বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ঢাকা-নিউইয়র্ক-ঢাকা রুটের ফ্লাইট চালুর ব্যাপারে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রও এ বিষয়ে কাজ করছে। তবে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত প্রয়োজনীয় সব কাজ সম্পন্ন করতে না পারায় এই রুটে ফ্লাইট চালু হচ্ছে না।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাষ্ট্র সফরে এসেছেন। প্রধান উপদেষ্টা ও তার সফরসঙ্গীদের বহনকারী কাতার এয়ারওয়েজের বাণিজ্যিক একটি ফ্লাইট যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় ২৩ সেপ্টেম্বর সোমবার রাত ১০টা ১০ মিনিটে নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। ২৪ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশন শুরু হয়। এতে যোগ দেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাকে স্বাগত জানান জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। ড. ইউনূস ২৭ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টায় (নিউইয়র্ক সময়) জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দেবেন।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২৪ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন। একই দিন তিনি ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি এবং কুয়েতের যুবরাজ শেখ সাবাহ খালেদ আল-হামাদ আল-সাবাহর সঙ্গেও দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন। ড. ইউনূস আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টা ২৫ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ শেহবাজ শরিফ ও নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা এবং ২৬ সেপ্টেম্বর নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী ডিক স্কুফের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
নিউইয়র্ক সফরকালে প্রধান উপদেষ্টা একটি নাগরিক সংবর্ধনায় যোগ দিতে পারেন বলে শোনা গেলেও শেষ পর্যন্ত তা হচ্ছে না। তিনি কোনো নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন না। কেন যোগ দিচ্ছেন না এ নিয়ে অনেকের অনেক কৌতূহল থাকলেও কেউ কেউ বলছেন, আসলে ওই সংবর্ধনা আয়োজন করতে চেয়েছিলেন যারা, সেখানে যাদেরকে অতিথি করা হচ্ছিল, তাদের নিয়ে অনেক প্রশ্ন ওঠে। একটি সূত্র জানায়, অনুষ্ঠানের জন্য যারা আমন্ত্রিত অতিথিদের তালিকা তৈরি করছিলেন, সেই ব্যক্তিদের দুজনের নামে প্রধান উপদেষ্টার কাছে তথ্য পেশ করা হয়। ওই দুই ব্যক্তির রাজনৈতিক পরিচয় তাকে জানানো হয়। সূত্র জানায়, তিনি এমন কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিতে চান না, যেখানে বিতর্কিত হতে পারেন কিংবা কোনো বিতর্ক জন্ম হয়। বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা যে প্রত্যাশা নিয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছেন, তার উদ্দেশ্য যাতে ব্যাহত ও প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সেই বিষয়টি তিনি লক্ষ রাখছেন। ফলে নাগরিক সংবর্ধনার প্রস্তুতি নিলেও পরে তা বাতিল করা হয়।
এদিকে প্রবাসীদের অনেকেরই প্রত্যাশা ছিল এবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিউইয়র্কে এলে তার সঙ্গে দেখা করে তাদের দাবিদাওয়া পেশ করবেন। প্রবাসীদের সবচেয়ে বড় দাবির মধ্যে আছে বিমানের ঢাকা-নিউইয়র্ক রুট চালু। এই রুট বন্ধ হওয়ার পর থেকে বিগত সব সরকারের কাছেই এটি চালু করার জন্য প্রবাসীরা দাবি জানিয়ে আসছেন। সব সরকারের কাছ থেকে ফ্লাইট চালুর প্রতিশ্রুতি মিললেও এর কোনো সুরাহা হয়নি। এবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রবাসীদের দাবি, তিনি যাতে বিমানের ফ্লাইট চালুর ব্যাপারে উদ্যোগ নেন এবং সফল হন।
সূত্র জানায়, বিমানের ফ্লাইট চালুর ব্যাপারে বাংলাদেশকে সকল পরীক্ষায় পাস করতে হবে। বিশেষ করে, নিরাপত্তাজনিত মানে উত্তীর্ণ হতে হবে।
