ক্ষমতাসীন দল থেকে ‘বিনা দাওয়াতে আসা’ বলা হলেও যথারীতি তাদের আপ্যায়ন, আদর-সমাদর নিয়ে ঢাকা ছেড়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে নিয়ে বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটারদের সঙ্গে ক্রিকেটও খেলেছেন। বোলিং-ব্যাটিং দুটোই করেছেন। প্রীতি ম্যাচটির একটি ভিডিও পর্যন্ত ছেড়েছে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। সব মিলিয়ে তার এবারের সফরকে নিজেদের জন্য আশীর্বাদ বলে প্রচারও করেছে সরকার তথা আওয়ামী লীগ। লু বিএনপির কারও সঙ্গে না বসায় উল্লাসও করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের ভুল-বোঝাবুঝির অবসান হয়ে গেছে, আর কাউকে স্যাংশন ধরনের কিছু দেওয়া হবে না, আগে দেওয়া স্যাংশনও তুলে নেওয়া হতে পারে বলে লু বাতাস দিয়ে গেছেন মর্মে কিছু গুঞ্জনও ছড়ানো হয়। তাদের এমন উইন-উইন ভাবের মধ্যেই বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপ। ঘটনা কিছুটা ‘কিসের মধ্যে কী’ অবস্থা হলেও সরকার এতে বিব্রত নয়। অনেকটাই স্বাভাবিক। বিএনপিও ভাবলেশহীন। তারা একে বড় কোনো ঘটনা মনে করছে না।
নির্বাচনের আগে যে বিষয়ে ভিসানীতি ঘোষণা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র, সেই ইস্যুতে জেনারেল আজিজের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর কেউ দুর্নীতিতে জড়িত থাকলে সেই বিষয়ে সেনাবাহিনীই ব্যবস্থা নেবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করে বলে জানান তিনি। যুক্তরাষ্ট্র তাদের দেওয়া বিবৃতিতে বলেছে, তারা যথারীতি বাংলাদেশকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সহায়তা করছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বক্তব্য আরও সিম্পল। তার মতে, এটি নতুন কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্র ব্যক্তি পর্যায়ে এমন নিষেধাজ্ঞা দিয়েই থাকে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কথায় আরও নির্লিপ্ততা। তিনি বলেছেন, এটা আরেকটা বিভ্রান্তি। র্যাব-পুলিশের ওপর স্যাংশন আগেও হয়েছে। এতে তাদের ভয়ংকর কাজ বন্ধ হয়নি। গণতন্ত্রও আসেনি। নিজেদের গণতন্ত্র নিজেদেরই ফিরিয়ে আনতে হবে।
সরকার বা আওয়ামী লীগ থেকে এই স্যাংশন ঠিক হয়নি বা জেনারেল আজিজ ভালো লোক- এমন দাবি করা হচ্ছে না। সদ্য সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের দুর্নীতি নিয়ে দেশীয় গণমাধ্যমে চাঞ্চল্যকর রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পরও একই ভূমিকা সরকারের। জেনারেল আজিজকে নিয়ে বছর কয়েক আগে আল-জাজিরায় ‘মাই ম্যান’ শিরোনামে যা বলা হয়েছিল, এখন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার বিবৃতিতেও প্রায় তা-ই বলা হয়েছে। আল-জাজিরারটি ছিল ডকুমেন্টারি বৈশিষ্ট্যে প্রধানমন্ত্রীসহ তার পরিবারকে জড়িয়ে। জারিকৃত স্যাংশন নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতির মাঝে তথ্য সেগুলোই। তবে প্রধানমন্ত্রী বা তার পারিবারিক সদস্যদের নাম নেই। ভেতরের খবর হচ্ছে, ক্ষমতাসীন সরকারের অন্যতম খাস সাবেক সেনাপতি জেনারেল আজিজ সম্পর্কে কিছু একটা হচ্ছে বা আসছে, তা ক্ষমতাসীন মহলের কারও কারও আগাম জানা ছিল। নানা কথার একপর্যায়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি জনসমক্ষে আনার আগে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসকে জানিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ আওয়ামী লীগের একটি শক্তিশালী গ্রুপও নানা কারণে চেয়েছে আজিজকে সাইজের লিস্টে ফেলে দিতে। বিএনপির কেউ কেউ তা জানলেও উৎসাহী হননি। তাই উত্তেজনা বা চাঞ্চল্য পুরোটাই গণমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম ও সাধারণ মানুষের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে।
জেনারেল আজিজ আহমেদ অবসরে যান ২০২১ সালের ২৪ জুন। এত দিন পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঢাকায় খবরটি এসেছে সোমবার মধ্যরাতে। স্বাভাবিকভাবেই তখন বাংলাদেশের মানুষ ঘুমিয়ে। ভোরের দিকে খবরটি জানাজানি হয়। আসলে জেনারেল আজিজের ভিসা বাতিল হয় ২০২১ সালে। তখন তার পরিবারের সদস্যদের ভিসা বাতিলের খবর ছিল না। তখনকার খবর ছিলÑসাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজকে যুক্তরাষ্ট্রে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। পত্র মারফতে তার মার্কিন ভিসা বাতিলের কথাও জানানো হয়েছে। কাতারভিত্তিক টেলিভিশন নেটওয়ার্ক আল-জাজিরায় ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স মেন’ শিরোনামে রিপোর্টটিতে আজিজের দুর্নীতি ও নানা অনিয়মের খবর প্রচারের কিছুদিন পর যুক্তরাষ্ট্র এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে তার ভাই হারিছ-জোসেফসহ পরিবারের বাকিদের নানা অপকর্ম তুলে আনা হয়। আজিজ তখন এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। তা এখনো করছেন। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে বোঝাপড়ায় মার্কিনি এ পদক্ষেপের কারণে ঘনিষ্ঠরাও এখন আজিজের পাশে নেই। প্রায় একই অবস্থা সাবেক আইজিপি বেনজীরেরও।
আল-জাজিরার রিপোর্টে রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে আজিজের ভাই সন্ত্রাসী জোসেফের সাজা মওকুফ, হারিছকে বিদেশে পালানোর ব্যবস্থা করে দেওয়ার বিস্তারিত বিবরণ ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের বিবৃতিতে এখন পরিষ্কার জানানো হয়েছে, আজিজ আহমেদের কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের অবমূল্যায়ন এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের আস্থা কমেছে। তিনি তার ভাইদের বাংলাদেশে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহি এড়াতে সহযোগিতা করেন। এ ছাড়া ভাইকে অন্যায্যভাবে সামরিক খাতে কন্ট্রাক্ট পাওয়া নিশ্চিত করেছেন। সরকারি নিয়োগের বিনিময়ে ঘুষও নিয়েছেন।
এ বিষয়ে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (আগের টুইটার) লিখেছেন, ‘আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা বাংলাদেশিদের সমর্থন করি। স্বচ্ছ সরকারি প্রক্রিয়ার পক্ষে কথা বলি। সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি প্রকাশে সহায়তাকারীদের সাধুবাদ জানাই।’ মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া ম্যাথিউ মিলারের ওই পোস্টটি শেয়ার করে নিজের অফিশিয়াল এক্স হ্যান্ডলে লিখেছেন, ‘সাবেক বাংলাদেশি জেনারেল আজিজ আহমেদ যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য অযোগ্য- আজকের এই ঘোষণা দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তাদের জবাবদিহি বাড়াতে আমাদের বাংলাদেশি অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতিকেই পুনর্নিশ্চিত করে।’