জর্জেস মোহাম্মদ
চালতা গাছে বড় বড় সাদা সাদা ফুল ধরেছে, চালতা ফুল। শরতের মেঘের সঙ্গে মানিয়েছে দারুণ। ডাগর ডাগর ফনফনে সবুজ পাতার ফাঁকে ধবধবে সাদা ফুল। অপরূপ মানিয়েছে, বেগুনি সাদায় আকাশ, মেঘের ভেলা। বিশাল চালতা গাছে উঁকি মারে লাজুক রূপসী চালতা ফুল। কাশফুলের সঙ্গে শরৎ মেঘের অনেক বন্ধুত্ব। কাশফুল আর অপরূপা মেঘ শরতের ঐতিহ্য। পাশে নদী, পালের নাও, কাশফুলের বন, ভাটিয়ালি সুর, ভাটির টানে কচুরিপানার অজানায় পাড়ি। নাচতে নাচতে হেলেদুলে চলে, যেন বাপের বাড়ি নাইয়র যায়। কোথায় যায় কোন সাগরে ধায়, কোন অজানায়? সাগরে তো কচুরিপানা নেই, তবে কি আবার ফিরবে ঘরে নিজ আঙিনায় জোয়ার-ভাটায়। মাঝেমধ্যে শুশুকেরা ফুস করে জানান দেয় নাইয়র আসবে গায় আনন্দের পসরা নিয়ে।
বেতফল গাছ চালতা গাছের পাশেই ঝোপ গড়েছে। বেতবন না বলে বেতঝাড় বলে থাকে। অনেকগুলো কাশফুল গাছ একসঙ্গে দেখলেই নাম দিই কাশবন, কাশঝোপড়া নয়। আকাশে বড় বড় খৈয়ের মতো মেঘ কাশফুলের নিত্যসাথি। সাহিত্যপ্রেমিকেরা মনের সুখে গীত ধরেছে ওই কাশবনের ফুল দুলছে দোদুল...। এত বড় বড় বেতঝাড়, বেতবন বললে এমন কী ক্ষতি ছিল। তবে কি বেতফল গাছে কাশফুলের মতো ফুল হয় না, তাই? বেতফল গাছের সমষ্টিকে সবাই বেতের ঝোপড়া বলে থাকে। একটা বিষয় না বললেই নয়, আগের দিনগুলোতে প্রতিটি পাঠশালায়ই দু-একটা বেত ছিল না, এ কথা বলা বাহুল্য। পরিষ্কার তেলতেলে বেত। শিক্ষকশূন্য শ্রেণিকক্ষে ছেলেমেয়েরা একটু চিৎকার করবে এটাই স্বাভাবিক। এটাই শিশুসুলভ আচরণ। মনের কথা উল্লাসে, উচ্ছ্বাসে সহপাঠীদের বলার বয়স। প্রাণখুলে সাথিদের সঙ্গে কথা বলার উত্তম সময়। আর এই সময় মাস্টার মশাই যদি দু-একটা বেতের বাড়ি টেবিলে দেন, এটাই যথেষ্ট। অন্য কোনো বাক্য প্রয়োগের প্রয়োজন নেই। একেবারে চুপ। শব্দ থেরাপি। দু-একটা অমনোযোগী ছাত্র যে বেতের বাড়ি হাতের তালুতে খায়নি, তা নয়। খেয়েছে কিন্তু যতটুকু ঝাল লেগেছে তার চেয়ে বেশি পেয়েছে মনের কষ্ট। সহপাঠীদের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে বেতের বাড়ির অপমান আজীবন দাগ কেটে রয়। আর যদি ছেলেমেয়েদের শ্রেণিকক্ষ একই সঙ্গে হয়, তবেই সেরেছে। পুরোনো দিনে ছিলও তা-ই। পাছায় আর পায়ে বেতের বাড়ি নিছক মাস্টার মশাইর ব্যক্তিগত মনোমালিন্যের ঝাল মেটানো মাত্র। চেহারা দেখলেই বোঝা যায়, আজ ক্লাসে খবর আছে। তবে সুখবর নয়। নামতা মুখস্থ না করার পারিতোষিক হাতের তালুতে দু-একটা বেতের ঘা হতে পারে, তাই বলে কি পায়ে, পাছায়, পিঠে? বিশেষ করে, অঙ্ক মাস্টার মশাই যখন রেগে যান, ভাবটা এ রকম দেখান, যেন মোগল সম্রাটের সেনাপতি। তবে ক্লাসের মেয়েরা বেতের পেটানোর স্বাদ ঝাল না তিতা বুঝতে পারে না। শিক্ষকেরা নারীদের সম-অধিকারের কথা শিখিয়ে থাকেন, কিন্তু বেতের বাড়ির বেলায় নয়।
ছাত্রাবস্থায় ওই ঝোপড়ার বেতের পিটুনি যারা খেয়েছেন, তারাই আজ দেশের হোমরাচোমরা হয়েছেন। মাস্টার মশাইকে তো মুখ তুলে কিছু বলা যায় না। শিক্ষাগুরু বলে কথা! শিক্ষক পিতৃতুল্য। মনের ঝাল তো রয়েই যায়। মনের জেদ মেটানোর জন্যই বেতবন দেখলেই ঝোপড়া বলে ডাকেন। যেমন বেতফলকে বেত্তইন বলে ডাকেন। বেতফলকে বেত্তইন বলে ডাকলে সাধারণদের কোনো মাথাব্যথা নেই, কিন্তু বেতবনকে ঝোপড়া বলাতে আপত্তি আছে। আরে ভাই, জ্ঞানী-গুণী হওয়ার পরও গোস্যা কমে না? বরইমাখা খাবেন, চালতামাখা খাবেন, তেঁতুলমাখা খাবেন, সবাইকে ফল বলবেন আর বেতফলমাখা খেয়েই বলবেন বেত্তইনমাখা খেলাম। খুবই সুস্বাদু। কী দিয়েছ এতে? কেউ কেউ বেত্তইন ভর্তা বলে থাকেন।
