কবিতা হচ্ছে সত্যানুসন্ধানের এক চিরন্তন শক্তি। যার মাধ্যমে মানুষ, পৃথিবী ও প্রকৃতির সমস্ত বৈভবের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। কবিতা কখনো আনন্দের, কখনো বিষাদের। কখনো দুঃখ-কষ্ট, আক্ষেপ-অনুকম্প, রাগ-অনুরাগ ও বিরহকাতর বেদনাবিভোর হৃদয়ে অনুভূতির আকুতিভরা নির্যাস। আবার কখনো প্রেম-ভালোবাসা, রাগ-অনুরাগ ও তেজস্বিতার দীপ্তালোক প্রখর-বলিষ্ঠতম দ্রোহ ও প্রতিবাদের হাতিয়ার। মনের দৃঢ়তা থাকলে সাহিত্য দ্বারা অনেক অসাধ্যকেও জয় করা সম্ভব।
কবির কাজ হলো কবিতার গূঢ় রহস্য এবং অধরা মাধুরীর সৌন্দর্যসমূহকে উদ্্ঘাটন করা এবং সবার জন্য উন্মোচিত করে দেওয়া। পৃথিবী ও প্রকৃতির দূরূহ মার্গের কাব্যসন্ধানের আড়ালে পড়ে থাকা প্রকৃতি, মানুষ ও প্রেমের বিশুদ্ধতাকে সহজভাবে উপস্থাপন করা।
যা-ই হোক, কারো বই নিয়ে আলোচনা করার অর্থ এই নয় যে তার ভুলগুলো খুঁটে-খুঁচে বের করে লেখককে কুপোকাৎ করা! শুধু সমালোচনা আলোচকের কাজ নয়। একজন আলোচকের মনে রাখতে হবে, যার সম্পর্কে তিনি বলছেন, লেখককে উৎসাহিত করার জন্য তার একটা দায় আছে। আলোচক প্রাসঙ্গিক বিষয়ের ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং অসংগতির বিষয়ের আলোচনা করবেন। সমালোচনা ও আলোচনার দুটো ক্ষেত্রে অবশ্যই লেখককে তার সাহিত্যমনস্ক উৎকর্ষের দিকটি দেখেই গুরুত্ব দিতে হবে।
কেউ যদি বলেন, অমুকে যা লিখেছেন, সেসব কবিতা হয়নি। তাকে কবি বলা যাবে না! অনেকেই এ ধরনের মন্তব্য দিয়ে ফেলেন। তাহলে কবি হতে হলে কী করা উচিৎ?
কিছুদিন আগে নিউইয়র্কে ‘সাহিত্য একাডেমি’র একটি আসরে একজন সজ্জন কবি বক্তৃতায় প্রবাসের কবিদের উদ্দেশে বলে বসলেন, কবি হতে হলে এখানে বসে চর্চা করলে চলবে না। ঢাকার কবি ও কবিতার সঙ্গে সংযোগ ও পরিচিতি ঘটাতে হবে (!)।
আমি এ ধরনের বক্তব্যের, মন্তব্যের সাথে দ্বিমত প্রকাশ করি। এখানে আমরা এমারসনের বিখ্যাত উক্তিকে তুলে ধরতে পারি। তিনি বলেছেন, ‘সবাই মনে মনে কবি।’ যদি তা-ই হয়, পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে কাব্যসৃষ্টির মাধ্যমে নিজেকে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব।
আসলে প্রত্যেকের মাঝেই মেধা-মনন চেতনার লুক্কায়িত সত্ত্বা আছে। পাঠককে টানার মুগ্ধতা আছে। কাব্যসৃষ্টির সময় কবিতার ফরম্যাটে সাজিয়ে নিতে পারলে সেটিই কবিতা হতে পারে। এ জন্যই আলোচ্য কাব্যগ্রন্থের জনক আকবর হায়দার কিরণকে আমরা নির্দ্বিধায় একজন সৃষ্টিশীল কবি বলতে পারি।
