সফরের তৃতীয় দিনে সিরিজ বৈঠকে কাটিয়েছে বাংলাদেশের নির্বাচনী পরিবেশ এবং নির্বাচন-পূর্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতি সরজমিন দেখতে ঢাকায় আসা ইউরোপীয় ইউনিয়ন পর্যবেক্ষক দল। সোমবার সকালে সেগুনবাগিচায় এবং মধ্যাহ্নে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয়ে ব্যাক টু ব্যাক ওই বৈঠক হয়। ফাঁকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং বিকালে পুলিশের সঙ্গে বৈঠক হয় তাদের।
সর্বত্রই আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন, মানবাধিকার তথা গণতন্ত্রকে সুসংহত করার উপায় নিয়ে আলোচনা করেছেন তারা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সকাল ১০টায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বৈঠকে বসে ইইউ’র প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক টিম। সেখানে অনুষ্ঠিত বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আসাদ আলম সিয়াম নেতৃত্ব দেন। ওই বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সেগুনবাগিচা থেকে বেরিয়ে ইইউ টিম মানবাধিকার কমিশনের কাওরানবাজার কার্যালয়ে যায়। সেখানে চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন মানবাধিকার কমিশন প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক হয়। বৈঠকে কমিশনের যুগ্ম সচিব নারায়ণ চন্দ্র সরকার, কমিশন পরিচালক, (অভিযোগ ও তদন্ত) জেলা ও দায়রা জজ মো. আশরাফুল আলম, উপ-পরিচালক মোহাম্মদ গাজী সালাহউদ্দিন, উপ-পরিচালক এসএম রবিউল ইসলাম, উপ-পরিচালক সুস্মিতা পাইক উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৬ সদস্যের ইলেকশন এক্সপ্লোরেটরি মিশনের সদস্যসহ প্রতিনিধিদলে ছিলেন- ইইউ’র ব্রাসেলস মেট্রোপলিটন এরিয়ার কাউন্সিলের ডেস্ক অফিসার চেলেরি রিকার্ডো, ইইউ’র অবজারভেশন মিশনের (ইইউ ইওএম) ডেপুটি চিফ অবভারভার আইওনাউ দিমিত্রা, গ্রুপ সদস্য আলভেস ক্রিটিনা ডস রামোস মিলার ইয়ান জেমস, প্রতিনিধি সদস্য, চ্যামেন ক্রিস্টোফার, প্রতিনিধি সদস্য এবং ম্যারি হেলেন এন্ডারলিন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কার্যালয়ের প্রথম সচিব (রাজনৈতিক) সেবাস্তিয়ান রিগার-ব্রাউন।
সহিংসতার আশঙ্কা নাকচ করলো মানবাধিকার কমিশন: এদিকে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার কোনো আশঙ্কা আছে কি না, তা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে জানতে চেয়েছে সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল। সোমবার দুপুরের দিকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে পর্যবেক্ষক দলটি।
বৈঠক শেষে এ নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ। মিস্টার আহমেদ বলেন, জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার আশঙ্কা আছে কি না, তা কমিশনের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল।
কমিশনের পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষক দলকে বলা হয়েছে, পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিয়ে ইইউ’র প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের সঙ্গে তাদের আলোচনা হয়নি। এ নিয়ে কমিশনকে কোনো প্রশ্নও করা হয়নি। তবে বৈঠকে সব ধরনের মানবাধিকার নিয়ে কথা হয়েছে। কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, তার ব্যক্তিগত ধারণা, আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইইউ পর্যবেক্ষক দল পাঠাতে পারে।
বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ ও নির্বাচন-পূর্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় ইইউ’র নির্বাচন সংক্রান্ত তথ্যানুসন্ধানী দলটি শনিবার ১৬ দিনের সফরে ঢাকায় আসে। প্রতিনিধিদলটির মূল কাজ হবে- নির্বাচন পর্যবেক্ষণ মিশনের কর্মপরিধি, পরিকল্পনা, বাজেট, নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয় মূল্যায়ন করা। পর্যবেক্ষক দলটি রোববার তাদের কার্যক্রম শুরু করে। এদিন ছয় সদস্যের প্রতিনিধিদলটি ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি দেশের কূটনীতিক ও জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর সঙ্গে আলাদা একাধিক বৈঠক করে।
ইইউ’র প্রতিনিধিদলটি বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক করবে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় রয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, রাজনৈতিক নেতা, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও ইইউ প্রতিনিধিদলের কয়েক দফা বৈঠকের কথা রয়েছে। ঢাকা সফরের পর প্রতিনিধিদলটি যে প্রতিবেদন দেবে, তার ওপর ভিত্তি করে আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইইউ পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর বিষয়ে ইউরোপীয় কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট জোসেফ বোরেল আগামী সেপ্টেম্বরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে ঢাকায় সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দল। বৈঠকে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের সময় পুলিশ কেমন নিরাপত্তা দেবে সে বিষয়ে জানতে চেয়েছে ইইউ প্রতিনিধি দল। পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) মো. কামরুল আহসানের সঙ্গে প্রতিনিধি দলের বৈঠকটি হয়। পুলিশের আইজি এতে উপস্থিত ছিলেন না।
