গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে ষোড়শ শতাব্দী পৃথিবীর ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক শতাব্দী। এই শতাব্দীতে পশ্চিমা সভ্যতার উত্থান হয়েছিল। ইউরোপে রেনেসাঁর বিপ্লব ঘটেছিল। গ্যালিলিওর বৈজ্ঞানিক দর্শন অ্যারিস্টটলীয় ধারণার অবসান ঘটিয়ে সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল, এমনকি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মধ্যপ্রাচ্যে উসমানীয় শাসন ক্রমাগত বিস্তৃত হয়েছিল। ষোড়শ শতাব্দীর এই ধাক্কা এসে লেগেছিল ভারতবর্ষেও। এই সময়ের মুঘল শাসকেরা দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ অংশ নিজেদের সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। বিশেষ করে, সম্রাট আকবরের নেতৃত্বে ভারতবর্ষে নবজাগরণ ঘটেছিল।
টাইম স্কয়ারে বর্ষবরণের বিলাসিতা নয়, শহুরে জীবনের চাকচিক্যও নয়, কিংবা কোনো জাতি বা গোষ্ঠীর পূজা-পার্বণের জন্যও নয়, বরং গ্রাম-বাংলার আপামর কৃষকদের কথা ভেবেই ষোড়শ শতাব্দীর জনপ্রিয় মুঘল শাসক সম্রাট আকবর ১৫৮৪ সালে ‘ফসলি সন’ উদ্ভাবন করে বিশ্বে চমক লাগিয়ে দেন। এই ‘ফসলি সন’ই কালক্রমে উপমহাদেশের বাংলা ভাষাভাষীদের নিকট বাংলা সন হিসেবে খ্যাতি লাভ করে।
মুসলিম সম্রাট আকবর ও ফতেহ উল্লাহ শিরাজি মূলত হিজরি সনের আলোকেই নতুন বাংলা ক্যালেন্ডারটি উপহার দিয়ে গেছেন। পরিতাপের বিষয়, মুসলিম সম্রাট আকবর ও ফতেহ উল্লাহ শিরাজির উদ্ভাবিত বাংলা সন এখন বিচ্যুতি, বিকৃতি, ধর্মীয় গোঁড়ামি আর অপরাজনীতির করালগ্রাসে জর্জরিত। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, ১৯৮৯ সালে আমার বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের শেষ মিছিল পর্যন্তও মিছিলের শিরোনাম ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’।
ওই একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘চারুকলা ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পরের বছর চারুকলা ইনস্টিটিউটের কিছু অতি উৎসাহী ছাত্রছাত্রী সুকৌশলে পহেলা বৈশাখের মিছিলে মঙ্গল শোভাযাত্রা যুক্ত করে দেয়! সম্পূর্ণ মুসলিম আমলের ছত্রচ্ছায়ায় প্রতিষ্ঠিত পহেলা বৈশাখের সঙ্গে মঙ্গল শোভাযাত্রার কী সম্পর্ক, তা আমার বোধে আসে না! কেউ কেউ আবার এটাকে হাজার বছরের ঐতিহ্য বলেও চালিয়ে দিচ্ছেন। কী সেলুকাস! তবে হ্যাঁ, বিশেষ কোনো জাতি বা গোষ্ঠীর কাছে মঙ্গল শোভাযাত্রার ঐতিহ্য হাজার বছরের হতে পারে, তাতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীর বরপুত্র সম্রাট আকবরের উদ্ভাবিত বাংলা সনের কথা আমরা ভুলে যাই কীভাবে? আরে, ঐতিহ্য যদি থাকবেই, সেটা থাকবে হিজরি সন বা রমজান মাসকে নিয়ে। কেননা বাংলা সন বা পহেলা বৈশাখ উদ্ভাবিত হয়েছে হিজরি সনের আলোকে এবং মুসলিম সম্রাট আকবরের আমলে।