জানা গেছে, ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ) অ্যাটাশে ড্যানিয়েল জ্যাকব গত ৯-১২ জুন ঢাকায় সফর করেন। ঢাকা সফরকালে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ বিমান চলাচল সহযোগিতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন এফএএ অ্যাটাশে। সফরকালে তিনি বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (সিএএবি) চেয়ারম্যান এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে সরাসরি ফ্লাইটের লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজনীয় ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা অব্যাহত রাখে এই বৈঠক। ড্যানিয়েল জ্যাকব যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সরাসরি ফ্লাইট অর্জনের প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করেন। সেখানে বলা হয় :
১. বাংলাদেশের ‘ক্যাটাগরি ১’ নিরাপত্তা রেটিং অর্জন করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের এফএএর ইন্টারন্যাশনাল এভিয়েশন সেফটি অ্যাসেসমেন্ট (আইএএসএ) বা আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল নিরাপত্তা মূল্যায়নে উত্তীর্ণ হতে হবে। ক্যাটাগরি ১ রেটিং নিশ্চিত করবে যে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার (আইসিএও) গুরুত্বপূর্ণ মান এবং প্রস্তাবিত অনুশীলন মেনে চলে।
২. সিএএবির অনুরোধে এফএএ ক্যাটাগরি ১ রেটিংয়ের জন্য আইএএসএ পরিচালনা করবে। সিএএবি এখনো ইন্টারন্যাশনাল এভিয়েশন সেফটি অ্যাসেসমেন্ট (আইএএসএ) বা আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল নিরাপত্তা মূল্যায়নের জন্য এফএএকে অনুরোধ করেনি।
৩. সিএএবি যদি ক্যাটাগরি ১ রেটিং অর্জন করে, তার পরের ধাপে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রান্সপোর্টেশন সিকিউরিটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (টিএসএ) একটি পৃথক মূল্যায়ন এবং পরিদর্শন পরিচালনা করবে। এই মূল্যায়ন নির্ধারণ করবে, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং বিমান এয়ারলাইন্স যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশের মধ্যে সরাসরি ফ্লাইটের জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার শর্ত পূরণ করে কি না।
গত কয়েক বছর ধরে এফএএ এবং টিএসএ, সিএএবি এবং বিমান এয়ারলাইন্সকে আন্তর্জাতিক মানের নিরাপত্তা অর্জনের জন্য বিনা মূল্যে প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করে আসছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিনা মূল্যে বিমানবন্দর স্ক্রিনিং সরঞ্জাম সরবরাহ করছে এবং বাংলাদেশি বিমান কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করছে, যাতে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা মান পূরণ করতে পারে।
সূত্র জানায়, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং বিমান এয়ারলাইন্স যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশের মধ্যে সরাসরি ফ্লাইটের জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার শর্ত পূরণ করতে না পারা পর্যন্ত বিমানের ফ্লাইট চালুর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে না। তাই বাংলাদেশকে এ ব্যাপারে আরও প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশে যে সরকারই ক্ষমতাসীন হোক না কেন, তাদেরকে ঢাকা-নিউইয়র্ক-ঢাকা রুটে ফ্লাইট চালু করতে হলে অবশ্যই নিরাপত্তা-সংক্রান্ত শর্ত ও মান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।
প্রবাসীরা আশা করছেন, দ্রুতই বিমানের ফ্লাইট চালু হবে। এ বিষয়ে প্রবাসী ফোরামের আহ্বায়ক ফখরুল আলম বলেন, আমরা প্রবাসীরা ১৩ দফা দাবি জানিয়ে আসছি সরকারের কাছে। এর মধ্যে বিমানের ফ্লাইট চালু করার দাবিটিও রয়েছে। এই ফ্লাইট চালুর ব্যাপারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দ্রুত উদ্যোগ নেবে এবং সকল প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ফ্লাইট চালু করতে পারবে বলে আশা করছি। আমাদের ১৩ দফা দাবি পূরণের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টারও দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, যাতে তিনি প্রবাসীদের সমস্যা সমাধানে কাজ করেন।
প্রবাসী সুরক্ষা আইন বাস্তবায়ন কমিটির সেক্রেটারি মোহাম্মদ আলী বলেন, বিমানের রুট চালু সকল নিউইয়র্ক প্রবাসীর দাবি। আশা করা হচ্ছে, বর্তমান সরকার বিষয়টি দেখবে এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা এ বিষয়ে উদ্যোগ নেবেন। আমরা মনে করি, বিমানের ফ্লাইট চালু হলে প্রবাসীরা নিজ দেশের ক্যারিয়ারে যাতায়াত করতে পারবেন। এতে করে প্রবাসে থাকা দেশের মানুষের মনে শান্তি আসবে, সেই সঙ্গে বিমানও ভালো আয় করতে পারবে। বিমানের জন্য একটি প্রেস্টিজ রুটও যোগ হবে।