আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আনুষ্ঠানিকভাবে দেশটির ক্ষমতাসীন দল ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। স্থানীয় সময় গত বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) রাতে শিকাগোয় দলটির চার দিনব্যাপী জাতীয় সম্মেলনের শেষ দিনে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে তার নাম ঘোষণা করা হয়। এর মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো কৃষ্ণাঙ্গ নারী এবং দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত হিসেবে কেউ এ পদে ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন পেলেন।
দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিতের পর ক্ষমতায় গেলে যুক্তরাষ্ট্রের সব মানুষের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের কথা জানান ৫৯ বছরের কমলা। সম্মেলনের সমাপনী ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমি আমেরিকার সাংবিধানিক নীতি, মৌলিক নীতি ও আইনের শাসন অনুযায়ী সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পবিত্রতা রক্ষা করব।’
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকা জানিয়েছে, আগামী নভেম্বরের নির্বাচনে নিজের প্রতিপক্ষ রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্পর্কেও ভোটারদের সতর্ক করেন কমলা হ্যারিস। তিনি বলেন, ট্রাম্পের আইনভঙ্গের প্রবণতা এটিই ইঙ্গিত দেয়, পুনরায় নির্বাচিত হলে দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারেন।
কমলা হ্যারিস বলেন, ‘চিন্তা করুন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর যদি কোনো বাধা না থাকে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার বিশাল ক্ষমতা কীভাবে ব্যবহার করবেন। আপনাদের জীবনমান উন্নত করার জন্য নয়, আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা জোরদারের জন্য নয়, শুধু নিজের স্বার্থ হাসিল করার জন্য তিনি এই ক্ষমতার অপব্যবহার করবেন।
‘ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের’ প্রতি সমর্থনের কথা জানিয়ে হামাসের হাতে থাকা জিম্মিদের মুক্ত করা এবং গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য কাজ করবেন বলে জানান কমলা হ্যারিস।
শিকাগোর সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা নিয়েও কথা বলেন কমলা। তিনি ওয়াশিংটনের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক জোরদারের প্রতিশ্রুতি দেন। একই সঙ্গে ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন প্রতিহত করতে কিয়েভের পাশে থাকার ঘোষণা দেন তিনি।
কমলা হ্যারিস বলেন, ‘আমেরিকার নিরাপত্তা ও মূল্যবোধ রক্ষা করতে আমি কখনো পিছপা হব না। কারণ, গণতন্ত্র ও স্বৈরাচারের মধ্যে লড়াইয়ে আমি জানি, আমার আর আমার দেশের অবস্থান কোথায়। অন্যদিকে ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনের মতো স্বৈরশাসকদের বিষয়ে নমনীয়। কারণ, তিনি নিজেই একনায়ক হতে চান।’
বিশ্লেষকেরা কমলা হ্যারিসের ভাষণকে ‘শক্তিশালী’ হিসেবে বর্ণনা করে ২০০৮ সালের সম্মেলনে বারাক ওবামার দেওয়া ভাষণের সঙ্গে তুলনা করেন। তার বক্তব্য শেষে সম্মেলনস্থলে উপস্থিত ডেলিগেটরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। এ সময় সেখানে একধরনের উৎসবের আমেজ দেখা যায়। কমলা হ্যারিসের রানিংমেট দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী টিম ওয়ালজকে নাচতে ও গাইতে দেখা যায়।
বৃহস্পতিবার সম্মেলনে দেওয়া নিজের বক্তব্যের শুরুতে কমলা হ্যারিস তার ভারতীয় মা এবং জ্যামাইকান বংশোদ্ভূত বাবার স্মৃতিচারণা করেন। তিনি বলেন, ‘আমার মা বলতেন, কাছে থাকো, কাছে থাকো। কিন্তু আমার বাবা হাসতেন। তিনি বলতেন, ‘দৌড়াও কমলা! দৌড়াও! ভয় পেয়ো না। কোনো কিছু যেন তোমাকে থামাতে না পারে।’
কমলা হ্যারিস জানান, আমেরিকার নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সময় তার মা-বাবার পরিচয় হয়। তারা তাকে সামাজিক ন্যায়বিচারের মূল্যবোধ দিয়ে বড় করেন। তার ভাষায়, ‘মা আমাদের শিখিয়েছেন, অবিচার নিয়ে কখনো অভিযোগ করো না, কিন্তু কিছু একটা করো।’
এবারের নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী ছিলেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তবে গত জুনে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে টেলিভিশন বিতর্কে ভরাডুবি হয় তার। এ নিয়ে নিজ দলের মধ্যেই চাপের মুখে পড়েন বাইডেন। এমনকি ডেমোক্রেটিক পার্টির তহবিল সরবরাহকারীদের একাংশ সাফ জানিয়ে দেয়, প্রার্থিতা পরিবর্তন করা না হলে তাদের পক্ষে নির্বাচনী তহবিলের জোগান দেওয়া সম্ভব নয়।
সমালোচনার মুখে একপর্যায়ে গত ২১ জুলাই ভোটের মাঠ থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেন বাইডেন। এর ৩০ মিনিটের মাথায় নিজের উত্তরসূরি হিসেবে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের প্রতি সমর্থনের কথা জানান তিনি। অবশেষে বৃহস্পতিবার দলীয় সম্মেলনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে কমলার নাম ঘোষণা করা হয়।
তিন বছরের বেশি সময় ধরে কমলা হ্যারিস যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতার দায়িত্ব পালন করছেন। এবারের নির্বাচনে জয়ী হলে তিনি হবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট, বারাক ওবামার পর দ্বিতীয় কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট এবং দেশের প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত নেতা। সাম্প্রতিক একাধিক জনমত জরিপের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, কমলা হ্যারিস বর্তমানে ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে আছেন। রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দোদুল্যমান রাজ্যগুলোতেও এগিয়ে আছেন তিনি। জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে এ রাজ্যগুলোকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।’
কমলা হ্যারিস যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। সেখানে ঐতিহাসিকভাবে কৃষ্ণাঙ্গ নারী সমিতি ‘আলফা কাপ্পা আলফা’তে যুক্ত ছিলেন তিনি। মার্কিন সিনেটর হিসেবে কংগ্রেসের কৃষ্ণাঙ্গ ককাসেরও সদস্য ছিলেন কমলা হ্যারিস।
ঠিকানা/এনআই