কবি একজন বিনয়ী ও নম্র স্বভাবের মানুষ, তার রচনায় রুচিমান ও রোমান্টিক প্রেমের বিষয়টি প্রবল। প্রবাসের দীর্ঘতম যাপিত জীবনের নানান পর্বে কবিতায় তার ভেতরকার সেসব বৈশিষ্ট্যের পরিস্ফূটন ঘটেছে। কিন্তু এতদিনের অগ্রন্থিত ও অনাবিষ্কৃত কবিতাসমূহ পড়ার পর তাকে একজন মননশীল কবি হিসেবে আখ্যা দিতে কার্পণ্য করা উচিৎ নয়।
এই কাব্যগ্রন্থের শুরুতে আকবর হায়দার কিরণ ও তার কবিতা সম্পর্কে কভারসাইডে অকালপ্রয়াত স্বনামধন্য সাংবাদিক ও কলামিস্ট শ্রদ্ধেয় মাইন উদ্দিন হৃদয়গ্রাহী প্রাককথনে যথার্থ লিখেছেন, ‘আকবর হায়দার কিরণ একজন ভালো মনের সহজ-সরল মানুষ। তার কবিতাগুলো পড়ে আমার মনে হয়েছে, তিনি কবিতায়ও নিজেকে একজন পরিচ্ছন্ন মনের মানুষ হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। সহজ ও সাবলীল প্রকাশভঙ্গিটি তিনি অনুসরণ করেছেন। বক্তব্য খুবই খোলামেলা এবং অকপট।’
আলোচ্য গ্রন্থে মোট ৭৩টি কবিতা রয়েছে। সবগুলো প্রেমের কবিতা না হলেও সেসব কবিতায় অনুভূতিশীল পাঠকের জন্য নির্যাসিত প্রেমের অলংকরণ কাব্যমালায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
কবি যে আপাদমস্তক একজন প্রেমিক ও রোমান্টিক মানুষ, কবিতার সহজতর বর্ণনায় সুকৌশলে তিনি তা সর্বজনবোধ্য করার চেষ্টা করেছেন। তার কবিতায়
ভিন্ন ধাঁচের কিছু পঙ্্ক্তিমালা পড়লেই তা পরিষ্কার বোঝা যায়, যেখানে প্রেমের নিবিড় সম্পূর্ণতা ফুটে উঠেছে কাব্যগ্রন্থ ‘সেভেন ট্রেন ও কিছু প্রেমের কবিতা’র মাধ্যমে।
মানুষমাত্রই ছন্দোবদ্ধ জীবনের পরম্পরা। মানুষের জীবনটাই ছন্দময়। কিরণের মাঝে কাব্যিক সুমধুর ছন্দমিলের কিছুটা ঘাটতি থাকলেও তার প্রতিভার বিষয়টি পাঠককে আলোড়িত করবে, অভিভূত করবে। কাব্যরচনায় তিনি তার হৃদয়ের আবেগ-অনুভূতি ও উচ্ছ্বাসকে বেশ সংহত এবং ছন্দরীতিতে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। এ ধরনের মননশীলতার প্রক্রিয়া অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার।
আমার প্রত্যাশা, তিনি ভবিষ্যতে আরও কবিতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে অকৃত্রিম সৌন্দর্যের আকরে কবিতাকে সঙ্গে রাখবেন। আশা করি, কবিতার নিসর্গ বর্ণনায় জীবনরসে সঞ্জীবিত রাখার প্রতি তার সংবেদনশীল রচনার কার্যকর দৃষ্টি থাকবে, যা পাঠককে আলোড়িত করবে। যেমন একটি কবিতায় অন্য রকম রোমান্টিকতার পরিস্ফূটন দেখতে পাই-
‘সেদিন তোমার চোখে মুখে দেখলাম
অন্য রকম এক দ্যুতি
প্রেমে পড়লে চেহারায় এ ধরনের
ভাবসাব ফুটে ওঠে।
সেদিন বিকেলে তোমায় দেখে মনে হলো
তুমি হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছ...’
