Thikana News
২১ নভেম্বর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

রাজনৈতিক আদর্শ যার যার-ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ সবার

রাজনৈতিক আদর্শ যার যার-ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ সবার
মাহমুদ রহমান


জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক অনেক ভুলের মধ্যে সাম্প্রতিক কিছু চমকপ্রদ কাজ ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশে বিচক্ষণতার পরিচায়ক হিসেবে দীর্ঘদিন আলোচিত হবে। এর একটি হচ্ছে আগস্টের প্রথম দিন শেখ হাসিনার সরকার জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করেছিল মূলত ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। জামায়াত সরকারের এই ফাঁদে পা না দিয়ে নীরব থেকে আন্দোলনকে সহায়তা করেছে। জামায়াত তাদেরকে নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলনে রাস্তায় নামলেই মূল আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেত সরকার।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রশিবিরের ছেলেরা দলীয় পরিচয় গোপন রেখে বিভিন্ন স্তরে নেতৃত্ব দিয়ে গেছে। শহীদ আবু সাঈদ শিবিরের সাথি ছিল, যা সে জীবিত অবস্থায় প্রকাশ করেনি। কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক সাদিক কায়েম শিবিরের ঢাবি শাখার সভাপতি, যা সে এখন প্রকাশ করেছে। কৌশলগত কারণে আন্দোলনের সময় প্রকাশ করেনি।
অন্য সমন্বয়কেরা যখন ডিবি হেফাজতে, তখন সাদিক কায়েম সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের ভাইয়ের সহযোগিতা নিয়েছে সালমান নামে। জুলকারনাইন অভিভূত ওই সময়ে সাদিক কায়েম ওরফে সালমানের নেতৃত্বগুণ এবং কঠিন এ সময়ে পুরো আন্দোলনের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ দেখে, যা তিনি একটি ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এত গোছালো নেতৃত্ব, কর্মসূচি দেখে প্রথম থেকেই মনে হয়েছিল, কোনো সংগঠিত শক্তি এর পেছনে রয়েছে। গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি সম্ভবত সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল নেতৃত্ব পর্যায়ে। এ ছাড়া ছাত্রশিবির ও ছাত্রদল তো রয়েছেই। সবাই যার যার দলের নাম গোপন রাখার কারণে মাঠের আন্দোলনে ইস্পাতকঠিন ঐক্য হয়েছিল। ফ্যাসিবাদের দোসর বিদেশি শক্তিগুলো ২০১৪ সালের পর থেকে এই ঐক্য যাতে না হয়, সেভাবে কাজ করে যাচ্ছিল এবং তারা ২০২৪ এর নির্বাচন পর্যন্ত এ কাজে সফল ছিল। চব্বিশের নির্বাচনের পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিদেশিদের এই খেলা বুঝতে পেরে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের জন্য কাজ করতে আগ্রহী হয়েছিলেন বলে মনে হচ্ছিল। বিএনপি সবার সঙ্গে ঐক্যের আহ্বানে বিশেষভাবে জামায়াতের নামও উল্লেখ করেছিল, যা তারা বিগত ১০ বছর করেনি বিদেশিদের প্রতারণার ফাঁদ বুঝতে না পেরে। কোটাবিরোধী আন্দোলন সেই সুযোগ নিয়ে আসে ছাত্রদের মাধ্যমে। সব দল নিখুঁতভাবে যার যার অবস্থান থেকে ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা নিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছাত্রদল, ছাত্রশিবিরসহ সব ছাত্রসংগঠন তাদের দলীয় পরিচয় প্রকাশ না করে আন্দোলন করার কৌশল ছিল সত্যিই বিপ্লবী সিদ্ধান্ত। পুরো জাতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী সকল সমন্বয়ককে সারা জীবন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ রাখবে তাদের সাহস, কৌশল এবং দৃঢ়তার জন্য। তারা এ ভূমিকা না নিলে জাতি কবে মুক্তি পেত, তা এ মুহূর্তে বলা কঠিন।
