Thikana News
২১ নভেম্বর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

ছেলেবেলার সেই বংশীবাদক

ছেলেবেলার সেই বংশীবাদক
সময়টা সম্ভবত সত্তুর দশকের গোঁড়ার দিকের। আমার ছোটমামা আমাকে একটা খেলনা দিয়েছিলেন, যেটি দেখতে হুবহু আগেকার দিনের বক্স টেলিভিশনের মতো। ৩/৪ ইঞ্চি হবে ওটির সাইজ। ওই খেলনা টিভিটার পর্দায় কিছু ভেসে আসতো না। একচোখ কানা করে অন্য আরেক চোখে পেছন দিক দিয়ে একটা ফুটোতে তাকালে রঙিন ছবি দেখা যেতো। অনেকটা বায়োস্কোপ দেখার মতো। একটি নির্দিষ্ট সুইচ ছিলো, যেটি উপর থেকে নিচে টানলে দৃশ্য বা ছবি পাল্টে যেতো। ওটির ভেতর খুব বেশি হলে কুড়িটা ছবি ছিলো মোটে। বেশিরভাগই ছিলো জীবজন্তুর ছবি। সেটি দেখার কি যে মোহ! কম করে হলেও ১০০ বার দেখতাম দিনে। এখনকার ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামে নিজের অজান্তেই ডুবে যাওয়ার মতো। ওটি ধরে দেখার জন্য আমার পিছনে লাইন পড়ে যেতো। তখন আমিও তা নিয়ে হাত উঁচিয়ে হেঁটে চলতাম, যেনো হ্যামিলনের সেই বংশীওয়ালা! কাউকে ওটি ধরতে বা দেখতে দিলে তার পৃথিবী যেনো আনন্দে ভরে যেতো। বন্ধুদের তোয়াজ আর তদবিরে আমার তো একেবারে ভেসে যাওয়ার দশা! আমি যেনো অধূনা বাংলাদেশের কোন আমলা বা মন্ত্রী! 
যাই হোক, ওই অত্যাধুনিক সেই খেলনা টিভি ছোটমামা সূদুর রাশিয়া থেকে এনেছিলেন তার দূরন্ত ভাগ্নের জন্য। তারপরে ওই রকম নানাবিধ খেলনা নানাজনের হাতে দেখেছি, যাদের আত্মীয় বা স্বজন বিদেশে থাকতো। বলা বাহুল্য, খেলনা টিভিটি যখন আমার হাতে আসে, তখনও আমাদের ঘরে টিভি আসেনি। ইলেকট্রিসিটি সবে এসেছে। আমাদের অন্য পাড়ায় তার কয়েক বছর পর একটি সত্যিকারের টিভি এসেছে। টাকা-পয়সা ভালোই ছিলো তাদের। ও বাড়ির কর্তা ছোটখাটো সরকারি চাকরি করলেও উপরি কামাতেন বেশ, তা আশেপাশের সবাই বলাবলি করতেন। তখন থেকেই ঘুষখোরদের সামাজিক অবস্থান তৈরি হতে থাকে এবং টাকা যে কথা বলতে পারে, সেসব অশ্লীলতা শুরু হয়। আর এখন তো চলছে চোরদের জয়জয়কার। সত্যবাদীরা নিগৃহীত হতে হতে কবে জানি চিড়িয়াখানা বা জাদুঘরে ঠাঁই নেন! 