আমি উচ্চকণ্ঠে স্বীকার করি হিন্দুধর্ম নিঃসন্দেহে অতি পুরাতন ধর্ম। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ধর্ম এটি, যার অনুসারীর সংখ্যা ১২০ কোটিরও বেশি, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৫-১৬%। এর প্রকৃত নাম বৈদিক বা সনাতন ধর্ম। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পূর্বে ‘শকাব্দ’ ব্যবহার করত, সম্রাট আকবর সেখানে ‘বঙ্গাব্দ’ চালু করেছেন। এটি কি মিথ্যা? এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। বৈদিক বা সনাতনী আমলে ‘পুণ্যাহ’ বলে একটি দিন ছিল। ব্রিটিশরাও সেটি বজায় রেখেছিল। ‘পুণ্যাহ’ মানে বাংলা বছরের প্রথম দিন। এই দিনে সকল কৃষক জমিদারদের খাজনা দিত। ব্রিটিশদের সময় কৃষকেরা এই খাজনা দিতে হিমশিম খেত। সে জন্য কৃষকদের কাছে পহেলা বৈশাখ দিনটি খুবই নিরানন্দের ছিল। ১৯৫০ সালে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ বিলুপ্ত হওয়ার পর ‘পুণ্যাহ’ প্রথাও বন্ধ হয়ে যায়। সিন্ধু থেকেই হিন্দু। ইতিহাস তা-ই বলে। যারা বলছেন পহেলা বৈশাখ হিন্দুদের, তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, হিন্দু শব্দের প্রকৃত অর্থ কী? হিন্দু আসলে কারা? মুসলমান বা মুঘল শাসকেরা ভারতকে বলতেন হিন্দুস্থান। হিন্দুস্থানে যারা বাস করতেন, তারা সবাই হিন্দু। সেই হিসেবে সম্রাট আকবর এবং তার মুসলিম প্রজারাও হিন্দু ছিল। আমার মুসলমান বন্ধুরা আমার ওপর খেপে যাবেন না যেন। মহাকবি ইকবালও তার বিখ্যাত কবিতার লাইনে বলেছেন, ‘সারে জহাঁ সে আচ্ছা হিন্দুস্থান হামারা।’ তাহলে কী দাঁড়াল? হিন্দুস্থান মানে যেখানে হিন্দুরা বাস করে। সে হিন্দু মানে কোনো বিশেষ ধর্মের মানুষ নয়, সকল মানুষ। ভারতের সকল অধিবাসীই হিন্দু, সে যে ধর্মেরই হোক। সেই অর্থে মুঘলরাও হিন্দু। প্রকৃতপক্ষে, হিন্দু হলো তারা, যারা সিন্ধু নদীর ওপারে বাস করত। সিন্ধু থেকেই হিন্দু। হিন্দু হলো সিন্ধু নদীর বিকৃত নাম। প্রাচীন গ্রিকরা সিন্ধু উচ্চারণ করতে পারত না, বলত হিন্দু। এই গ্রিকরা তাদের সুবিধার্থে সিন্ধু নদীর ওপারে মানে ভারতে যারা বাস করত, তাদেও সবাইকে বলত হিন্দু। সে বৈদিক হোক, মুসলমান, বৌদ্ধ, চার্বাক যে-ই হোক। আর ভারতীয়রা গ্রিকদের বলত যবন বা ম্লেচ্ছ, যার অর্থ বহিরাগত বা অহিন্দু। সে কারণে মুসলমান শাসকেরাও নিজেদের হিন্দু বলতে সামান্য আপত্তি করেননি। কেননা তারা ভারতে যবন ছিলেন না। তারা সগর্বে নিজেদের হিন্দুস্থানের শাসক বলেছেন।
আমি আগেই উল্লেখ করেছি, এখন যারা নিজেদের হিন্দু বলে গর্ববোধ করেন, সেটা ছিল আসলে বৈদিক ধর্ম। যারা সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে পুরাতন ধর্মগ্রন্থ বেদে বিশ্বাস করে, তারাই বৈদিক ধর্মের লোক, এর আরেক নাম সনাতন ধর্ম। ভারতবর্ষে বৌদ্ধ রাজাদের পতনের পর বৈদিকরা হিন্দু হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে শুরু করে, যা পরিপূর্ণতা পায় ব্রিটিশ আমলে। হিন্দুস্থানের বৈদিক ধর্মের নেতারা হিন্দু শব্দটা লুফে নিল, যা ছিল ভারতবর্ষের সবার! প্রকারান্তরে তারা নিজেদের বৈদিক বা সনাতন ধর্মের নাম মুছে ফেলে হিন্দুধর্মের সিল মেরে দিল! আর মুসলমানরা বাধা না দিয়ে সেটা দখল করে নেওয়ার সুযোগ করে দিল। নিশ্চয় এটা মুসলমানদের উদারতা বা উদাসীনতা!
