্তৃপক্ষ, কী তার বিচারব্যবস্থা। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে এসব অরাজক পরিবেশ দূরীকরণে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে পরিস্থিতি আবারও ভয়ানক খারাপের দিকে যাবে।
একই রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একদল শিক্ষার্থী শামীম মোল্লা নামের ছাত্রলীগের এক নেতাকে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে। এরই মধ্যে খাগড়াছড়িতে মোহাম্মদ মামুন নামের এক ব্যক্তিকে মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া গত ৭ সেপ্টেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। জানি না, এসব কোন ধরনের (মব জাস্টিস) উন্মত্ত উচ্ছৃঙ্খলতা, যা আবারও জনমনে উৎকণ্ঠা ও ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করেছে!
স্বৈরাচারের পতনের পর চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী অশান্ত দিনগুলোতে রাজনৈতিক সহিংসতার জের হিসেবে কিংবা বিভিন্ন স্থানে আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের সংঘটিত অপরাধমূলক হত্যাকাণ্ডকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক সংঘাত এবং দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কেউ কেউ দখল প্রক্রিয়ার উগ্র প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে।
স্বাধীনতার পর দীর্ঘকালীন রাষ্ট্রতান্ত্রিক বৈষম্য ও নিপীড়ন চলে আসছে। চাকরি-বাকরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ হিসেবে ছাত্র-জনতার বিপ্লব সংঘটিত হয়ে গেল এবং শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলো।
বিগত বছরসমূহে রাষ্ট্রীয় শোষণ-নিপীড়নে অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানির মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জনমনে কিছুটা স্বস্তির ছোঁয়া দেখা গেলেও পরক্ষণে দেখছি আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং নানা রকম রাজনৈতিক ও সামাজিক সংঘাতের অশুভ ঘটনার বহিঃপ্রকাশ! কোনো কোনো স্থানে প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে কীভাবে কতিপয় নিষ্ঠুর লোক এখনো এতটা পাশবিক হয়ে উঠতে পারে এবং আইনকে নিজ হাতে তুলে নিয়ে ভয়ংকর অপরাধে মেতে থাকতে পারে (?), তা বোধগম্য নয়। সমাজের একশ্রেণির দুষ্টচক্র আগেকার অরাজকতার কথা ভুলে গিয়ে যে যার শক্তিবলয়ে রোজকার জীবন চালানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু জনগণ তো নিজেদের মধ্যে বিপদ টেনে আনতে চায় না। মানুষ অরাজকতা চায় না। তারা চায় শান্তি ও স্বস্তিকর নিরাপদ জীবনযাপন করতে।
গত সরকারের আমলে করা দুঃশাসন, নিপীড়ন-নির্যাতন ও অন্যায়-অপরাধের বিচার অবশ্যই চায় সাধারণ মানুষ। কিন্তু আইন নিজের হাতে তুলে নিতে চায় না। আগের মতো প্রতিহিংসার তাড়নায় অথবা স্বার্থরক্ষার হিসাব-নিকাশে করা বিচার-বহির্ভূত হত্যা বা নিপীড়ন-নির্যাতন দেখতে চায় না। গণ-অভ্যুত্থানে বিজয়ের ফসল অন্তর্বর্তী সরকার এবং সেটার অংশী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ সমন্বয়কেরা ‘মব জাস্টিস’-এর বিরুদ্ধে কড়া অবস্থানের কথা বলে আসছেন। তাই যারা আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা জরুরি। বেশ কিছু ঘটনায় অবশ্য মামলা বা আইনি প্রক্রিয়ায় আটক শুরু হয়েছে। সবার আগে অবশ্যই প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন, সত্যিকার অপরাধী চিহ্নিত করে কঠোর বিচারকাজ ও অপরাধীর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষার্থীরা এমন হত্যার প্রতিবাদে এবং বিচার চেয়ে রাস্তায় নেমেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সোচ্চার হচ্ছেন। আশা করি, তরুণ ছাত্রসমাজ ক্রমাগত আরও বেশি প্রতিবাদী হয়ে উঠবেন। সবার দাবি শান্তি ও স্বস্তির পরিবেশ। সবাই চায় খোলা আকাশের নিচে মুক্ত বাতাস ও হাওয়ায় নির্ভয়ে শ্বাস নিতে। প্রাণখুলে সবার সঙ্গে মিলেমিশে চলাফেরা করতে। দেশব্যাপী শান্তিশৃঙ্খলা ফিরে আসুক। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে অর্থনৈতিক শক্তি ফিরে আসুক। তা-ই আজকের প্রত্যাশা।
লেখক : কবি ও কলামিস্ট