কিন্তু সাংবাদিক সাহেদ আলম কেন এ কৌশলকে পছন্দ করছেন না? তিনিও তো ফ্যাসিবাদ থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য অনেক কাজ করেছেন। কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক সাদিক কায়েম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সভাপতিÑএ পরিচয় প্রকাশিত হওয়ার পর কেন তাকে ‘মোনাফেক’ গালি দিচ্ছেন। সাহেদ আলমের এ অবস্থানকে প্রশ্ন করেছেন সাংবাদিক মনির হায়দার ভাই। তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, তাহলে কি শিবিরের নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদমুক্ত হওয়ার চেয়ে হাসিনার শাসনই ভালো ছিল? সাহেদ আলম ভাই হয়তো রাজনৈতিক বিরোধিতার চেয়ে কোনো কারণে শিবিরের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা পোষণ করেন। কোনো মানুষ যখন কাউকে প্রচণ্ড ভালোবাসে কিংবা প্রচণ্ড ঘৃণা করে, তখন হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে তার সম্পর্কে মন্তব্য করে থাকে। সাহেদ আলম ভাইয়ের এ স্ট্যাটাস খুবই আপত্তিকর ও আন্দোলনকারীদের প্রতি অবমাননাকর। আশা করি, তিনি স্ট্যাটাসটি প্রত্যাহার করে তার নিজের প্রতি সুবিচার করবেন।
সৃষ্টিজগৎ নিয়ে অনেক চিন্তাবিদ মনে করেন, সব সৃষ্টি এমনি এমনি প্রাকৃতিকভাবে হয়েছে। এর পেছনে কোনো পরিকল্পনা বা স্রষ্টা নেই। একইভাবে ফ্যাসিবাদের পতনে সৃষ্ট আন্দোলন নিয়েও অনেকের মতামত, এগুলো সাধারণ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হয়েছে। এর পেছনে কোনো রাজনৈতিক দলের ভূমিকা নেই। এই আন্দোলন এমনি এমনি হয়েছে। পড়ার টেবিল থেকে বের হয়ে সাধারণ ছাত্ররা আন্দোলন করেছে। শ্রমিক-জনতা এমনি এমনি রাস্তায় এসেছে, যেভাবে বিকেলে পার্কে বেড়াতে যায়। আর তাদের দেখেই জগদ্দল পাথরের মতো জাতির ওপর চেপে বসা স্বৈরাচার পালিয়েছে। বাস্তবে তা নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর দীর্ঘদিনের আন্দোলন ও সরকারের নির্যাতনে ছাত্র-জনতা উন্মুখ ছিল সরকার পতনের আন্দোলনের জন্য। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের অনৈক্য ও বিদেশি শক্তির ষড়ষন্ত্রের কারণে সঠিক নেতৃত্বের মাধ্যমে জনগণকে রাস্তায় নামানোর পরিবর্তে পারস্পরিক অবিশ্বাস জিইয়ে রেখেছিল। সরকারও কেউ আন্দোলনে নামলে রাজাকার, শিবির এগুলো ট্যাগ দিয়ে আন্দোলনকে দমাতে সক্ষম হতো।
এবারের আন্দোলনের শুরুতেই ছাত্ররা ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার রাজাকার’ এই আইকনিক স্লোগানের মাধ্যমে সরকারের সেই অস্ত্রকে প্রথমেই অকেজো করে ফেলে। তারপর শহীদ আবু সাঈদের গৌরবোজ্জ্বল জীবনদান আন্দোলনের মাত্রাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। এরপর দেশের মানুষের বাঁধভাঙা জোয়ারে সরকারের ভেসে যাওয়া সময়ের ব্যাপার ছিল। এ জনজোয়ারকে গণভবনে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে সকল ছাত্রসংগঠন যার যার অবস্থান থেকে সাধারণ ছাত্রের ব্যানারে কাজ করেছে।
আন্দোলন শেষে বিজয়ের পর আর সেই কৌশলের দরকার নেই। বিএনপি ও ছাত্রদল আন্দোলনের শহীদদের মধ্যে তাদের চার শতাধিক নেতাকর্মীর তালিকা প্রকাশ করেছে। ঢাবি শিবিরের সভাপতিও তার দলীয় পরিচয় প্রকাশ করেছে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কাউকে গালি দেওয়ারও দরকার নেই। কয়েক ডজন দলের নেতাকর্মীরা জীবন দিয়েছে। যার যার এলাকায় নেতৃত্ব দিয়েছে। আন্দোলনের সময় সবাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সাধারণ ছাত্র-জনতা ছিল। বিজয়ের পর যার যার ঘরে ফিরে যাবে, এটাই স্বাভাবিক।
এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অস্বাভাবিকতা খুঁজে আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার পেছনে যারা কাজ করছে, তারা মূলত বিপ্লবকে বেহাত করতে চায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা নতুন দল করে বিএনপিকে ক্ষমতার বাইরে রাখার অবাস্তব চিন্তা করছে বলে কেউ কেউ ভাবছেন। আবার বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে অবিশ্বাসের বীজ রোপণ করা হচ্ছে অত্যন্ত কৌশলে। বিতাড়িত শয়তান বৈষম্যবিরোধীদের বলছে, তোমরাই আসল কাজ করেছ। ওরা তো ১৬ বছরে কিছুই করতে পারেনি। অতএব, ক্ষমতার হকদার তোমরা। জামায়াতকে বলছে, কেন্দ্রীয় নেতাদের জুডিশিয়াল কিলিংয়ের মাধ্যমে দল হিসেবে তোমরাই সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছ। এই আন্দোলনেও তোমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব নেতাই মূল কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে। পরিবর্তিত সময়ে জনগণ তোমাদেরই চায়। আবার বিএনপির কাছে গিয়ে বলছে, তোমরাই দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। জামায়াত আর সাধারণ ছাত্ররা কিছুই না। এগুলো ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা। তোমরা ছাড়া ওরা রাস্তায় ফেউ ফেউ করে ঘুরবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বিতাড়িত শয়তানের কুপ্ররোচনায় তিন দলই কিছুটা পা দিয়েছে। বাস্তবে এই তিন গ্রুপের মধ্যে ঐক্য না হলে দেশ এবং আন্দোলনকারী সব পক্ষই চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। লাভবান হবে দেশবিরোধী শক্তি।
অতএব, সবারই উচিত বিতাড়িত শয়তানের ফাঁদে পা না দেওয়া। রাজনৈতিক দলগুলোর বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টি সবচেয়ে বেশি দরকার। বর্তমান সরকারকে সফল করার জন্য দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে বিএনপি, জামায়াত, হেফাজতসহ সকল ডান ও বাম দলের একযোগে কাজ করা উচিত, যেভাবে হাসিনার পতনের আন্দোলনে কাজ করেছে। নতুন রাজনৈতিক দল করার পরিবর্তে বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর কোন কোন ক্ষেত্রে সংস্কার করা দরকার, তা নিয়ে ছাত্ররা চিন্তা করলে দেশ উপকৃত হবে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তার বক্তব্যে যে সংস্কার এবং জাতীয় সরকারের কথা বলেছেন, তা নিয়ে কাজ করা উচিত। বড় দল হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় সরকারের ঘোষণা জনাব তারেক রহমানের একটি বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত। জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কারকে সহযোগিতা করে সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে একটি সর্বদলীয় সরকার গঠনই হোক সবার আলোচনার বিষয়। শত শত ছাত্র-জনতার জীবনের বিনিময়ে পাওয়া এ বিপ্লবকে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে বেহাত হতে দিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বর্তমান নেতাদের ক্ষমা করবে না।
স্বনামে বা বেনামে, পরিচয় গোপন রেখে বা প্রকাশ করে যেকোনো কৌশলে যে যে অবস্থান থেকে বাংলাদেশকে ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে উদ্ধারের জন্য আন্দোলন করেছে, তাদের সবাইকে সম্মান করি। ঢাবি শিবিরের সভাপতি সাদিক কায়েম, ছাত্রলীগ থেকে আসা সারজিস-হাসনাত কিংবা ছাত্রশক্তির নাহিদ-আসিফ যেই হোক, মুক্তির আন্দোলনে তাদের অবদানকে জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। আদর্শ যার যার-ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ সবার।
লেখক : রিয়েলটর ও মর্টগেজ ব্যাংকার, মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্র।
 

কমেন্ট বক্স