এই উদাসীনতার সুযোগে মুসলমান সম্রাট আকবরের প্রচলিত বাংলা সনটাও এখন যায় যায়। মুসলমানদের সব দখল করে তারা কি প্রমাণ করতে চাচ্ছে যে মুসলমানরা নিঃস্ব, তাদের কোনো সংস্কৃতি নেই? সময় এসেছে, মুসলমানদের বুঝতে হবে, তারা এই বিরাট ভারতবর্ষের অবিচ্ছেদ্য অংশই শুধু ছিল না, তারা ভারতবর্ষ বীরদর্পে শাসনও করেছে দীর্ঘকাল। তাই তো ভারতে বিভিন্ন ধর্মের সংস্কৃতি মিলেমিশে আছে আজও। মুসলমানদের অনেক সংস্কৃতি রয়ে গেছে ভারতে। পাজামা-পাঞ্জাবি, টুপি, সালোয়ার-কামিজ এগুলো মুঘলদের দ্বারা এখানে চালু হয়েছিল। এমনকি ভারতের শাহি পোলাও, রেজালা, বিরিয়ানি এগুলো সবই মুঘলদের আমলের। কই, সেগুলো তো ভারতের হিন্দুরা মুসলমানদের বলে ছুড়ে ফেলে দেয়নি? ভারতের আনাচ-কানাচে মুঘলদের অসংখ্য সংস্কৃতি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, এ তথ্য কি মিথ্যা?
আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, ধর্ম আর সংস্কৃতি এক জিনিস নয়। ধর্ম যার যার ব্যক্তিগত বিশ্বাস। ধর্ম ছাড়াও জীবন চলে। পৃথিবীতে বহুলোক আছে, যাদের কোনো ধর্ম নেই। কিন্তু সংস্কৃতি জাতিসত্ত্বার পরিচায়ক। এটি ছাড়া আপনি আইডেন্টিটিহীন। আর আইডেন্টিটিহীন মানুষ আর মানুষই নন।
পরিতাপের বিষয়, মুসলমানরা আজ সেই আইডেন্টিটিই হারাতে বসেছে! কোনটি নিজের আর কোনটি অন্যের, সেই বোধটুকুও যেন মুসলমানদের আজ নেই! সম্রাট আকবরের সৃষ্ট বাংলা বছরটাও আমরা ফেলে দিতে চাইছি! অনেকেই বাংলা সন বা বাংলা মাসের দিন-তারিখ জানে না, মানে না! কী অবাক কাণ্ড! এ কথা অনস্বীকার্য, গ্রহণ করার ক্ষমতা হিন্দুদের অনেক বেশি। তাই তো তারা আজ সারা বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সৌদি আরবে জায়নামাজ আর তসবিহ চীন ও ভারত থেকে আমদানি করা হয়। কিন্তু সৌদির মুসলমানরা তো বিধর্মীদের কাছ থেকে তা কিনতে আপত্তি করে না। আশির দশক থেকে এ পর্যন্ত অনেকবার মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশ আমি ভ্রমণ করেছি। সেখানে হলগুলোতে দেখেছি ভারতীয় ছায়াছবির একচ্ছত্র আধিপত্য। আমাদের দেশের ঘরে ঘরে ডিশ ও অ্যান্টেনার সুবাদে ভারতীয় টিভি সিরিয়ালে ভরপুর। কিন্তু আমাদের দেশের কোনো প্রোগ্রাম তো ভারতে চলে না! এ অসমতা কেন?
প্রবাসে বাঙালির অবস্থা আরও নাজুক, বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম। বহুজাতিক এই দেশের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে অনেকের সন্তানেরা। অনেক বাবা-মা সন্তানদের সময়ই দেন না, শুধু ডলারের পেছনে দৌড়ান। ফলে যা হবার তা-ই হচ্ছেÑসন্তানেরা শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। অনেক বাবা-মা সামান্য সময় পেলেও সন্তানদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলেন না। সন্তানেরা ইংরেজিতে কথা বললে বরং অনেক বাবা-মা গৌরব বোধ করেন! এই দৌড়ে তথাকথিত শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবীদের সন্তানেরাই এগিয়ে, তারাই উচ্ছন্নে যাচ্ছে বেশি। তাই বলি :
‘ভেসে যাক মোহ, কেটে যাক ক্লান্তি
নববর্ষের আলোয় মুছে যাক ভ্রান্তি।’
লেখক : কমিউনিটি বোর্ড মেম্বার ও সমাজসেবক।