সর্বনাশা মাদকের লাগাম কোনোভাবেই টেনে ধরা যাচ্ছে না। প্রবাসে মাদকের ভয়াল থাবা এসে পড়েছে উঠতি বয়সের তরুণদের ওপর। প্রথমে ভেপ (ইলেকট্রনিক সিগারেট), তামাক জাতীয় সিগারেট, গাঁজা, এরপর পর্যায়ক্রমে ভয়ঙ্কর সব মাদকে আসক্ত হচ্ছে তরুণ সমাজের একটি অংশ। অভিভাবকেরা সন্তানের এই মাদকাসক্তি নিয়ে পড়েছেন নানান শঙ্কায়। তারা না পারছেন পরিস্থিতি সামাল দিতে, না পারছেন সামাজিক কারণে কাউকে বলতে।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, যেসব তরুণ একসময় ভেপ, সিগারেট ও গাঁজায় আসক্ত ছিল, তারা এখন ইয়াবা সেবন করছে। কেউ আসক্ত হচ্ছে মরণ নেশা স্ক্রিস্টাল মেথ-এ। ইয়াবায় তরুণরা হারিয়ে ফেলছে মানসিক ভারসাম্য। অন্যদিকে ইয়াবার চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী স্ক্রিস্টাল মেথ একসময় কেড়ে নিচ্ছে তরুণদের প্রাণশক্তি।
নিউইয়র্ক শহরে গাঁজাসেবন এখন বৈধ। ফলে এর প্রতি আর আকর্ষণ নেই মাদকসেবীদের। এখন নিত্যনতুন মাদক খুঁজছে তারা। আর তাদের মাদকের তালিকায় যোগ হয়েছে ক্রিস্টাল মেথ ও ইয়াবা। বিভিন্ন দেশ ঘুরে যুক্তরাষ্ট্রে নানা কৌশলে ঢুকছে ভয়াবহ সর্বনাশা এসব মাদক। নিউইয়র্কে বাংলাদেশি কমিউনিটির জন্য বড় উদ্বেগের কারণ বাংলাদেশি নতুন প্রজন্ম জড়িয়ে যাচ্ছে এই মাদকের সঙ্গে। শুধু জড়িয়ে পড়া নয়, বেচাবিক্রিতেও ঢুকে পড়ছে তাদের অনেকে।
নিউইয়র্কের বিভিন্ন পয়েন্ট প্রকাশ্যে নানান কৌশলে বিক্রি হচ্ছে মাদক। ব্রুকলিন ও ব্রঙ্কসের যেসব এলাকায় সর্বনাশা মাদক বিক্রি হচ্ছে, তার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। কিন্তু কুইন্সের চিত্র খুবই ভয়াবহ। কুইন্সের বাংলাদেশি অধ্যুষিত বিভিন্ন এলাকায় মাদক বিক্রি ও সেবনের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ছে বাংলাদেশি তরুণ সমাজ। প্রথমে সেবন এবং পরে সেবনের অর্থ জোগাড় করতে গিয়ে তারা মাদক ব্যবসায়ে নামছে। এর চেয়েও ভয়াবহ চিত্র হলো- মায়ানমারের তৈরি ইয়াবা ও থাইল্যান্ডের ক্রিস্টাল মেথ-এর মত ভয়াবহ সর্বনাশা এসব মাদক যুক্তরাষ্ট্রে আসছে মায়ানমার থেকে বাংলাদেশ হয়ে। নানান কৌশলে এসব মাদক পাঠানো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে।
ভয়ঙ্কর মাদক ক্রিস্টাল মেথ এবং ইয়াবা নিউইয়র্কের বাংলাদেশি অধ্যুষিত জ্যাকসন হাইটস, ব্রুকলিনের চার্চ ম্যাকডোনাল্ড, জ্যামাইকার হিলসাইডসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষের ঠিকানায় আসছে। আর এসব মাদক বিক্রির উত্তম স্থানও হচ্ছে বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকাগুলো। বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন প্যাকেটে করে মাদকগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ডিলারদের কাছে আসে। তারাই দালালের মাধ্যমে এগুলো বিক্রি করে থাকে। মাদকগুলো গ্রহণ করছে প্রবাসে বাংলাদেশি নতুন প্রজন্ম। এসব মাদক ব্যবহার করে তারা উচ্ছন্নে যাচ্ছে। সন্ধ্যার পর থেকেই জ্যাকসন হাইটস, জ্যামাইকা এবং ব্রুকলিনের বিভিন্ন স্ট্রিটে এ সব মাদক বিক্রি হচ্ছে। অধিকাংশ সময় গাড়িতে বসেই বা কোন কোনো বাসা থেকে এগুলো দেদারসে বিক্রি করা হচ্ছে। বেশ কয়েকজন জানিয়েছেন, মাদক সেবনকারী ও ব্যবসায়ীরা সাধারণত রাতে বের হয়। এদের ব্যবসা চলে রাতেই।