এখানে তার দূরস্থিত চাহনি এবং কবিতার হৃদয়খোলা বাদনশৈলীর মুগ্ধতা লক্ষণীয়, যেখানে প্রেমিক-প্রেমিকাকে কাছে নিয়ে আসার চমকপ্রদ চুম্বক লুক্কায়িত আছে।
প্রেমের কল্পনাপ্রবণ অনুভূতিই মূলত ভালোবাসার চূড়ান্ত রূপ। প্রেম দ্বারা একজন অন্যজনের প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভূত হয়। প্রেম হচ্ছে ভালোবাসার গভীরতর আবেগ-অনুভূতি পরিস্ফূটনের সুনির্মল বহিঃপ্রকাশ।
বিশ্বনন্দিত সাহিত্যিক উইলিয়াম শেক্সপিয়ার লিখিত অমর প্রেমের নাটকের অবলম্বনে রোমিও এবং জুলিয়েটের চিত্রশিল্পী ‘ফোর্ড ম্যাডক্স ব্রাউন’র একটি বিখ্যাত তৈলচিত্র, যা পৃথিবীর কিংবদন্তি চিত্রকলার অন্যতম। এই ছবিটি দ্বারা ১৮৭০ সালের প্রত্নতাত্ত্বিক রোমান্টিক দম্পতি বলে মনে করা হয়। এই রূপকল্পের চিত্রকলা ও নাটকের আইকনিক ব্যালকনি দৃশ্যকে চিত্রিত করে নাটকের মূল চরিত্র রোমিও এবং জুলিয়েটের প্রেমকে আরও বেশি অমর ও অবিনশ্বর করে তুলেছে। আমরা আরও জানি, শেক্সপিয়ারের সাহিত্যকর্মের বেশির ভাগই ছন্দময় এবং কাব্যগাথায় নির্মল প্রেমের রসোত্তীর্ণ আদলে সৃষ্টি। প্যারিসের লুব মিউজিয়ামের সহস্র ছবি ও অবিস্মরণীয় চিত্রকলার মিলিত সম্ভারের কোনো এক স্থানে ওদের (রোমিও-জুলিয়েট) প্রেমনিঃসৃত রূপকল্পের অবিনশ্বর চিত্ররূপের মোহময়তা এখনো মনোমুগ্ধকর। সেই সূত্রে ইউসুফ-জোলেখা, লাইলি-মজনু ও চণ্ডীদাস-রজকিনীর চিরন্তন প্রেমের কল্পছবিতে আচ্ছন্ন হয়ে এখনো আমরা ভালোবাসার উত্তাল সমুদ্রে হাবুডুবু খাই।
কিরণ তার নিষ্কলুষ প্রেমের বর্ণনায় যে পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন, তাতে মুগ্ধ হওয়ার মতো অনেক উপকরণ রয়েছে। প্রেম শাশ্বত সুন্দর চিরন্তন অনির্বাণ অবিনশ্বর। প্রেম মানুষকে চিরন্তন ঐশ্বর্য দান করে। ভালোবাসার অবগাহনে প্রেমিক-প্রেমিকা কখনো আত্মভোলা হয়ে যান। আবার কখনো একাকিত্বের শূন্যতা ও নিমগ্নবেদনায় তাকে নিঃসঙ্গ করে তোলে। যেমন কিরণ তার ‘তুমি যদি চলে যাও’ কবিতায় বলে ওঠেন-
‘তুমি যদি চলে যাও আর কোথাও
আমি বিষণ্নতাকে সাথি করে নেব
অমাবস্যার কালো রাত হবে
আমার নিত্যদিনের একমাত্র সঙ্গী...’
কবিতার উদ্ভিন্নযৌবনের মধ্য দিয়ে তার মনন ও চেতনার কীর্তিকে প্রকাশ করার প্রাণবন্ত প্রচেষ্টায় ‘আকাশ সমান জানালা’ কবিতায় কবি তার স্বপ্রাণ উদ্ভাসে প্রস্ফূটিত হয়ে ওঠেন। ফেলে আসা দিনের নির্মীলিত স্মৃতি নিয়ে তাই তো দৃঢ়ভাবে বলতে পারেন-
‘তারপর সেভেন ট্রেনে একসাথে ঘরে ফেরার
সেই ঐতিহাসিক সন্ধে
একান্ত আমরা দুজন ছাড়া সেদিন
কম্পার্টমেন্টে আর কেউ ছিল না
সেদিনের সেই প্রগাঢ় চুম্বন আজ
হয়ে গেছে ইতিহাস...’