বেতের ঝোপে আউকরা আছে, মানবজাতি আউকরাকে ভয় পায়। এই সুযোগে ঘুঘু, দোয়েল সংসার পাতে, ডিম দেয়, বাচ্চা ফোটায়। নিজের বাড়ি মনে করে মনের সুখে গান গায়। বাদল শেষে পড়ন্ত বিকেলে আমলকী বনে দোয়েলের সুর, আহা কী সুমধুর। বিনা মাশুলে মধুর কণ্ঠে গান শোনায়। তাল, লয়, সকালে ভায়রো, ভৈরবী রাতে ঈমন। দোয়েল জাতীয় পাখি। দোয়েলের ঘর-সংসারের একটা সুন্দর জাতীয় নাম থাকা চাই। ঝোপড়া না ডেকে অন্য কিছু। সবকিছু ভালো কিন্তু ঝোপড়া বলা চলবে না। প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষের সামর্থ্য আছে, সকল দোয়েলের বাসা বালাখানা করে দেওয়ার। বালাখানায় দোয়েলরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে না। শুভ লক্ষণ নয়। বিলুপ্তির লক্ষণ। সময়ের সঙ্গে বিলুপ্ত হয়ে যাবে সেই সাদা-কালো সুরেলা সুন্দর ছোট প্রিয় পাখিটি। বাঙালি জাতি মোটেও চাইবে না প্রিয় জাতীয় পাখি বাসা বাঁধুক ঘরের কোণে অথবা মস্কার ভেতর। ঝোপড়া থেকে মস্কায়, মস্কা থেকে কোন অজানায়। এখনো সময় আছে, হে মানুষ, ঝোপঝাড় কেটো না। ঝাড়ঝোপের দূরত্ব বজায় রেখে বসতবাড়ি বানাও। দোয়েলের অধিকার, স্বাধীনভাবে বাঁচিবার। যেমনটি বাঙালি জাতির। শুধু দোয়েল নয়, টুন্নিসহ সকল প্রজাতির পাখি।
জাতীয় পাখি দোয়েল পরিবারের পক্ষ থেকে সকল ঝোপ ও ঝোপড়াবাসী প্রতিবাদ জানায়, দোয়েলের আবাসস্থানকে ঝোপড়া ডাকা চলবে না। ঝোপড়া নিধন চলবে না। প্রতিবাদ জানাই টুন্নি পাখি, ঘুঘু পাখি ও ডাহুকের পরিবারের পক্ষ থেকে। আরও প্রতিবাদ জানাই সাপ সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে। সাপ সম্প্রদায়ের আদি বাস ঝোপঝাপ। বেতের ঝাড় অন্যতম। আজ থেকে মনুষ্য জাতি বেতঝাড়কে তাচ্ছিল্য করে বেতঝাড় বলতে পারবে না, হয় ‘বেত বন’ বলে ডাকবে, নয়তো ‘দোয়েল বন’ বলে ডাকবে। অন্যথায় প্রকৃতি ও মানবজাতিকে হুঁশিয়ার করে দেওয়া হলো, কোনো দোয়েল মনের সুখে গান গাইতে পারবে না। কোনো ঘুঘু পাখি মানবজাতিকে ঘুম ভাঙাবে না। চৈত্রের ঝাঁজালো দিনে বিরহী গান শোনাবে না। কোনো ডাহুক পরিবার সপরিবারে ঘুমপাড়ানির গান শোনাবে না। নাম না-জানা সকল প্রকার পাখি ও পতঙ্গের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেত বন নিজেই আবেদন জানায়, হে মানবজাতি, বেত বন ধ্বংস করো না, সকল প্রজাতিকে স্বাধীন আশ্রয় দেব। আমার সবুজে লুকিয়ে রাখব। আধুনিক বেত বন নয়, ঐতিহ্যবাহী দোয়েল বন। ঝোপকে ঝোপড়ার মতো থাকতে দেওয়া উচিত। ইজ্জত দিয়ে ‘দোয়েল বন’ ডাকা মাত্র।
আর যদি তাতেও কাজ না হয়, তবে জাতীয় পাখির নাম থেকে দোয়েল পাখি ফুড়ুৎ করে উড়ে যাবে। কখনো ফিরে আসতে পারবে না। দেশপ্রেমিকেরা শহরে মিছিল শেষে দোয়েল চত্বরে দোয়েলের মূর্তির সঙ্গে সেলফি তুলে মিডিয়ায় পোস্ট করবে। সবাই মুচকি হেসে বলবে, সুন্দর ছবি এসেছে। দোয়েল শুধু গল্পে আর কিচ্ছায় থাকবে। চিড়িয়াখানায় দুর্বল পরাধীন দোয়েলের চেয়ে প্রাণহীন মূর্তি অনেক ভালো। যেখানেই দোয়েলের বাসা ঝোপড়া না ডেকে জাতীয় পাখির সম্মানে ‘দোয়েল বন’ বলে ডাকব। দোয়েল বনে দোয়েলরা স্বাধীনভাবে বাস করবে, এটাই স্বাভাবিক। লজ্জা-সংকোচ কাটিয়ে, মনে মনে নয়, উচ্চস্বরে বলুন ‘দোয়েল বন’, শান্তি পাবেন। আহা প্রাণখুলে ডেকেই দেখুন না ‘দোয়েল বন’, প্রাণটা জুড়িয়ে যাবে। ইথারে ইথারে ভেসে যাবে দোয়েলের কানে ‘দোয়েল বন’।