এক, দুই, তিন..., এভাবে ভাঙতে ভাঙতে ফোবানা ৫টিতে এসে দাঁড়িয়েছিল। গত বছর কানাডার মন্ট্রিয়ালে যে ফোবানা সম্মেলন হয়েছে, নেতৃত্বের কোন্দলে সেই ফোবানাও আরেক দফা ভেঙেছে। তারা বিভক্ত হয়ে এ বছর লেবার ডে উইকেন্ডে কানাডার টরন্টোতে পৃথক ফোবানা সম্মেলন ডেকেছে। অর্থাৎ ফোবানা এখন ৬টি ভগ্নাংশ। তারপরও সবাই দাবি করছেন যে তারাই আসল ফোবানা।
এদিকে ফোবানার এই নেতৃত্বের কোন্দলের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে। সম্মেলন তিনদিন হয়। আর এর রেশ চলে সারা বছর। অর্থাৎ সারা বছর কমিউনিটিতে এই বিরোধ নতুন নতুন বিরোধের জন্ম দেয়। অতীত পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এ পর্যন্ত বাংলাদেশি কমিউনিটিতে যত বড় বড় বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে, সবকিছুর নেপথ্যে ফোবানার বিরোধ মুলত দায়ী। বহুবার ঐক্যের আলোচনা হয়েছ্।ে কিন্তু কোনো আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। ফলে একসময় যারা কাঁধে কাঁধ রেখে চলতেন তাদের এখন মুখ দেখাদেখি বন্ধ এই ফোবানার কারণে।
জানা গেছে, গত বছর মন্ট্রিয়াল ফোবানার পর নতুন নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ও সদস্য সচিবের নাম ঘোষণা করা হয়। নতুন চেয়ারম্যান করা হয় মূলধারার রাজনীতিক গিয়াস আহমেদকে এবং সদস্য সচিব করা হয় বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শাহনেওয়াজকে। কথা ছিল তারা পূর্ণাঙ্গ কমিটি করবেন। কিন্তু নেতৃত্বের রেষারেষিতে ৯ মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো কমিটি হয়নি। সংবাদ সম্মেলন, পাল্টা সংবাদ সম্মেলন হয়েছে। এমনকী ঐক্যও হয়েছে। কিন্তু সেই ঐক্য টেকেনি। যা হবার তাই হয়েছে। পাল্টাপাল্টি ফোবানা সম্মেলন ডেকে নিজেদের ভাঙন স্পষ্ট করেন ফোবানা নেতৃবৃন্দ। বর্তমানে একাংশের নেতৃত্বে রয়েছেন গিয়াস আহমেদ এবং আরেক অংশের নেতৃত্বে রয়েছেন শাহনেওয়াজ।
স্টিয়ারিং কমিটির একাংশের চেয়ারম্যান গিয়াস আহমেদ গত ৮ জুলাই শনিবার নিউইয়র্কের একটি রেস্টুরেন্টে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জানান, ফোবানা সম্মেলন কানাডার টরেন্টোতে ১-৩ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হবে। সংবাদ সম্মেলনে তিনি তার একসময়ের সহযাত্রী আলী ইমাম শিকদার ও কাজি আজমকে ‘ব্যাড এলিমেন্ট’ ইঙ্গিত করে ফোবানা থেকে বের করে দেওয়ারও ইঙ্গিত দেন। সংগঠনের স্টিয়ারিং কমিটির পরবর্তী সভায় তাদের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানান গিয়াস আহমেদ।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ডা. খন্দকার মাসুদুর রহমান, হাসানুজামান হাসান, কাজী তোফায়েল ইসলাম, সৈয়দ এনায়েত আলী, কাজী ওয়াহিদ রহমান এলিন, জাহাঙ্গীর আলম, শাহাদত হোসেন রাজু, নাজমুল আলম শ্যামল প্রমুখ।
এক প্রশ্নের জবাবে সংবাদ সম্মেলনে গিয়াস আহমেদ বলেন, স্টিয়ারিং কমিটির এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি শাহ নেওয়াজ গাটস নিয়ে কাজ করতে পারেন না। তিনি মুলত মোহাম্মদ হোসেন, কাজী আজম ও আলী ইমামদের হাতে বন্দী। এই তিনজনের কারণেই ফোবানা নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। তিনি ফোবানা নিয়ে সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসেনের বিভিন্ন ব্যর্থতার কথাও তুলে ধরেন সংবাদ সম্মেলনে।