একেবারে নিখাদ ও অকপট বর্ণনা। কোনো রাখঢাক নেই। নেই কোনো দুর্বোধ্যতা। ওর কবিতাগুলো একেবারে মেদহীন নির্ভেজাল ও সাবলীল।
আগেই উল্লেখিত হয়েছে, ছবি ও মিউজিয়ামের শহর প্যারিসে সহস্র ছবি এবং অবিস্মরণীয় চিত্রকলার মিলিত সম্ভারের স্থানে স্থানে প্রেমনিঃসৃত চিত্ররূপের চিরায়ত মোহময়তায় যেমন প্রাচীন সাহিত্যের বিয়োগান্ত প্রেমের অনেক উপাখ্যান রয়েছে, তেমনি পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য নিদর্শন।
আকবর হায়দার কিরণ তার রহস্যময় কাব্যসাধনা করতে গিয়ে কবিতায় বেদনানির্যাস হতাশাদীর্ণ অন্তরস্পর্শী শূন্যতার কথাও নির্দ্বিধায় বর্ণনা করেনÑ
‘আমি এক বর্শাবিদ্ধ আহত পাখি হয়ে
উড়তে উড়তে কোনো অনন্তে চলে যাব
কোথায় গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকব
গভীর পিপাসা নিয়ে কার কাছে
এক ফোঁটা জল চাইব জানা নেই আমার।’
তেমনি তার নিষ্কলুষ প্রেমের অভিব্যক্তি ও বর্ণনাসমূহ দেখে অভিভূত হওয়ার মতো। এখানে কবিকে কখনো রিয়ালিস্টিক এবং রোমান্টিক হতেও দেখা যায়।
কবিতার একটা অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে স্থিরতা, মুগ্ধতা এবং আর্শ্চয রোমান্টিকতার পরিস্ফূটনে বিভিন্ন রকম আকাক্সক্ষার বহিঃপ্রকাশ। যেখানে কবি পাঠককে আকৃষ্ট করতে পারেন। আকবর হায়দার কিরণের এমন একটি কবিতায় ঝরঝরে বর্ণনাÑ
‘বহুদিন বহুবছর পর একজন
বলল আপনাকে আমার ভালো লাগে
আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি
আমি আমার পাশে হেঁটে চলা সেই
মেয়েটির দিকে দেখতে পারিনি
দেখতে পাইনি তার চোখে কী ছিল।’
সবকিছুকে উতরে সারল্যময় রোমান্টিক কবিতার জমিনেও সে রকম অকৃত্রিম ভালোবাসার ছাপ ও মুগ্ধতা রয়েছে।
আমার প্রত্যাশা সাংবাদিকতার নির্মল সেবা ও সার্ভিসের মধ্য দিয়ে আকবর হায়দার কিরণ যেমন সবার মাঝে নিবিড়তর সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছেন, তেমনি বিনয়াবনত বৈশিষ্ট্যে তিনি একজন খাঁটি মানবপ্রেমী হয়ে উঠবেন এবং অতিশয় আধুনিক কবিতাকে ঘিরে থাকবেন।
আসলে সৃজনশীলতার বাসনা নিয়েই মানুষের জন্ম। সৃষ্টির মহাপ্রত্যয়ে মননশীলতার নানা রকম গুণরসে মানুষ ব্যস্ত থাকতে চায়। আকবর হায়দার কিরণও তার ব্যতিক্রম নন। আমরা চাইÑ তিনি তার নিষ্কম্প প্রেমগাথা কাব্যমালার মধ্য দিয়ে মননশীল সাহিত্যজগতে বিচরণ করবেন। অবারিত শিল্পমন ও কাব্যচেতনার নিগূঢ় টানেই তিনি পাঠককে আরও কবিতা উপহার দেবেন।
বর্তমান পৃথিবী ভারসাম্যহীন এবং অনেকাংশে বিপর্যস্ত। মানবতা এখন যে ধ্বংসের মুখোমুখি, তা থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজতে হবে। কেননা ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের কশাঘাতে ঝলসানো রুটি থেকেও অনেক মানুষ বঞ্চিত! পৃথিবীর এই বিবদমান সংঘাত ও বৈষম্য থেকে মুক্তির পথ কী? ধ্বংসবাজদের আগ্রাসন, চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধবিগ্রহ, ফ্যাসিবাদ ও পুঁজিবাদের উন্মুক্ত নির্লজ্জতার মধ্যেও মানুষকেই প্রেম নির্যাস, ভালোবাসার মহিমায় পৃথিবী ও প্রকৃতির নির্মল পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। কিরণ তার শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক জীবনে কবিতার গতিময়তাকে আরও বাড়িয়ে তুলবেন বলে আমাদের প্রত্যাশা।
ভালোবাসার কোনো গণ্ডি কিংবা বৃত্ত নেই। প্রেম অবারিত। যার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। যেকোনো অবস্থান থেকেই প্রেমনিঃসৃত ভালোবাসা প্রদর্শন করা যায়। যেমন একটি কবিতায়-
‘দৃষ্টির সীমানা ছাড়িয়ে অনেক দূরে
থেকেও ভালোবাসা যায়...’