গতকাল বেলা পৌনে ৩টার দিকে পুলিশ সদর দপ্তরে ইইউ’র ৬ সদস্যের প্রতিনিধি দল বৈঠক করতে যান। বৈঠকটি ৪৫ মিনিট ধরে চলে। বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত আইজিপি কামরুল আহসান মানবজমিনকে জানান, ‘আসন্ন নির্বাচনে পুলিশ কী নিরাপত্তা দেবে তা প্রতিনিধি দল জানতে চেয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, বৈঠকে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আইন ও বিধি অনুযায়ী নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করবে তারা।
নির্বাচনের আগে ৬ সপ্তাহ পার্বত্য অঞ্চল পর্যবেক্ষণে রাখতে চায় ইইউ: ওদিকে নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল ৬ সপ্তাহের জন্য পর্যবেক্ষণে রাখতে চায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। সোমবার সচিবালয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে এ কথা জানায় ঢাকা সফররত ইইউ’র ৬ সদস্যের প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল। বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও নির্বাচন কমিশন দেখবে জানিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ইইউ প্রতিনিধি দলকে জানিয়েছেন, এ বিষয়ে তারা সব রকমের প্রশাসনিক সহায়তা দেবে। জ্যেষ্ঠ নির্বাচন পর্যবেক্ষক রিকার্ডো চেলেরির নেতৃত্বে ইইউ’র এ প্রতিনিধি দল দুই ভাগে ঢাকায় আসার পর রোববার থেকে আনুষ্ঠানিক সফর শুরু করে।
নির্বাচন কমিশন ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি সরকারের নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে এ প্রতিনিধি দলের বৈঠক করার কথা রয়েছে। সোমবার ইইউ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকের পর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আমিনুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, তারা আমাদের আমন্ত্রণে এসেছে, আমাদের কাছে সহায়তা চাচ্ছে। আমরা বলেছি সবরকম সহায়তা দেবো।
তারা নির্বাচনের আগে ৬ সপ্তাহ পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা অবজারভেশনে রাখতে চায়। তারা নির্বাচনকালীন সময়ে আসবে। আমরা বলেছি, সেটি নির্বাচন কমিশন দেখবে। এই তিন পার্বত্য জেলায় ‘নিরাপত্তার বিষয়’ আছে জানিয়ে প্রতিনিধি দলকে জানানো হয়েছে, এখন আগের চেয়ে (পরিবেশ) অনেক অনেক ভালো। আমরা তাদের ওখানকার প্রশাসনিক বিষয়ে ব্রিফ করেছি। অতিরিক্ত সচিব আমিনুল বলেন, তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় যাওয়ার বিষয়ে বলেছেন। এই বিষয়টি দেখে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আমরাও দেখি। এই তিন জেলা ভিজিট করার বিষয়ে আমাদের দিক থেকে সকল রকম সাপোর্ট দেবো।
প্রতিনিধি দলকে জানানো হয়, নির্বাচনের সঙ্গে এ মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ততা নেই। প্রশাসনিক ও উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনাকারী মন্ত্রণালয় হিসেবে তাদেরকে সেখানে থাকা, পরিদর্শন ও চলাচলের ক্ষেত্রে সব ধরনের সহায়তা দেয়া হবে বলে তিনি জানান। মন্ত্রণালয়ের এই কর্মকর্তা বলেন, ইইউ প্রতিনিধি দল পার্বত্য অঞ্চলে গিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলার বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। আমরা বলেছি, এটা যেহেতু নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত এটি নির্বাচন কমিশন বলবে। এটার সঙ্গে আমরা সম্পৃক্ত না। তারা ২০০৮ সালে (বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল) ভিজিট করেছেন।
এবারো (ভিজিট করার) করার ইচ্ছে পোষণ করেছেন, তবে কবে করবেন সেটি জানাননি। সচিব বলেন, আমরা তাদের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানিয়েছি, সেখানে স্থানীয় প্রশাসন আছে, জেলা পরিষদগুলো আছে, স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে, সেনাবাহিনীও আছে। সুতরাং তারা যাতে নিরাপত্তার ইস্যুটি মাথায় রাখেন, সেটি তাদের বলেছি। উল্লেখ্য, নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণে আসা ইইউ’র ৬ সদস্যের একটি প্রাক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল আগামী ২৩শে জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করবে।
সফরকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তাদের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। তাছাড়া দুই সপ্তাহের ওই সফরে ইইউ টিম নির্বাচন সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গেই বসবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিবৃন্দ, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীগুলো, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজ এবং গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও তাদের সিরিজ বৈঠক হবে। ঢাকা সফরের পর ইইউ টিম যে রিপোর্ট দেবে তার ওপর ভিত্তি করেই আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইইউ পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত আসবে।
স্মরণ করা যায়, মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার ও সব অংশীজনের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং সদস্য দেশগুলো নিবিড়ভাবে কাজ করছে। ইইউ বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল ও নাগরিকদের রাজনৈতিক অধিকার চর্চা এবং সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে উৎসাহিত করছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ দিয়েছেন। ওই নির্বাচনে সব অংশীজনের ভূমিকা চেয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা সৃষ্টির জন্য সব অংশীজনকে ভূমিকা রাখতে হবে। আর সে জন্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অর্থবহ সংলাপ এবং নাগরিক সমাজের কাজের ক্ষেত্র নিশ্চিত করতে হবে।
এসআর