২০২৩ সালের ২৩ জানুয়ারি, বৃহস্পতিবার ৭টা ১০ মিনিটে গোধূলিলগ্নে পশ্চিমাকাশে পবিত্র রমজানের চন্দ্রোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর উম্মতদের জন্য পরম করুণাময় আল্লাহর বিশেষ আশীর্বাদ হিসেবে পবিত্র মাহে রমজানের প্রথম বা রহমতের অধ্যায়ের শুভ সূচনা ঘটবে। পবিত্র মাহে রমজানের আগমন উপলক্ষে বিশ্বের অপরাপর দেশগুলোর আদলে উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন মসজিদেও তাকওয়া বা মহান আল্লাহর বিশেষ সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ খতমে কোরআন, তারাবিসহ ধর্মীয় কতিপয় বাড়তি কর্মকাণ্ড শুরু করবেন, ইনশা আল্লাহ। এমন বাস্তবতায় ২৯ মার্চ বুধবার ঠিকানার পরবর্তী সংখ্যা বাজারে আসার আগেই যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশি মুসলমানদের জীবন থেকে পবিত্র রমজানের রহমতের অধ্যায়ের কমপক্ষে সাতটি দিবা-রজনী এক বছরের জন্য বিদায় নিয়ে যাবে।
প্রসঙ্গ রহমত : বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অলৌকিকত্ব এবং সীমাহীন রহমতের অসংখ্য কাহিনি বর্ণিত হয়েছে বিশ্ব মুসলিমের শাশ্বত জীবনবিধান পবিত্র কোরআনে। পবিত্র কোরআনের বর্ণনা অনুসারে প্রতিটি সৃষ্টিজীবের জোড়া জোড়া আরোহীসহ হজরত নুহ (আ.) এর কিস্তি প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টির মাঝে একাধারে ৪০ দিন সাগরের বুকে ভাসমান থাকার পর পরম করুণাময়ের অপরিসীম রহমতেই পাহাড়ের নাগাল পেয়েছিল। তারপর কিস্তি থেকে অবতরণপূর্বক নতুন করে বসবাস শুরু করেছিলেন। আবার খোদাদ্রোহী নমরুদের প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপিত হজরত ইবরাহিম (আ.) ফুলের বিছানা লাভ করেছিলেন। আগুনের লেলিহান শিখা হজরত ইবরাহিমের (আ.) একটি লোমও স্পর্শ করেনি। প্রাণে বধ করার উদ্দেশ্যে বৈমাত্রেয় ভ্রাতারা হজরত ইউসুফ (আ.) কে কূপে ফেলেছিলেন।
অথচ মহান আল্লাহর অপরিসীম রহমতে হজরত ইউসুফ (আ.) প্রাণে বেঁচে গেলেন এবং পরিশেষে মিসরের বাদশাহ হয়েছিলেন। ফেরাউনের ভয়ে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া সদ্যোজাত শিশু মুসা (আ.) শেষ পর্যন্ত মহান আল্লাহর রহমতে ফেরাউনের সুরম্য প্রাসাদেই ফেরাউনের স্ত্রীর অপত্য স্নেহ-মমতা এবং নিজ জননীর দুগ্ধপানে লালিত-পালিত হয়েছিলেন। আবার আল্লাহর রহমতেই নিজ অনুসারীসহ হজরত মুসা (আ.) অতলস্পর্শী নীলনদ অলৌকিকভাবে অতিক্রম করেছিলেন এবং সসৈন্যে ফেরাউনের সলিলসমাধি রচিত হয়েছিল নীলনদে। ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দে পবিত্র কাবাগৃহ নিশ্চিহ্ন করতে আসা সাবেক ইয়েমেনের খোদাদ্রোহী বাদশাহ আবরাহার বিশাল বাহিনী আল্লাহর অপরিসীম রহমতে একশ্রেণির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পাখির নিক্ষিপ্ত প্রস্তরের আঘাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, আল্লাহর অপরিসীম রহমতের বদৌলতে অনেক অসাধ্য এবং অকল্পনীয় কর্মকাণ্ডও সংঘটিত হতে পারে।
মূলত মহান আল্লাহর অপার রহমতের কারণেই সুন্দরবনসহ শ্বাপদসংকুল বন-বাদাড়ে বাঘ-ভালুক-সিংহ ইত্যাদি মাংসাশী ও প্রাণঘাতী প্রাণীর পাশাপাশি নিরীহ প্রকৃতির হরিণ ও অন্যান্য ছোটখাটো জীব বেঁচে থাকে। আর দয়াময় আল্লাহর রহমত ছাড়া আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে পরিচিত মানুষের পক্ষে বৈরী পরিবেশে জীবনধারণ এবং ধরাধামে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা ও বংশবৃদ্ধি সম্ভব হতো না। বিশেষত, একজন মুমিন মুসলমান মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন, আল্লাহর রহমত ছাড়া দৈনন্দিন জীবনযাপন এবং পরকালীন আজাব-গজব ও রোজ কিয়ামতে পরিত্রাণ লাভ কোনোক্রমেই সম্ভব হবে না। আর রোজ হাশরে আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর উম্মতদের পরিত্রাণের একমাত্র ভরসা মহান আল্লাহর অপরিসীম রহমত এবং বিশ্বনবী (সা.) এর সুপারিশ। অতএব, পবিত্র মাহে রমজানের রহমতের অধ্যায়ের গুরুত্ব আমাদের জীবনে অনস্বীকার্য।
