কথায় বলে- সময়ই বলে দেয়, কখন কী করতে হয়। সুকান্তের ভাষায় ‘বেজে উঠল কী সময়ের ঘড়ি?/ এসো তবে আজ বিদ্রোহ করি’। অবশ্য বিদ্রোহ করার জন্য সব সময় সময়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় না। সময়ই এগিয়ে আসে অনেক ক্ষেত্রে। যদিও ওই বিদ্রোহ ঘোষণার জন্য সময়টা বড় বেশি সময় নিলো, প্রায় সাত মাসেরও বেশি।
এবং পঁয়ত্রিশ হাজারের মতো মানুষ মারা যাওয়ার পরে এই জাগরণটা কিছুটা হলেও প্রশ্নবোধক একটা চিহ্নের মতো সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে, এতটা সময় কেনো লাগল তাদের? খবরের বিবরণ অনুযায়ী, গত একটা সপ্তাহ ধরে আমেরিকার বিভিন্ন স্টেটের ৪০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীরা ‘স্টপ জেনোসাইড’ ব্যানার হাতে গিয়ে পথে নেমে এসেছেন। বিক্ষোভে-বিক্ষোভে উত্তাল ৪০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ। তাদের দাবি ‘ফিলিস্তিনের উপর ইসরায়েলি আগ্রাসী থাবা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। যুদ্ধ বিরতির ঘোষণা দিতে হবে এবং ইসরায়েরের সহযোগী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ঘৃণিত অবস্থান থেকে সরে আসতে হবে’। সবগুলো দাবি যুক্তিসঙ্গত হলেও এ পর্যন্ত বাইডেন সরকারের লাঠিয়াল বাহিনীর নির্মম অত্যাচারে অনেকেই আহত হয়েছেন, গ্রেফতার বরণ করেছেন শতাধিক শিক্ষার্থী। কিন্তু ওই আন্দোলন সরকারের লাঠিয়াল বাহিনীর ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
প্রথম আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ১০ দিনেরও বেশি সময় ধরে তারা বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিয়ে ক্যাম্পাসের প্রাঙ্গণে তাঁবু টানিয়ে অবস্থান ধর্মঘট করছে। শুরুতেই আন্দোলনরত যে আটজন তরুণ শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল, সেই আটজনের মধ্যে বাংলাদেশি এক সাহসী তরুণী সায়মুনা ইসলামও রয়েছেন। এসব শিক্ষার্থীদের বয়স আঠারো কিনা জানি না। কিন্তু আমাদের বিপ্লবী এক কবি সুকান্ত এসব তরুণদের নিয়ে ‘আঠারো বছর বয়স’ শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। ‘আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়/ পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা/ এই বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়/ আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা’। এই ক্ষেত্রে সুকান্তের উপলব্ধির সাথে সম্পূর্ণ এক্যমত পোষণ করে বলতে ইচ্ছে করছেÑ পথ চলতে, এ বয়স যায় না থেমে/ এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়/ এ দেশের বুকেÑ আঠারো আসুক নেমে’।
ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দেখা গেলো নিউইয়র্কের তরুণদের এই আন্দোলন থামাতে স্বয়ং পার্লামেন্টের স্পিকার পর্যন্ত ছুটে এসেছেন ঘটনাস্থলে এবং তিনি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এই আন্দোলনকে দমনের উদ্দেশ্যে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েনের কথা যখন জোর গলায় উচ্চারণ করলেন, তখন নিউইয়র্কের মেয়র এরিক অ্যাডামস নিজস্ব মতামতে অটল থেকে উড়িয়ে দিলেন স্পিকারের দাবিটি। একইভাবে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে দমনের উদ্দেশ্যে প্রশাসন থেকে যখন পুলিশ মোতায়েনের দাবি উঠলো, সেই দাবিও মেনে নিতে অস্বীকার করলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট!
