মেয়েটি সুশিক্ষিত। ছেলেটি সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা। পারিবারিকভাবে প্রস্তাব অনুযায়ীই বিয়ে হবে। দিনক্ষণ ঠিক হলো ছেলে-মেয়ে উভয় উভয়কে দেখবে। মতামত জানাবে। যা হোক, একটা কিছু হবে। সে অনুযায়ী দুটি পরিবার সিদ্ধান্ত নেবে।
মায়ের কোমল মন। কিছুটা উদ্বিগ্ন। একটি সামাজিক ভাবনা মাকে ভাবিয়ে তুলছে। মা ছেলেটির অফিসে গিয়ে হাজির হন।
বাবা, তোমাকে একটি কথা বলব?
ছেলেটি নিশ্চুপ।
আমার মেয়েকে যদি তোমার পছন্দ না হয়, ওকে বুঝতে দিয়ো না।
ছেলেটি তবু নিশ্চুপ।
আর ওকে যদি তোমার ভালো না লাগে, মুখ ফুটে বলো না।
এবার বিনয়ের সঙ্গে ছেলেটি বলে যায় সব! যদি ভালো লেগে যায়। যদি পছন্দ হয়।
তবে বাবা। আজকে আমি যে এখানে এসেছি, ওকে কখনোই বলবে না। আর তোমার সঙ্গে আমার যা কথা হয়েছে, এগুলোও বলবে না।
এবারও বিনয়ের সঙ্গে ছেলেটি মাথা নাড়ে।
সেই মেয়েটির সঙ্গেই ছেলেটির বিয়ে হয়। দীর্ঘ পঁচিশ বছর সুখী যুগল দম্পতি। আজকে ছেলেটি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে সে শাশুড়িকে একদিন দেখতে পেয়েছিল।
আগামীকাল তার বড় কন্যাকে ছেলে ও তার পরিবার দেখতে আসবে। তার নিজের মেয়েটিও সুশিক্ষিত। তার পরও অজানা একটা ভাবনা প্রতিনিয়ত মাথায় চলে আসে।
নিঃশব্দ রাত। স্ত্রী তন্দ্রাচ্ছন্ন। আচমকা শিহাবের (ছেলেটির নাম) মাথায় হাত। শোনো, তোমাকে একটি কথা বলব।
বলো।
আমার মেয়েকে যদি ওদের পছন্দ না হয়, তবে মেয়েকে বিয়ে দেব না।
শিহাব জিজ্ঞেস করল-কী করবে? ইংল্যান্ড পাঠাব। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করব।
শিহাব নিজেকে শান্ত করছে। এবার নিজেই জিজ্ঞেস করে-আর জীবন? ওর জীবনের কী হবে?
স্ত্রীর ভারাক্রান্ত মন। জীবন জীবনের মতোই চলবে।
মায়ের মন। খুবই স্বচ্ছ।
শিহাবই এবার স্ত্রীকে প্রশ্ন করে-সমাজ, পথ এগুলোর কী হবে? মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে তো?
স্ত্রী ব্যথাতুর চিত্তে বলে, সমাজ কাউকেই কিছু দেয় না। আদায় করে নিতে হয়। আর পথ-ওর পথকে খুঁজে নিতে হবে না। পথই ওকে খুঁজে বের করবে।
আবেগীয় কণ্ঠ-আমি তোমাকে আরেকটি কথা বলব?
বলো, আমি শুনছি। চলার পথে যদি ওদের সঙ্গে কখনো দেখা হয়, তুমি কথা বলবে না।
শিহাব স্ত্রীর অভিমান বুঝতে পারে। একসময় মমতাময়ী স্ত্রী গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে।
ভরা পূর্ণিমার রাত। শিহাব বারান্দায় হাঁটছে। চাঁদ আর তারার রহস্য খুঁজছে। চোখ বুজে দুটি সমাজকে দেখছে।
সেই সমাজ-আর এই সমাজ। সেই সমাজে বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান করা হতো। কেউ চোখ তুলে কথা বলত না। প্রতিশ্রুতি ভাঙার প্রশ্নই ছিল না। আর এখন এগুলো সব উঠে গেছে।
তবু সে শাশুড়িকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে লালন করছে। প্রতিশ্রুতি একটি আমানত। রক্ষা করতেই হবে। কারণ একজন মানুষের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব আমানতের হেফাজত করা।
শিহাব কেন জানি আজ পৃথিবীর সব মায়ের ছবি দেখতে পায়।
শিহাবের ব্যতিক্রম ভাবনা চলে আসে-ঘুমিয়ে আছে শিশুর মাতা/ সব শিশুরই অন্তরে।
কারণ সেও যে আজ তিনটি কন্যাসন্তানের জনক!
লেখক : সাবেক সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল, বাংলাদেশ।