‘সত্য বল সুপথে চল’Ñ এসব বাণী এখন সেকেলে, জং ধরা। সেই যে আমার সেই রাশান খেলনা টিভি, সেটি কবে কোথায় বিলীন হয়েছে মনে নেই, কিন্তু পরবর্তীতে আমাদের প্রথম কেনা আসল টিভিটার কথা ভোলার নয়। সেটি কেনার জন্য কত কি যে হয়েছে! যতবার বাজেট আলোচনা হয়েছে, তার চেয়েও বেশিবার হয়েছে বাজেট সংকোচন, পরিবর্তন কিংবা পরিমার্জনের পর্যালোচনা। ওটি কেনো কিনতে হবে? কেনো কেনা উচিৎ নাÑ এসব লাভ-ক্ষতির তর্কাতর্কি চলে দীর্ঘকাল। কিন্তু ওই কালক্ষেপণের যন্ত্রনা কিশোর আমাকে ক্ষতবিক্ষত করছিলো। কারণ, তখন আমাদের আশেপাশে আরো কয়েকটি বাড়িতে টিভি কেনা হয়ে গেছে। কেউ আগেরটা পাল্টে রঙিন টিভিও কিনে ফেলেছেন। অন্যদিকে ক্ষুদ্র একটি সাদাকালো টিভি কিনতে এ কেমন টালবাহানা! আমার অস্থিরতা আর ঘোঁচে না। অপেক্ষার প্রহর পাহাড় ছাড়িয়ে যায়। বাবার সরকারি চাকরির ছোট বেতনে বা সৎ ইনকামে এত বড় শখ কি সহজে মেটে? কিন্তু সৌভাগ্য যে, আমার বড় ভাই আংশিক কন্ট্রিবিউট করেছিলো সেই টিভি ক্রয়ের যুদ্ধে। সে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, কিন্তু পাশাপাশি পার্টটাইম কাজ শুরু করেছে। এভাবেই আমাদের ঘরে একদিন বারো বা চৌদ্দ ইঞ্চি গ্রে কালারের একটি সাদাকালো টিভির আগমন ঘটে। যেনো মস্ত এক জাহাজ দূর সমুদ্র থেকে আকাশ ছাপিয়ে কূলে ভিড়েছে! এ যেনো অমাবস্যায় ঝলসিত এক পূর্ণিমার চাঁদ! এই যক্ষের ধনের সুবাদে আমাদের সব রুটিন পাল্টে গেলেও চব্বিশ ঘন্টা ওটা দেখার স্বপ্ন-সাধও উড়ে গেলো নিমিষেই! তার ওপর বলা হলোÑ আইন লঙ্ঘন করলে ওই জাদুর বাক্স তালা মেরে আটকে রাখা হবে। পড়াশোনার কোনো ক্ষতি করা যাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। 
এত বিধি-নিষেধ থাকলে আনন্দে কী পরিমাণ ভাঁটা পড়ে, ভাবুন? আজকের দিনে কত স্বাধীনতা। সেই খেলনা টিভি এখন কে আর হাতে নেয়। ওসব খেলনার চাহিদাও নেই এবং কারখানাও উঠে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। সময়টা কত দ্রুত পাল্টালো! মানুষের চাহিদা আর সামর্থের কতো পরিবর্তন। ছোট্ট এক সাদা কালো টিভি কিনতে কত জল্পনা-কল্পনা হতো তখন, কিন্তু এখন দেয়াল সমান টিভি কিনতেও কোনো আহামরি ভাব নেই। শিশুদের হাতে হাতেও মোবাইল। যাতে আছে হাজারটি টিভি, হাজারটি চ্যানেল। কি আনন্দ আর কি সুখ! 
এই মহানন্দের মহাসুখেই কি এত অসুখ বাড়ছে আজকাল? আজ সবকিছু কত সহজলভ্য। পাওয়ার মোহে দিশেহারা সবাই। কোন কিছুরই যেন ভারসাম্য নেই। অস্থির দৌঁড়ঝাঁপ সবখানে। বিধি-নিষেধের বালাই নেই। কার কোথায় গন্তব্য কারো কোন ভ্রক্ষেপ নেই, জানা নেই। সমাজ-সংসার ভেস্তে যাক, দেশটা গোল্লায় যাক, পৃথিবীর ধ্বংস হোক, কার কি তাতে। আমি আনন্দে আছি, পাচ্ছি- খাচ্ছি-দাচ্ছি, তাতেই প্রাপ্তি। অন্যরা চুলায় যাক। মানুষে মানুষে সম্প্রীতি, আদান-প্রদান, সাহায্য-সহযোগিতা উবে যাচ্ছে দিন দিন। 
মানুষও নিজ-কেন্দ্রিক হচ্ছে তো হচ্ছেই অহর্নিশ। আমার সেই খেলনা টিভির পেছনে এখন আর কেউ ঘুরবে না। পাড়াশুদ্ধ মানুষ মিলেমিশে একটি চ্যানেলের একটি টিভি এখন আর দেখে না। এখন টিভি কেনার জন্য পারিবারিক মিটিংও হয় না। সবার হাতে হাতেই টিভি এখন। পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়। কিন্তু আশ্চর্যেও বিষয় হলো, এক পৃথিবীতে বাস করেও যে যার মত করে আলাদা পