জন্মগতভাবে যেকোনো প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য মৌলিক চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাই অনুভব করে ও তা নিশ্চিতকরণসহ জীবনের মানোন্নয়নে যথাসাধ্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। মানুষ ব্যতীত অন্যান্য প্রাণীর ভাষা ও আচার-আচরণ যেহেতু সর্বজ্ঞাত নয়, তাই তাদের সম্পর্কে সূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণ শুধু অনুমাননির্ভর। পক্ষান্তরে মানুষ যেহেতু সর্বজনস্বীকৃত বুদ্ধিমান প্রাণী এবং নিজ ও সমাজের প্রয়োজনে তারা কল্যাণকর ভূমিকা গ্রহণে পারঙ্গম, তাই তাদের কল্যাণকর কর্মকাণ্ড সব সময় স্বীকৃত ও প্রশংসিত হয়, যদি না কালেভদ্রে কখনো সেসব কল্যাণকর কাজের মধ্যে এমন সব ত্রুটি চিহ্নিত হয়, যা কিনা ইচ্ছাকৃতভাবে সংঘটিত। শিক্ষা মৌলিক অধিকার ও জীবন মান উন্নয়নের অন্যতম অনুষঙ্গ। তাই শিক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে জীবনমানের উন্নয়ন সাধনের প্রশ্নে কারও কোনো দ্বিমত নেই বা থাকার কথা নয়। দেশ ও বিশ্বের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার যেমন বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি তা থেকে মানুষ উপকৃতও হচ্ছে। শিক্ষা গ্রহণের ফলে জীবনমানের যেমন উন্নতি আশা করা হয়, তেমনি শিক্ষা গ্রহণের ফলে নৈতিক অবস্থার উন্নতি না হলে সে শিক্ষাকে প্রকৃত শিক্ষার মর্যাদা প্রদান সমুচিত কি না তা ভেবে দেখার সময় হয়েছে বৈকি!
জীবনমানের উন্নয়নের জন্য যে শিক্ষা, তা যে কেবল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, তা নয়। এর বাইরেও শেখার অনেক কিছু রয়েছে, যা প্রাতিষ্ঠানিক না হলেও সেসব শিক্ষা সুন্দরভাবে জীবনের চাহিদা মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু অর্জনের সহায়ক। আধুনিক বিশ্বে জ্ঞান-বিজ্ঞানকে সহজে আয়ত্বের জন্য সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় যেমন প্রতিষ্ঠা হয়েছে, তেমনি বিভিন্ন ধর্মের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও রয়েছে, যা সাধারণত রক্ষণশীল ধর্মপ্রাণ মানুষের আর্থিক আনুকূল্যে পরিচালিত হয়। এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য যারা দান-অনুদান প্রদান করে থাকেন, তারা তা থেকে কোনো আর্থিক ফায়দা আশা করেন না বরং তারা আশা করেন, যাতে তাদের দানে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণকারীরা জীবনমুখী শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষায়ও দক্ষতা অর্জন করে তা নিজ ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কল্যাণে কাজে লাগাতে পারে। এদের মধ্যে এমন একটি শ্রেণি রয়েছে, যারা খুব সামান্য বা বিনা পারিশ্রমিকে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে সর্বস্তরের মানুষের নৈতিক অবস্থানকে উন্নততর করার লক্ষ্যে বক্তব্য-বিবৃতি প্রদানের পথ বেছে নেন, যদিও তাদের এ মহৎ উদ্দেশ্যকে নৈতিকভাবে যারা দুর্বল বা ধর্মীয় অনুশাসন যারা মানার প্রয়োজন বোধ করে না, তাদের পছন্দ নয়। তা সত্ত্বেও বাক্্স্বাধীনতা সবার জন্মগত অধিকার হিসেবে সমাজের ক্ষতির কারণ নয় যে কোনো মতাবলম্বীর এমন সব বক্তৃতা-বিবৃতি দেওয়ার বিষয়টি মেনে নেওয়া সব সমাজেরই বিদ্যমান রীতি। তা সত্ত্বেও পৃথিবীর দেশে দেশে চরম প্রকৃতির কিছু লোক নিজেদের রীতিনীতির বাইরে অন্য কোনো মতবাদ মেনে নিতে অপারগ, যদিও তারা নিজেদের সে দুর্বলতা ছাপিয়ে নিজেদের অতি আধুনিক হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া কিন্তু সাধারণ মানুষের নিকট তাদের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ।
