সকল সংস্কারই মুখ থুবড়ে পড়বে, যদি সংবিধান সংস্কার করা না হয়। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছেন, সেখানে ড. শাহদীন মালিকের নেতৃত্বে সংবিধান সংস্কারের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল গঠিত হচ্ছে জেনে আশ্বস্ত হয়েছি। তবে কাজটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত শঙ্কামুক্ত হতে পারছি না। তিনি একটি যুক্তিসংগত সময়সীমার কথাও বলেছেন। তিনি প্রত্যাশা করেছেন, অক্টোবরেই প্যানেলগুলো কাজ শুরু করবে এবং আনুমানিক তিন মাসের মধ্যে তারা কাজটি শেষ করতে পারবে। আমি মনে করি, এটি খুবই যুক্তিসংগত সময়সীমা।
ছাঁচ বদলাতে না পারলে দৃশ্যমান নতুন স্বাদের পিঠা খেতে পারবে না মানুষ। উপকরণ বদলালে হয়তো স্বাদ বদলাবে কিন্তু পিঠাগুলো দেখতে ঠিক আগের মতোই থাকবে। ফলে ভবিষ্যতে আবার যখন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসবে, তারা খুব সহজেই জনগণকে ফাঁকি দিয়ে উপকরণ বদলে দেবে। যদি আমরা ছাঁচটাই বদলে দিতে পারি, তাহলে জনগণকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হবে না। আসলে সংস্কারের মূল কাজই হলো ছাঁচ বদলে দেওয়া, শুধু উপকরণ বদলানো নয়।
বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় ভাবুন তোÑআপনি, আমি আমাদের পুরোটা মেধা ও শ্রম দিয়ে রাজনীতি করলে কত দূর যেতে পারব? সর্বোচ্চ বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সাধারণ সম্পাদক হতে পারব, অতঃপর সেই দল যদি ক্ষমতায় যায়, মন্ত্রী হতে পারব। বাংলাদেশের মেধাবী, পিএইচডি ডিগ্রিধারী, পোস্ট ডক্টরেট করা, বড় বড় লেখক, কবি, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সমাজবিজ্ঞানী, দেশপ্রেমিক মানুষ এর বেশি স্বপ্নই দেখতে পারে না। কারণ এর ওপরের পদটি, মানে দলের প্রধান বা দেশের প্রধানমন্ত্রী, শুধু দুটি পরিবারের জন্য নির্ধারিত। শুধু তা-ই নয়, দলের প্রধানের সঙ্গে দ্বিতীয় প্রধানের সম্পর্ক হচ্ছে প্রভু ও ভৃত্যের মতো। আপনি আপনার অসাধারণ মেধার কারণে পৃথিবীর যেকোনো উচ্চতায় যেতে পারেন, ড. ইউনূসের মতো নোবেল পুরস্কারও পেতে পারেন কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে সর্বোচ্চ একজন ভৃত্য হতে পারবেন, এর বেশি কিছু নয়। সম্ভাবনার সেই জায়গাটি এমনভাবে দুটি পরিবারের জন্য সুরক্ষিত, সেখানে উঁকি দিয়ে তাকানোও নিষিদ্ধ।
এই বাস্তবতায় আপনি কি রাজনীতিতে যাবেন? আমি বহু বাংলাদেশিকে চিনি, যাদের পায়ে ধরলেও মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করবে না, দলীয় সরকারের অধীনে তো নয়ই। এর কারণ কী? কারণ ওই একটিই, মন্ত্রী হওয়ার মানে হচ্ছে একটি পরিবারের ভৃত্য হওয়া। আমি নিজ কানে শুনেছি, বিগত সরকারের রাজপরিবারের একজন আমাকেই বলেছেন, আমাদের চাকর-বাকরেরা এত এত প্লট পেয়েছে। প্রথমে আমি বুঝতেই পারিনি, চাকর-বাকর বলতে তিনি কাদের বুঝিয়েছেন। দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করায় তিনি স্পষ্ট করে মন্ত্রীদের কথা বলেন। এটাই হচ্ছে দুই রাজপরিবারের মানসিকতা।
এখন কথা হচ্ছে, কেন তাদের এই মানসিকতা তৈরি হয়েছে এবং কীভাবে তা প্রতিদিন একটু একটু করে তারা আরও সুসংহত করতে পেরেছেন? মূল অপরাধ আমাদের রাষ্ট্রের সংবিধানের। যদি সংবিধানে দুই মেয়াদের বেশি [বিরতি দিয়েও] কেউ সরকারপ্রধান না থাকার বিধান থাকত এবং সংসদ সদস্যরা যেকোনো বিলের পক্ষে-বিপক্ষে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারতেন, তাহলে রাষ্ট্রক্ষমতা এতটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ত না। সেই সঙ্গে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও একই বিধানের প্রবর্তন করা জরুরি, যাতে কেউ দুই মেয়াদের বেশি দলের প্রধান থাকতে না পারে। দলগুলোকে নির্ধারিত সময় পরপর কাউন্সিলের মাধ্যমে অবশ্যই নতুন কমিটি করতে হবে, দলের নেতৃত্ব নির্বাচনে স্বচ্ছতা আনার জন্য রাষ্ট্রের নির্বাচন কমিশনকে জড়িত করা যেতে পারে। দলগুলোর নিবন্ধন হালনাগাদ রাখার জন্য প্রতি টার্মের মেয়াদ শেষে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করা বা নতুন কমিটি গঠন করা বাধ্যতামূলক করা দরকার।
যদি কেউ দুই মেয়াদের বেশি দলের প্রধান হতে না পারেন এবং দুই মেয়াদের বেশি দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে না পারেন, তাহলে ক্ষমতার পরিবারকেন্দ্রিক প্রবণতা ভেঙে পড়বে। এতে রাজনীতিতে চাঞ্চল্য আসবে, গতি আসবে, সারা দেশ থেকে মেধাবী তরুণেরা রাজনীতিতে যুক্ত হবে, নতুন নতুন নেতৃত্ব আসবে, নেতৃত্বে মেধার প্রতিযোগিতা দৃশ্যমান হবে।