জ্যাকসন হাইটস এবং ব্রুকলিন এলাকায় বেশ কয়েকজন আছেন তারা শুধু মাদক বিক্রিতেই ব্যস্ত। তাদের অন্য কোন ধান্ধা নেই, একমাত্র ধান্ধা মাদক বিক্রি করা। কখনো এসব মাদক পোস্টাল সার্ভিসে, আবার লাগেজে বা অন্যপন্থায়ও আসছে।
জ্যাকসন হাইটস এলাকাকে বলা হয় বাংলাদেশিদের প্রাণকেন্দ্র। আর বাংলাদেশি মাদক ব্যবসায়ীরা টার্গেট করেছে নিউইয়র্কের এই জ্যাকসন হাইটসকে। যে কারণে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্যাকসন হাইটসের কয়েকটি এলাকায় রমরমা মাদকের ব্যবসা শুরু হয়। প্রশাসনের নির্লিপ্ততায় জ্যাকসন হাইটসের বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ও বাসিন্দাদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী জানান, রাত ১২টার পর ৩৭ অ্যাভিনিউর বিভিন্ন স্ট্রিটের কর্ণারে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়ে মাদক বিক্রি করছে তরুণ প্রজন্ম। বিভিন্ন সাংকেতিক নামে তারা বাংলাদেশের ইয়াবা বিক্রি করছে। জ্যাকসন হাইটসে ইয়াবা বিক্রির প্রচলন বেশী।
জ্যাকসন হাইটসে ইয়াবার ছড়াছড়ি থাকলেও কুইন্সের জ্যামাইকার বিভিন্ন স্পটে প্রকাশে ক্রিস্টাল মেথ ও ইয়াবা বিক্রি হচ্ছে। বিশেষ করে হিলসাইড অ্যাভিনিউ সংলগ্ন বিটুইন ১৬২ ও ১৬৪ স্ট্রিটের ৮৭ রোডে একসঙ্গে একাধিক গাড়ি থামিয়ে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা মাদক বিক্রি হচ্ছে। এলাকার বাসিন্দারা একাধিকবার ৯১১-এ কল করে মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করেছে। কিন্তু পুলিশ মাদক ব্যবসায়ীদের কিছুই বলছে না। এমনকী নো পার্কিং এলাকায় দিনরাত ২৪ ঘণ্টা অবৈধভাবে গাড়ি পার্ক করে রাখলেও এসব গাড়িতে কোনো ট্রাফিক টিকেট দেওয়া হচ্ছে না। এসব ঘটনায় পুলিশের ওপর আস্থা হারাচ্ছে এলাকার বাসিন্দারা।
এদিকে প্রবাসে উঠতি বয়সের সন্তানদের নিয়ে উদ্বিগ্ন বাবা-মায়েরা। এতদিন উৎকণ্ঠা ছিল উঠতি বয়সের ছেলেকে নিয়ে। কিন্তু নতুন করে উৎকণ্ঠার প্রহর গুনতে হচ্ছে তরুণী সন্তানের জন্য। এসব তরুণী বিশাল মাদক নেটওয়ার্কে জড়িয়ে পড়ে ডেকে আনছে সর্বনাশ। বিষয়টি প্রশাসনের নজরে এসেছে। কিন্তু কোনোভাবেই ভাঙা যাচ্ছে না এই নেটওয়ার্ক। বরং প্রবাসী মাদকে ভয়ঙ্কর আসক্তি বাড়ছে তরুণীদের।
বৈশ্বিক মহামারী করোনার আঘাতের পর প্রবাসে তরুণীদের মাদকে আসক্তি বেড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এর কারণ হিসাবে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনায় মানসিক রোগের বিস্তার ঘটেছে ব্যাপক হারে। এটি যেমন তরুণদের মানসিকতার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে, তেমনি তরুণীদের আরো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে তরুণীরা চিকিৎসকের শরণাপণ্ন না হয়ে প্রথমে এনার্জি ড্রিংকস এবং অ্যালকোহলিক বেভারেজে আসক্ত হয়েছে। পরে আরো নানান ধরনের খারাপ নেশায় পা বাড়িয়েছে। অনেকে গা ভাসিয়েছেন ইয়াবার মত ভয়ঙ্কর নেশায়। কেউ আরো ভয়ঙ্কর নেশা ক্রিস্টাল মেথ সেবন করছেন। নিউইয়র্কের বিভিন্ন এলাকায় ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথ এখন অনেকটাই সহজলভ্য।
