স্বেচ্ছাচারীভাবে চাপিয়ে দেওয়া কয়েকটি ব্যাংক একীভূতকরণের ঘোষণা এবং এ প্রক্রিয়ায় থাকা ভালো ব্যাংকগুলোর অস্বস্তি, একীভূত হতে কোনো কোনো ব্যাংকের অনীহা ব্যাংকিং খাতে বাড়তি শঙ্কা-অস্থিরতা ভর করেছে। ভেতরের খবর হচ্ছে, একটি দুর্বল ব্যাংক ছাড়া কোনো ব্যাংকই নিজ উদ্যোগে একীভূত হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি, আবার এ প্রক্রিয়ায় নাম আসা সবল ব্যাংকগুলো স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে এতে যুক্ত হতে রাজি হয়নি। পুরোটাই আরোপিত। মোটকথা একীভূতের নামে অ্যারেঞ্জ নয়, মার্জার ম্যারেজ গর্তে প্যাকেট করে ফেলা হচ্ছে বাংলাদেশের ব্যাংকিং জগৎকে।
এ মার্জারকে এখন বেদনার রসিকতায় বলা হচ্ছে জোরাজুরির ম্যারেজ। সরকারি আয়োজনে তা দুর্বলের ইচ্ছায়, সবলের অনিচ্ছায়। কিন্তু মঞ্চে হাসিমুখে ‘কবুল’ বলতেই হচ্ছে। দেশে এখন ব্যাংকের সংখ্যা ৬১। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এত ব্যাংক দরকার ছিল কি না, এ প্রশ্ন থাকলেও গ্রাহ্য হয়নি সরকারের উচ্চ মহলে। একজনের মালিকানায় কতগুলো ব্যাংক থাকতে পারবে- এ প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীসহ অনেকের রক্তচক্ষু দেখতে হয়েছে। উপরন্তু বলা হয়েছে, এগুলো উন্নয়নের লক্ষণ। দেশের অর্থনীতির বিশালত্বের প্রকাশ। এখন বলা হচ্ছে অন্য কথা। দেখানো হচ্ছে মার্জার সিনারি। তা উন্নত বিশ্বেও আছে বলে সাফাই তো চলছেই।
এক্সিম, পদ্মা, বেসিকসহ কিছু ব্যাংকের মতো বাধ্যতামূলক মার্জার বা একীভূতকরণের উদাহরণ বিশ্বের কিছু দেশে আছে। ১৯৮০-এর দশকে আর্থিক খাতে সংস্কারের উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে একীভূত ও অধিগ্রহণের মাধ্যমে ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়। কিন্তু ফল ভালো আসেনি। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকব্যবস্থা ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক (ফেড) জেপি মর্গান চেজকে বাধ্য করেছিল বিনিয়োগ ব্যাংক বিয়ার স্ট্যার্নসকে কিনতে। বিয়ার স্ট্যার্নসের প্রতি শেয়ার ২ ডলারে কেনার জন্য আলোচনা শুরু হলেও পরে তা ১০ ডলারে গিয়ে ঠেকে। তখন বাজারে শেয়ারমূল্য ছিল ৩০ ডলার। এ জন্য ফেড ৩০ বিলিয়ন ডলার ঋণ সুবিধাও দেয় জেপি মর্গানকে। এই বেচাকেনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বিয়ার স্ট্যার্নসের শেয়ারধারীরা। লাভবান হতে পারেনি জেপি মর্গানও। অনেক বেশি দায় তাদের বহন করতে হয়েছে।
বাধ্যতামূলক একীভূতকরণের সাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে সুইজারল্যান্ডের দুই বড় ব্যাংক ইউবিএস ও ক্রেডিট সুইসের এক হয়ে যাওয়া। ইউবিএস মোটেই আগ্রহী না থাকলেও সংকটে থাকা ক্রেডিট সুইসকে বাঁচাতে বাধ্য করেছিল সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বছরখানেক ধরে ধুঁকতে ধুঁকতে ইউবিএস এখন ব্যাপক হারে ছাঁটাইয়ের দিকে এগোচ্ছে। এশিয়ায় একীভূতকরণের শুরু ১৯৯৭ সালে পূর্ব এশিয়ার আর্থিক সংকটের পর থেকে। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় বাধ্যতামূলকভাবেই কাজটি করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছিল ব্যাংক খাত সবল করা, লোকসান হ্রাস এবং খেলাপি ঋণ ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনার কথা। