জাতি গঠন একটি চলমান প্রক্রিয়া। জাতি গঠনে মানুষের ভূমিকা মুখ্য হলেও শুধু নামে মানুষ কিন্তু মনুষ্যত্বের অভাব-এমন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে জাতি গঠিত হলে তাকে আদর্শ জাতি হিসেবে বিবেচনার অবকাশ আছে কি না তা প্রশ্নসাপেক্ষ। শিক্ষা সংস্কৃতি দর্শন আবেগ প্রজ্ঞা মানবতা মনুষ্যত্ববিহীন শুধু বলিষ্ঠ দেহসর্বস্ব মানুষ দ্বারা গঠিত জাতি হলেই তাতে আদর্শ জাতি হয় না। শারীরিক শক্তিই যদি হয় ক্ষমতার উৎস, তাহলে বাঘ সিংহ হাতি ঘোড়ার বনে-জঙ্গলে থাকার প্রয়োজন হতো না। তারা দখল করে নিতে পারত সব লোভনীয় অবস্থান। কিন্তু তা না হওয়ার কারণ, শক্তি বলতে শারীরিক শক্তি নয়, জ্ঞান বুদ্ধি প্রজ্ঞা সততা ন্যায়নিষ্ঠা এগুলোই হলো সভ্য জগতের প্রকৃত শক্তি আর এই শক্তিবলে যারা বলীয়ান, তারাই প্রকৃত নিয়ন্ত্রক, যা পর্যায়ক্রমিক শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত। রাজনীতি দেশ ও জাতি গঠন এবং নিয়ন্ত্রণের অন্যতম প্রধান সহায়ক শক্তি হলেও তার উৎস মূলত জনসমর্থন। তাই রাষ্ট্রে রাজনৈতিক সংগঠনসমূহের মধ্যে যে সংগঠনের জনসমর্থন ও জনভিত্তি যত বেশি, সেই সংগঠনই রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়। তবে রাজনীতির লক্ষ্য উদ্দেশ্য যদি সেবাধর্মী না হয়ে কেবলই কৌশলী আর সে কৌশল হয় শুধুই ক্ষমতাকেন্দ্রিক, তবে তা কখনো জননন্দিত হতে পারে না, যা ইতোমধ্যে প্রমাণিত। তা থেকে রাজনীতিবিদেরা শিক্ষা না নিয়ে একই ভুল বারবার করলে জাতির জন্য তা খুবই হতাশাজনক। ডিগবাজির প্রবণতা হয়তো সব পেশাতেই আছে, তবে রাজনীতি যেহেতু সরাসরি জনসম্পৃক্ত, তাই তা জনগণের নিকট সহজেই দৃষ্টিগোচর হয়। তাই জনসমর্থন লাভের জন্য জনতুষ্টির ব্যত্যয় কোনোক্রমেই কাম্য নয়।
রাজনীতির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত জনসেবা। তবে এ লক্ষ্যে যারা সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সময় পার করেন, তাদের অর্থনৈতিক প্রয়োজনে বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা থাকাও আবশ্যক। অন্যথায় রাজনীতি যদি আয়ের উৎস হয়, তবে সততা ও নৈতিকতা বজায় রেখে রাজনীতি করা কতটা সম্ভব, রাজনীতিবিদদেরই তা ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়। গত ৫৩ বছরের রাজনৈতিক সংস্কৃতি দেখতে দেখতে মানুষ ক্লান্ত ও বীতশ্রদ্ধ, যার ফলে বারবার সংঘাত, সংঘর্ষ ও বহু রক্তের বিনিময়ে একাধিকবার স্বৈরশাসন মুক্ত হলেও কাক্সিক্ষত লক্ষ্যপূরণ রয়ে গেছে বহুদূরে। সাম্প্রতিক অতি অল্প সময়ে অকল্পনীয় রক্তক্ষয় ও জীবননাশের বিনিময়ে অর্জিত বিপ্লবোত্তর আকাক্সক্ষা যাতে ব্যর্থতায় পর্যবসিত না হয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা দলমত ও ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবার দায়িত্ব। কোনোভাবেই রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে দেশ ও জাতির ক্ষতি হয়, রাজনৈতিক দল তথা দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের এমন কোনো কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকা বা আত্মসংযমের কোনো বিকল্প নেই। তবে কোনো দল বা তাদের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের অসহিষ্ণুতা তাদেরই জনবিচ্ছিন্ন করবে নিঃসন্দেহে। তাই রাজনীতি কোনোভাবেই নিঃস্বার্থ ও জনপ্রত্যাশা পূরণের পরিবর্তে দলীয় স্বার্থপূরণ বা স্বজনপ্রীতির আবর্তে ঘুরপাক খাওয়ার দিন শেষ হয়েছে, এ বাস্তবতা বুঝতে যাদের দেরি হবে, তাদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় সুদূরপরাহত। সাংবিধানিক ও আইনগত যেসব দুর্বলতার কারণে বারবার স্বৈরশাসনের পুনরাবৃত্তি ঘটে, প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনের মাধ্যমে সেসব দুর্বলতা কাটিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও জনস্বার্থ রক্ষাকারী বিধিবিধান প্রণয়নের এখনই সঠিক সময়। দলীয় সরকার জনহিতকর কাজের ওয়াদা করে ক্ষমতা গ্রহণের পর ওয়াদা পূরণের ব্যাপারে অনীহা প্রদর্শনের নজির ইতিমধ্যে জনগণের উপলব্ধিতে এসেছে। তাই জনগণ বিগত দিনের রাজনৈতিক সংস্কৃতিরও আমূল পরিবর্তন আশা করে। যেসব রাজনৈতিক দল এহেন জনপ্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হবে, তাদের রাজনৈতিক দল হিসেবে টিকে থাকা কতটা সম্ভব, বিগত দিনের বহু রাজনৈতিক দল জনপ্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হওয়ার ফলে দলের দুর্দশা ও বিলুপ্তিই তার প্রমাণ।
মাসপূর্তি উপলক্ষে বিপ্লবী সরকারপ্রধান হিসেবে দেওয়া বক্তব্যে সরকার কর্তৃক গৃহীত সংস্কার কার্যক্রমের বাস্তবায়ন ও বাস্তবায়নযোগ্য কর্মকাণ্ডে গৃহীত পদক্ষেপসমূহ ব্যাপকভাবে জনসমর্থন লাভে সক্ষম হবে বলে আশা করা যায়। প্রদেয় বক্তব্যে জনপ্রত্যাশা পূরণে কাক্সিক্ষত সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সময়ের রূপরেখা-সংবলিত রোডম্যাপেরও ইঙ্গিত রয়েছে, যা দেশবাসীসহ রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রত্যাশা পূরণে অবদান রাখবে এবং তাদের অহেতুক দুশ্চিন্তা প্রশমনে সহায়ক হবে বলে ধারণা করা যায়। যদিও বর্তমান সরকারের সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে জনগণ ও রাজনৈতিক দলসমূহের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে যৌক্তিক সময় দেওয়া ও পূর্ণ সমর্থনের আশ্বাস প্রদান করা হয়েছে। বলে রাখা ভালো, রাজনৈতিক দল কর্তৃক বর্তমান সরকারের প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতার আশ্বাস জনমনে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। সরকারপ্রধান হিসেবে তিনি জনগণকে দর্শক হিসেবে গ্যালারিতে অবস্থান না করে সরকারের পাশে থেকে অংশগ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছেন। সর্বোপরি কাজকর্মে সরকার যাতে পথ না হারায়, সেদিকেও সজাগ দৃষ্টি রেখে গঠনমূলক ভূমিকা পালনের জন্য সবার প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান, যা সত্যিকারের জনবান্ধব উক্তি হিসেবে জনগণের নিকট প্রশংসিত হয়েছে। বিপ্লব-পরবর্তী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে না এলেও সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ স্বস্তিদায়ক পর্যায়ে ক্রমশ উন্নীত হচ্ছে, যা আশাপ্রদ। বিগত দিনে অন্যায় আচরণকারীদের আইনের সার্বিক আওতায় এনে যথোপযুক্ত শাস্তি প্রদান এবং বিদ্যমান নিপীড়নমূলক আইনকানুন বাতিল বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংস্কারের ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস জাতিকে আশান্বিত করেছে। নিরপেক্ষতা বজায় রেখে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে যথাযথ ভূমিকা পালনের আহ্বানে মিডিয়ার সাড়া পাওয়া যাবে বলে সবাই আশাবাদী।
সার্বিক বিচারে বর্তমান সরকারের মূল্যায়নের সময় এখনো আসেনি। তা সত্ত্বেও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাদের জবাবদিহি প্রদান বিগত দিনের কালচার থেকে বেরিয়ে আসার ইঙ্গিত বহন করে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে অচিরেই কাক্সিক্ষত লক্ষ্যপূরণ সম্ভব হবে। তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত জবাবদিহি নিশ্চিতকল্পে প্রতিটি জনসম্পৃক্ত অফিসে অভিযোগ বাক্স স্থাপন ও প্রাপ্ত অভিযোগসমূহ সাপ্তাহিক ভিত্তিতে নিষ্পত্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে জনগণ যেমন অহেতুক হয়রানি থেকে রক্ষা পাবে, পক্ষান্তরে দায়িত্ব পালনকারীরাও সজাগ ও সচেতন থাকতে বাধ্য হবে। এ সামান্য কার্যক্রম সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও জনপ্রত্যাশা পূরণে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে, সন্দেহ নেই। দেশ-প্রবাসে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের যা একান্ত কাম্য। মহান আল্লাহ লক্ষ্যপূরণে সহায়ক হোন।
লেখক : কবি ও কলামিস্ট