শেষ দুটি লাইন-
‘ভালোবাসার নদীর তীরে একটি গাছ
উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে
যে গাছের একটি পাতাও কখনো ঝরে
পড়ে না শুকিয়ে যায় না।’
তার কোনো কোনো কবিতায় স্মৃতিময় জীবনের কথা এবং নিঃসঙ্গতার বেদনার কথাও ফুটে উঠেছে। তার কাব্যমালার বক্ষজুড়ে রয়েছে নিষ্কলুষ প্রেমের আরাধ্য কাহিনি। কবিতার নিবিড় মোহময়তায় তার স্বভাবসিদ্ধ চালচলনে যেমন মুগ্ধতা ছড়ায়, তেমনই তার পঙ্্ক্তিমালায় উন্মীলিত স্বচ্ছন্দ প্রবাহের অপূর্ব ঝংকারও আবিষ্কার করা যেতে পারে।
আসলে মানুষের জীবন বিচ্ছেদেরই পরম্পরা। তারই সুরে একাকিত্বের নিঃসঙ্গ-যন্ত্রণায় অতীতের কথা ভাবতে ভাবতে কবি কিরণ যখন ঘুমিয়ে পড়েনÑ এক অজানা হাহাকার চতুর্দিক থেকে ধেয়ে আসতে থাকে! তাই তো তিনি বলে ওঠেনÑ
‘চোখ বুজলেই দেখতে পাই
মা এসে দাঁড়িয়েছেন মাথার কাছে
এই বুঝি পরম যত্নভরে
মাথায় চুলে বুলিয়ে দেবেন হাত
বোনকে দেখি চেয়ে আছে
একরাশ মমতা চোখ নিয়ে
চোখ খুলতেই সব পালিয়ে যায়
মনটা ভরে যায় হতাশার অন্ধকারে।’
সৃজন-প্রতিভার নিপুণ প্রভা উজ্জ্বলতর নিয়ামক শক্তিতে কবি পৃথিবীর সৌন্দর্যের সঙ্গে মানুষকে মেলাতে চান। নিরেট সাবলীল সরস অকপট পরিশুদ্ধ ও পরিশীলিত সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়ে গভীর মমত্ববোধকে প্রকাশ করতে চান।
আকবর হায়দার কিরণের কবিতার চারণক্ষেত্র এবং তার কাব্যময়তার নির্মল ভুবন তৈরিতে যে আন্তরিকতার নিষ্কণ্টক বহিঃপ্রকাশ, সেটি অব্যাহত রাখতে পারলে সকল বৈপরীত্য ও সীমায়িত গণ্ডি পেরিয়ে চূড়ান্ত পূর্ণতায় পৌঁছাতে পারবেন। কাব্যমালার রাগ-অনুরাগ ও তেজস্বিতার দীপ্তি এবং বলিষ্ঠ দৃঢ়তা থাকলে শিল্প-সাহিত্য দ্বারা অসাধ্যকেও জয় করা সম্ভব।
আকবর হায়দার কিরণ বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পাশাপাশি কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে অন্তরছোঁয়া দীপ্তির আভা ছড়িয়ে নিবিড় সন্তর্পণে এগোতে থাকবেন বলে আমাদের প্রত্যাশা। আশা করি, তিনি তার অনুভূতিময় সময়স্রোতকে নিজের মননের সঙ্গে খাপ খাইয়ে পাঠকের ভেতরকার যেকোনো সন্দেহ ও সংশয় দূর করে দেবেন এবং কাব্যসৃষ্টির ছন্দময়তার প্রতি আরও বেশি সচেতন হবেন। কাব্যরচনায় নিজস্ব কৌশলের পাশাপাশি সেই সব দুর্বোধ্য অন্তরায় কাটিয়ে আরও বেশি সংবেদনশীল ও সাবলীল হয়ে উঠবেন। সাহিত্যজগৎ এবং কবিতার ভুবনে আকবর হায়দার কিরণের স্বচ্ছন্দ বিচরণ এবং সাহিত্যকর্ম অব্যাহত থাকুক। তার প্রতি শুভেচ্ছা এবং অনেক অনেক শুভকামনা।
(লেখাটি কুইন্স লাইব্রেরিতে সাহিত্য বিশ্লেষক নীরা কাদরী পরিচালিত ‘লেখকের অঙ্গন’ অনুষ্ঠান উপলক্ষে রচিত)।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।