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ বৃহৎ শিল্প, ব্যাংক ও বিমাশিল্প জাতীয়করণ করে ১২টি ব্যাংককে একীভূত করে ৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। আশির দশকের শুরুতে উত্তরা ও পূবালী ব্যাংককে বাংলাদেশি মালিকদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর বেসরকারি খাতের ব্যাংকের অনুমতি দেওয়া হয়। এর পর থেকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে, নিজ দলের নেতা, কর্মী বা সমর্থকদের বেসরকারি ব্যাংক খোলার মাহেন্দ্রক্ষণ ধরা দিতে থাকে। এসব ব্যাংক অর্থনীতিতে অবদানের পাশাপাশি অর্থ আত্মসাতের পথও করে দিয়েছে। এ পথেই বাচ্চু চোখের সামনে বেসিক ব্যাংক খেয়ে ফেলেছেন। সিকদার পরিবার ন্যাশনাল ব্যাংককে ফাঁকা করে দিয়েছে। তার ওপর ব্যাংকে ব্যাংকে বেড়েছে খেলাপি ঋণ। মালিকরাই মনিচ্ছা মতো ঋণগ্রহীতা।
অন্যের ব্যাংকে চুরি-চামারির চেয়ে নিজের ব্যাংকে ডাকাতির জেরে বেশ কটি ব্যাংক চরম আর্থিক সংকটে ভুগছে। কয়েকটিকে দফায় দফায় কোরামিন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। কিছুসংখ্যককে আর কুলাতে না পেরে মার্জ করে দেওয়া হচ্ছে। একীভূতকরণের আলোচনায় সরকারি-সরকারি, বেসরকারি-সরকারি ও বেসরকারি-বেসরকারি তিন ধরনের ব্যাংকই রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোন বিবেচনায় এই ব্যাংকগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে একীভূত করার জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে কিংবা কোন সবল ব্যাংকের সঙ্গে কোন দুর্বল ব্যাংক একীভূত হবে, তা অস্পষ্ট। আবার একীভূত হওয়ার আলোচনার বাইরে থাকা বেশ কয়েকটি ব্যাংককে তারল্য সহায়তা দিয়ে টিকিয়ে রাখার রহস্যময়তা। মার্জার প্রথায় কে লাভবান হচ্ছে, কাদেরকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে, তড়িঘড়ি ও জোরপূর্বক ব্যাংক একীভূতকরণের মাধ্যমে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিদের দায়মুক্তির এ কৌশল অনেকের কাছেই পরিষ্কার। মার্জের নামে একদিকে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ও জালিয়াতিতে জড়িতদের সুরক্ষা মিলছে। সবল ব্যাংকগুলোতে খারাপ ব্যাংক হজম করিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টাও সফল। যা অস্বস্তি ও শঙ্কার নতুন বাতাবরণ ছড়িয়ে দিয়েছে পুরো ব্যাংকিং খাতে।
এর মাঝেই ব্যাংকগুলোকে সাংবাদিক এড়িয়ে চলার গোপন বার্তা দেওয়া হয়েছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক নিষিদ্ধই করে দেওয়া হয়েছে। তা কেন? লুটপাট বা লুকোচুরির তথ্য ঠেকাতে? জবাব নেই। নিয়মের কড়াকড়িতে সাংবাদিকেরা বাংলাদেশ ব্যাংকে গত এক মাস ধরে অবাধে প্রবেশ করতে পারছেন না। বলে দেওয়া হয়েছে ব্যাংকের নির্দিষ্ট অনুমতিপত্র (প্রবেশ পাস) নিয়ে শুধু মুখপাত্রের কাছে যেতে পারবেন। অন্য কোনো কর্মকর্তা পাস দিলে সাংবাদিকেরা তখন কেবল সেই কর্মকর্তার কাছেই যেতে পারবেন। ফ্লোর অনুযায়ী পাসের রংও ভিন্ন। এক ফ্লোরের পাস নিয়ে অন্য ফ্লোরে যেতে মানা। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকে এই সাংবাদিক আতঙ্ক নিয়ে অকথ্য-অপ্রিয় অনেক কথা ঘুরছে সংশ্লিষ্ট মহলগুলোতে।