সংবাদ সম্মেলনে গিয়াস আহমেদ বলেন, তাদের সাথে ঐক্যের সম্ভাবনা এখনো রয়েছে। ফলে টরেন্টোতে একটি ফোবানা হলেও হতে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন গিয়াস আহমেদ।
এদিকে টরেন্টো ফোবানা অনুষ্ঠানের জন্য শাহনেওয়াজ সমর্থকদের ফোবানা সম্মেলনের জন্য একটি কমিটি হয়েছে। সেখানে আবুল আজাদ আহবায়ক , মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া চেয়ামর্যান ও নজরুল ইসলাম মিন্টু প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচিত হয়েছেন। গত ৯ জুলাই রোববার কানাডার টরেন্টো শহরের ড্যানফোর্থ আলমানী রেস্টুরেন্টে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশি কানাডিয়ান ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটির সভাপতি মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়ার সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক আবুল আজাদের পরিচালনায় এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন ফোবানা স্টিয়ারিং কমিটির এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি শাহ নেওয়াজ, সহ-সভাপতি কাজী আজম, সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান সভাপতি মোহাম্মদ হোসেন খান ও সদস্য নিশান রহিম। মতবিনিময় সভায় স্টিয়ারিং কমিটি টরেন্টো শহরে ৩৭তম ফোবানা সম্মেলন অনুষ্ঠানের জন্য আহবায়ক আবুল আজাদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি হস্তান্তর করেন এক্সিকউটিভ সেক্রেটারি শাহ নেওয়াজ।
মত বনিময় সভায় আরো অংশ নেন- ১৪তম ফোবানার আহবায়ক মাহবুব রব চৌধুরী, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. জসিম উদ্দীন আহমেদ, বাবুল চৌধুরী, অ্যাডভোকেট অদিয়া বেগম, মার্জিয়া হক ও শহিদুল হক। উল্লেখ্য, আগামী ১-৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ টরোন্টো শহরে ৩৭ ফোবানা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।
এদিকে জাকারিয়া চৌধুরী, বেদারুল ইসলাম বাবলা, আতিকুর রহমান ও শাহেদা শিকদার হাই এর নেতৃত্বাধীন অংশের ফোবানা হচ্ছে কানাডার মন্ট্রিয়ালে। টেক্সাসের ডালাসে অনুষ্ঠিত হবে রেহান রেজা, আহসান চৌধুরী, মাসুদ রব চৌধুরী, নাহিদ খান ও আবীর আলমগীরদের নেতৃত্বাধীন অংশের। সবগুলো ফোবানা সম্মেলনই অনুষ্ঠিত হচ্ছে ১-৩ সেপ্টেম্বর লেবার ডে উইকেন্ডে।
উত্তর আমেরিকায় বাংলাদেশিদের ঐক্য আর সংহতি বৃদ্ধির লক্ষ্যে তিন দশক আগে ফেডারেশন অব বালাদেশি অ্যাসোসিয়েশনস ইন নর্থ আমেরিকা বা ফোবানা নামের সংগঠনটি গড়ে উঠেছিল। হাওর-নদী-সাগর পাড়ি দেওয়া স্বদেশিদের ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ফোবানা তার যাত্রা শুরু করে। ফোবানা সম্মেলন উত্তর আমেরিকায় বসবাসরত বাংলাদেশিদের আনন্দ অভিযাত্রার তিলক হয়ে উঠে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব ব্যক্তিত্ব এই সম্মেলনে অংশ নিতে উন্মুখ হয়ে থাকতেন। আমেরিকা ও কানাডার নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশিরা যেমন ছুটে আসতেন, তেমনি ইউরোপ থেকে অতিথিরা এসে যোগ দিতেন এই সম্মেলনে। নেতৃত্ব আর দখলদারির কবলে পড়ে আজ জৌলুস হারিয়েছে ফোবানা। একই নামে আমেরিকার একাধিক শহরে ফোবানা সম্মেলন হচ্ছে। টানাপোড়েনের কারণে প্রবাসীদের ফোবানার প্রতি আগের সেই আবেদন আর নেই। তারপরও ফোবানার নাম শুনলে প্রবাসের লোকজন শিহরিত হোন। স্বপ্ন দেখেন, দূর দেশে নিজেদের ঐক্য আর সংহতির।