ক্রমে ক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় ফিলিস্তিনী জনগণের ওপর ইসরায়েলি আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে সারা দেশব্যাপী তরুণ সমাজের গড়ে ওঠা বিক্ষোভ দিন দিন প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এখন শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণেরাই নিয়মিত বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছেন না, এই লেখা যখন লিখছি, তখন নিউজার্সির একটি স্কুল এবং সিয়াটলের আরো একটি স্কুলের শিক্ষার্থীরাও গাজার ওপর নারকীয় তাণ্ডবের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছেন। লেখাটি যখন প্রকাশিত হবে, ততোদিনে হয়তো এসব শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি আরো কিছু স্কুলের কিশোর শিক্ষার্থীরাও প্রতিবাদের ময়দানে শরিক হবেন। এদের বয়সের সীমানা হয়তো আঠারোর ঘরে পৌঁছায়নি এখনও। হয়তো কেউ কেউ কাছাকাছি পৌঁছাবেন কিংবা আঠারোর নিচে রয়েছে কারুর বয়স। কিন্তু এই বয়সটাই হচ্ছে দুরন্ত সাহস দেখানোর সময়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সময়। অতীতে দুনিয়ার যেখানেই এ ধরণের আগ্রাসী শক্তির হাতে মানবতা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে, সেখানেই দেখা গেছে সবার আগে তরুণ সমাজই কাণ্ডারির ভূমিকায় এগিয়ে এসেছেন। এই বিক্ষোভ এখন আমেরিকার ভৌগলিক সীমানা অতিক্রম করে ইউরোপ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে। ইতিমধ্যে লন্ডন এবং কভেন্ট্রিতে কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দিয়েছেন। সেট্রাল লন্ডনের গাওয়ার স্ট্রিটে অ্যাকশন ফর প্যালেস্টাইন গ্রুপ-এর ডাকে জড়ো হওয়া শিক্ষার্থীরা ফিলিস্তিনের পক্ষ নিয়ে বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে গগণবিধারী স্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তুলেছেন। অস্ট্রিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছাড়াও ইংল্যান্ডের ওয়ার উইক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও রয়েছেন এই আন্দোলনের সারিতে। বড় দুঃসময় পার করছে দুনিয়া। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ প্রায় বছরের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছাচ্ছে, যে যুদ্ধটা মানুষের মৌলিক মূল্যবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল, সেই অবস্থায় গত বছরের অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনে ইসরালের এর একতরফা আক্রমণে যে ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি পড়লো মানবসভ্যতা, সেই বিষয়ে বিশ্ববিবেক এতোকাল চুপ করে থাকার যে ধৃষ্টতা দেখিয়েছে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম শাসক গোষ্ঠীর রহস্যজনক নীরবতা, এবার ইউরোপ-আমেরিকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের নিশ্চয় একটা জোরালো প্লাটফরম তৈরিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। ইতিহাস এই বিষয়টাতে ভূরি ভূরি প্রমাণ রেখেছে। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের ডাক বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ সমাজের বৈপ্লবিক আন্দোলনের ফলে আইয়ুবের গদী শুধু টালমাটাল হয়নি, একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলনকেও গতিশীল করেছিল।
একইভাবে ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বরে তিউনিসিয়ার বাওজিদ এলাকার ফুটপাতে বসা এক সবজি বিক্রেতা যখন পুলিশের অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে আত্মাহুতি দিলেন, তার জ্বালিয়ে দেয়া সেই আগুনে যে ‘আরব বসন্তের’ সূত্রপাত হয়েছিল সারা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে, সেই কারণে তিউনেশিয়ার দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলা প্রেসিডেন্ট জয়নাল আবেদীন বেন আলীর শাসনামলের শুধু ইতিই ঘটেনি, মিশরের প্রেসিডেন্ট হোসনী মোবারক এবং লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফির জমানারও অবসান ঘটেছিল। এই তিন দেশের তিন স্বৈরশাসক জনগণের বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন সেই সময়ে।
শুরুতে তিউনেসিয়ার সাধারণ মানুষ যে পরিবর্তনের আশা নিয়ে আন্দোলনের সূচনা ঘটিয়েছিলেন, সেই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন বাহরাইন, লিবিয়া, সিরিয়া ও ইয়েমেনের মানুষ। সেই আন্দোলন দমনে মিশরের সরকারি বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছিলেন তখন প্রায় আটশজনের মতো। মধ্যপ্রাচ্যের ওই দেশগুলোর সাধারণ মানুষ আরব বসন্তের ফলে দেশে গণতন্ত্র, সুশাসন ও অর্থনৈতিক মুক্তির দিশা মিলবে এমন আশা করলেও পরবর্তীতে বলা হয়ে থাকে ওইসব আন্দোলনরত মানুষদের ব্যবহার করে পশ্চিমা বিশ্ব যে অন্যায় ফায়দা লুটার পরিকল্পনা করেছিল সেই সময়ে, তার কারণে তখন হাজার হাজার মানুষ দেশছাড়া হয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছিল। সেই অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থান। সঠিক পদক্ষেপ নেয়ার ব্যর্থতায় ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের জন্ম।
মূলত আরব বসন্তের ব্যর্থতায় মধ্যপ্রাচ্যে একেকটি দেশ এখন পশ্চিমা দেশের তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। যে কারণে ফিলিস্তিনের মানুষদের জীবন নিয়ে ইসরায়েলের মতো ইহুদি রাষ্ট্রের এমন তাণ্ডব চালাতে দ্বিধাহীন কাজ কারবার, যার নেপথ্যে মূখ্য মদদদাতার ভূমিকায় এখন নির্লজ্জ যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রশাসন।
ইউরোপ-আমেরিকার তরুণ সমাজের ওই বৈপ্লবিক প্রতিবাদের মূলে যদি এখন কিছুটা হলেও এদের বোধদয় ঘটে- এমন প্রত্যাশা নিয়ে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ তাকিয়ে আছে আগামী ভবিষ্যতের পানে।