ভয়ঙ্কর ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথের উৎপাদনস্থল মায়ানমার। দেশটি থেকে বিভিন্ন রুট হয়ে এসব ভয়ঙ্কর মাদক ঢুকছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস, এস্টোরিয়া, জ্যামাইকা, ব্রুকলিন ও ব্রঙ্কসের কয়েকটি এলাকায় ইয়াবা ও ক্রিস্টার মেথ বিভিন্ন সাংকেতিক নামে বিক্রি হচ্ছে। স্কুল ও কলেজের তরুণ-তরুণীরা এসব মাদক সংগ্রহ করে সেবন করছে। তবে ইদানিং বেশকিছু বাংলাদেশি তরুণী মাদক সেবন ব্যবসায়ে জড়িয়ে পড়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া খবরে জানা গেছে। তরুণীদের আসক্তির হার ক্রমেই বাড়ছে বলে অভিভাবকেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন তাদের সন্তানদের নিয়ে।
এস্টোরিয়া এলাকার বেশ কয়েকজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এতদিন শুনেছি তরুণরা মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এখন দেখছি তরুণীরাও কম যায় না। অনেক তরুণী বিলাসী জীবনের জন্য ধনাঢ্য ছেলেবন্ধুকে বেছে নেয়। কিন্তু এখন অবস্থা পাল্টে গেছে। এখন অনেক তরুণী মাদকসেবনকে বিলাসী জীবন মনে করে। মাদকের অর্থ সংগ্রহের জন্য অনেকে মাদক ব্যবসা করছে। মাদক সংক্রান্ত মামলায় যত গ্রেপ্তার, এর শতকরা ২৬ ভাগই নারী।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে মাদক সেবনের দ্বারা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হচ্ছে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক, নৈতিক মূল্যবোধ। একটি জাতির সামাজিক, মানবিক মূল্যবোধ ধ্বংসের অন্যতম এই হাতিয়ার মাদকের বিরুদ্ধে যথাসময়ে সঠিক পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন না করলে প্রবাসে তরুণ সমাজ অচিরেই ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রবাসে আমাদের নতুন প্রজন্ম যেমন ভালো স্কুল ও কলেজে পড়ছে, ভালো চাকরি করছে, তেমনি মাদকের কারণে বদনামও কুড়াচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিউইয়র্কের একজন বাংলাদেশি নারী চিকিৎসক জানান, মাদকের নেশা এমনই এক নেশা, যে নেশার কাছে সমাজ-সংসার সব তুচ্ছ হয়ে যায়। মাদক সেবন করাই তাদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। সর্বনাশা মাদকের ছোবলে বহু সংসার ছারখার হয়ে যাচ্ছে। তিনি জানান, তার চেম্বারে একাধিক তরুণী আসছেন যারা মাদকাসক্ত। তারা এ থেকে বেরিয়ে আসতে চান। কিন্তু তাদের ফিরে আসাটা কঠিন হয়ে পড়েছে। মাদক তাদের জীবনকে প্রায় তছনছ করে ফেলেছে। আর তাদের এ অবস্থা দেখে পরিবারের সদস্যরা চোখের জল ফেলছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন চিকিৎসক জানান, নেশার জগতে এতদিন সর্বনাশা নাম ছিল ইয়াবা। কিন্তু মাদক কারবারীরা আবিষ্কার করেছে আরো ভয়ানক মাদক। যার নাম ক্রিস্টাল মেথ বা আইস। বাংলাদেশে যা নতুন। ইয়াবার চেয়েও ভয়ংকর নতুন এই মাদকের প্রবেশ ঘটেছে নিউইয়র্কেও। তরল এই মাদক মানবদেহের জন্য ইয়াবার চেয়ে ৫০ গুণ বেশি ক্ষতিকর। এর দামও বেশি, মৃত্যুর ঝুঁকিও বেশি। আফ্রিকার কোনো কোনো দেশ থেকে আসছে আইস মাদক। কাঁচের একটি লম্বা ফানেলের নিচে তরল এই মাদক রেখে আগুনের তাপ দিলে বের হয় ধোঁয়া। আর এই ধোঁয়ায় বুঁদ বিভিন্ন দেশের তরুণ তরুণীরা।
একটি সূত্র জানায়, স্নায়ু রোগের ওষুধ তৈরির উপাদান এমফিটামিন থেকে এই নেশার উৎপত্তি। এই নেশার মৃত্যু ঝুঁকিও বেশি। মাদকের এই ভয়াল থাবা থেকে প্রবাসের তরুণ সমাজকে রক্ষা করতে সবাইকে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশি কমিউনিটির দায়িত্বশীলরা হাঁটছেন উল্টোপথে। বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবেন কে?