আমাদের চারপাশের বিশ্ব প্রকৃতির প্রতি গভীর মনোযোগ সমভিব্যাহারে অবলোকন করলে আল্লাহর অফুরন্ত রহমতের ভুরি ভুরি নজির দৃষ্টিগোচর হয়। জীবমাত্রেরই জীবনধারণের অপরিহার্য উপাদানরাজি, যেমন প্রাকৃতিক
আলো-বাতাস-বায়ু-জলরাশি-ভূখণ্ড-পাহাড়-পর্বত-বন-বনানী ইত্যাদি প্রকৃত প্রস্তাবে সৃষ্টির প্রতি স্রষ্টার অপরিসীম রহমতেরই উজ্জ্বল নিদর্শন। বায়ুর সাগরে ডুবে থেকেও আত্মভোলা মানব সম্প্রদায় যেমন বায়ুর অস্তিত্ব উপলব্ধি করে না কিংবা করতে চায় না; অনুরূপভাবে মহান আল্লাহর অপরিসীম রহমতের বারি আকণ্ঠ পান করেও আমরা বিশ্ব প্রতিপালকের রহমত সম্পর্কে ঘুণাক্ষরে চিন্তা করি না।
আমাদের এহেন সজ্ঞান উপেক্ষাই পারলৌকিক কল্যাণ কামনার পরিবর্তে আমাদের পার্থিব ভোগ-ঐশ্বর্যের প্রতি মোহাবিষ্ট করে তুলেছে এবং পরিণতিতে আমাদেরকে অকৃতজ্ঞ-কৃতঘ্ন এমনকি নাস্তিকের পর্যায়ে ঠেলে দিচ্ছে। তাই পবিত্র রমজানের রহমতের অধ্যায়েও বেশির ভাগ মুসলমান একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগির স্থলে পার্থিব ধান্ধায় ব্যস্ত থাকেন। আবার পবিত্র কোরআনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের সুরা আল বাকারার ২১২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে : জুইয়েনা লিল্লাজিনা কাফারুন হায়াতুদ্ দুনিয়া ওয়া ইয়াসখারুনা মিনাল্লাজিনা আ’মানু- ওয়াল্লাজিনাত্তাকাও ফাওকাহুম ইয়াওমাল কিয়ামাতি, ওয়াল্লাহু ইয়ারজুকু মাইয়াসাউ বিগাইরি হিসাব (পার্থিব জীবন কাফেরদের নিকট সুসজ্জিত মনে হয়; এবং অনবদ্য কারণে তারা এ সকল মুসলমানকে বিদ্রুপ করে।
অথচ মুসলমানগণ যারা (কুফর ও র্শ্ক) থেকে বেঁচে থাকে, তারা ওই সকল কাফের থেকে কিয়ামত দিবসে উচ্চ স্তরে থাকবে। আর রিজিক তো আল্লাহ যাকে চান বেহিসাব দান করেন। [হজরত বিলাল এবং অন্যান্য অভাবগ্রস্ত মুসলমানের প্রতি বিদ্রুপবাণ বর্ষণকারী বিত্তশালী কাফেরদের প্রসঙ্গ এখানে উপস্থাপিত হয়েছে।] করোনাসহ নানাবিধ প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব নাস্তানাবুদের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। তাই পার্থিব ভোগ-ঐশ্বর্য নাকি পারলৌকিক কল্যাণকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত, সেই সিদ্ধান্ত চরমভাবে বিপর্যস্ত মুসলিম বিশ্বকে বর্তমানে গ্রহণ করতে হবে। আবার ধর্মকর্মে সর্বদা মশগুল মুসলমানদেরও আত্মপ্রসাদ বা আত্মতৃপ্তির বিন্দুমাত্র সুযোগ ইসলামে নেই। কারণ নিজেদের ইবাদত-বন্দেগি, দান-খয়রাত কিংবা পুণ্যের বিনিময়ে কাক্সিক্ষত মঞ্জিল বা বেহেশত লাভ বান্দার পক্ষে সম্ভব নয়।
একমাত্র আল্লাহর অপরিসীম রহমতই আমাদেরকে সংঘাত বিক্ষুব্ধ বিশ্ব পরিমণ্ডলে সার্বিক অপরাধমুক্ত জীবনযাপন এবং পরকালীন আজাব-গজব থেকে পরিত্রাণ ও পরম আরাধ্য বেহেশত দান করতে পারে। সৃষ্টির সেরা মাখলুকাত হিসেবে নৈতিকতার প্রশ্নে এবং মহান স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অপরিহার্য অংশ হিসেবেই হালাল উপার্জনে জীবনযাপন, নিয়মিত সালাত আদায়, ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকা, প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের প্রতি দায়িত্ব পালন, অভাবগ্রস্তদের দুর্দশা লাঘব এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানাদিতে দান-খয়রাত ইত্যাদি করতে আমরা বাধ্য। অথচ দুর্ভাগ্যক্রমে কিছু সংখ্যক মুসলিম নামধারীসহ সত্যভ্রষ্ট পৌত্তলিক জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশ আল্লাহর একত্ববাদের স্থলে একাধিক স্রষ্টার পূজা-আরাধনায় নিয়োজিত। উল্লেখ্য, আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে যুগে যুগে বহু সম্প্রদায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এবং ভবিষ্যতেও এর ব্যত্যয় ঘটবে না, ইনশা আল্লাহ। ধর্মীয় বিধিবিধান মেনে চলার ক্ষেত্রে লাখো দৈন্য এবং গাফিলতি সত্ত্বেও বিশ্ব মুসলিম মনেপ্রাণে স্বীকার করেন, আল্লাহর রহমত ব্যতীত ব্যক্তিগত পুণ্য দ্বারা পরকালীন মুক্তি কিংবা বেহেশত লাভ কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। তাই সাওম পালনকারী হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের উচিত হচ্ছে পবিত্র রমজানের প্রথম অধ্যায়ের ১০টি দিবস-রজনী আল্লাহর রহমতলাভে যথাসাধ্য চেষ্টা করা।
পবিত্র কোরআনের দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ প্যারার সুরা ইউসুফের ৮৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে : লা তাইয়াসু র্মিরাওহিল্লাহে, ইন্নাহু লা ইয়াইয়াসু র্মিরাওহিল্লাহে ইন্নাল কাওমুল কা’ফেরুন [আল্লাহ তায়ালার রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না; নিশ্চয় মহান আল্লাহর রহমত থেকে শুধু সে সকল লোকই নিরাশ হয়, যারা কাফের।] পবিত্র কোরআনের ২৪তম অধ্যায়ের মক্কায় অবতীর্ণ সুরা জুমার ৫৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে : লা তাকনাতুম্ মির-রাহমাতিল্লাহে, ইন্নাল্লাহা ইয়াগফেরুজ যুনুবা, ইন্নাহু হুয়াল গাফুরুর রাহীম (আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ অপরাধীদের অপরাধ মার্জনাকারী; বাস্তবিকই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু)। আবার পবিত্র রমজানের প্রতিটি নফল ইবাদতকে অন্য সময়ের ফরজ ইবাদত হিসেবে এবং প্রতিটি ফরজ ইবাদতকে অন্য সময়ের ৭০টি ফরজ ইবাদত হিসেবে গণনা করা হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, আল্লাহর সঙ্গে অংশীদার বা একাধিক খোদায় বিশ্বাসী এবং হক্কুল ইবাদ বা বান্দার হক তছরূপকারী ছাড়া আল্লাহ অন্যান্য বান্দার গোনাহ মাফের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাই আখেরি নবী মুহাম্মদ (সা.) এর উম্মত হিসেবে পবিত্র রমজানের প্রথম ১০ দিন নিজেদের অপরাধরাশির জন্য অনুশোচনাগ্রস্তচিত্তে ক্ষমা এবং আল্লাহর বিশেষ রহমত ভিক্ষা করলে পরম করুণাময় আল্লাহ আমাদের নিরাশ করবেন না ইনশা আল্লাহ। তবে আল্লাহর রহমতপ্রত্যাশী রোজাদার হিসেবে আমাদের করণীয় হবে সর্বদা সত্য বলা।
পবিত্র হাদিসে মিথ্যাকে হচ্ছে যাবতীয় অপরাধের প্রসূতি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। তাই রোজাদারদের প্রধানতম দায়িত্ব হবে সর্বাবস্থায় মিথ্যাকে পুরোপুরি বর্জন করা, সর্বদা সত্য বলা এবং যাবতীয় অপরাধ থেকে আত্মরক্ষার মাধ্যমে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। যাবতীয় কুপ্রবৃত্তি পরিহারপূর্বক অহর্নিশ যথাসাধ্য একাগ্রচিত্তে ইবাদত-বন্দেগি করা। ক্রোধ সংবরণ এবং ধৈর্য ধারণ করা। কারণ ধৈর্যের বিনিময় হচ্ছে বেহেশত লাভ। আহার-বিহার-ইফতারিতে ব্যয় সাশ্রয় করা এবং সাশ্রয়কৃত অর্থে অভাবগ্রস্তদের দুর্দশা লাঘবের চেষ্টা করা। উচ্চবাচ্য-ঝগড়াঝাঁটি এড়িয়ে চলা এবং কেউ গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধাতে চাইলে তাকে শান্তভাবে বলা উচিত, আমি রোজাদার। ইসলামে গিবত বা পরচর্চা বা পরশ্রীকাতরতাকে জেনা বা ব্যভিচারের চেয়েও ভয়ানক অপরাধ এবং নিজের মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। তাই যেকোনো মূল্যে গিবত পরিহার করতেই হবে। কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে মহান আল্লাহর সহায়তা কামনা করছি।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক।
২১ মার্চ ২০২৩