ধরে নেওয়া হয়, উচ্চশিক্ষা গ্রহণের বিদ্যাপিঠ সব দিক থেকেই উন্নত। রাজনীতিকে সাধারণ মানুষ অত্যন্ত উন্নত নীতি-আদর্শের ধারক-বাহক হিসেবেই বিবেচনা করে থাকে। তাই রাজনীতিবিদেরা সাধারণ মানুষের নিকট অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে বিবেচ্য, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজ নিজ অবস্থানকে সে পর্যায়ে ধরে রাখতে সক্ষম হন। তবে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে, বহু রাজনৈতিক নেতাকর্মীর এমন সব কর্মকাণ্ড জনসমক্ষে প্রকাশিত হচ্ছে, যা তাদের জন্য এমনকি তাদের সমর্থক লোকজনের জন্যও অত্যন্ত লজ্জার। রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এমন সব নেতাকর্মী তাদের দল ক্ষমতায় থাকাকালীন বহু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন। এটা নিন্দুকেরা বললেও দেখেশুনে জনসাধারণও এখন তা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, যা রাজনীতির জন্য অত্যন্ত অশনিসংকেত। প্রবাদ আছে, মাছের পচন ধরে মাথা থেকে আর রাজনীতি যেহেতু সকল নীতির সেরা, তাই সেখানে পচন ধরলে গোটা সমাজই তা থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাজনীতিতে কারও ব্যক্তিগত চরিত্রের দোষ-গুণের জন্য সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলকে দোষারোপ করা সমীচীন নয়। তবে রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে দোষ করলে এবং তা দল বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিলে কর্মীর সে দোষে দলও দোষের ভাগীদার হতে বাধ্য। সাধারণ লোকজন তাই মনে করে, যদিও রাজনীতিবিদদের মুখরক্ষার একটি অ্যান্টিবায়োটিক ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই’-কথাটির গ্রহণযোগ্যতা বেশির ভাগ মানুষের নিকটই প্রশ্নবিদ্ধ। পাশ্চাত্যে ধর্মবিশ্বাসের কারণে পোশাক-পরিচ্ছদের প্রতি তেমন কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকলেও ইসলামপ্রধান দেশসমূহে রাষ্ট্রীয় আইনে পোশাকের বাধ্যবাধকতা না থাকলেও প্রথার কারণে ইসলামি বিধিবিধান-নির্দেশিত পোশাক পরতে প্রায় সবাই অভ্যস্ত। বলতে দ্বিধা নেই, ভিন্ন ধর্মের লোকেরাও সামাজিক রীতি অনুযায়ী শালীন পোশাকে অভ্যস্ত। ব্যতিক্রম শুধু যারা নিজেদের নাস্তিক পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, তারা ব্যতীত। তবে এখানেও প্রশ্ন থেকে যায়; জীবদ্দশায় যারা নাস্তিক হিসেবে পরিচয় দিয়ে সমাজে একশ্রেণির লোকের আনুকূল্য এবং সুযোগ-সুবিধা ভোগে সমর্থ হন, মৃত্যুর পরও পরকালীন সুযোগের ধান্দায় তারা নিজেদের ধর্মীয় রীতিতে সৎকারের বিরোধী নয়। এবং মৃত্যুর পূর্বে তারা ধর্মীয় রীতি বর্জনের অসিয়ত করা থেকেও বিরত থাকেন। এ থেকেই তাদের উভয় কূলের প্রাপ্তির আসল উদ্দেশ্য বোঝার বাকি থাকে না।
নারী স্বাধীনতা, বিশেষ করে নারীর পোশাক, দেহ, চলাফেরা ও সম্ভ্রম নারীর নিজের ইচ্ছামাফিক ব্যবহারের পক্ষে যারা প্রতিনিয়ত সোচ্চার, নারীর সম্ভ্রমহানি হলে তারা অজ্ঞাত কারণে নীরব; যা সাধারণ মানুষ ভালোভাবে নেয় না। অথচ বছরব্যাপী তারা এমন সব কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকে, মনে হয় তারাই প্রকৃত নারীপ্রেমী ও নারী স্বাধীনতার সোল এজেন্ট। বিগত সময়ে দেশে উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নারী শিক্ষার্থীদের তাদেরই সহপাঠী নারীনেত্রীদের মাধ্যমে যেসব বিশ্রী রকমের কর্মকাণ্ডের অভিযোগ প্রকাশ্যে এসেছে, তা থেকে সাধারণ মানুষের খারাপ ধারণা থেকে উত্তরণের এবং নারীর উচ্চশিক্ষা যাতে ব্যাহত না হয়, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবার উদ্যোগী হওয়া খুবই জরুরি। অন্যথায় সমাজব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে এর কুফল ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা সমাজব্যবস্থায় সুদূরপ্রসারী কুফল বয়ে আনবে।
সুতরাং সাধু সাবধান!
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও গবেষক
সেন্ট এলবান্স, নিউইয়র্ক।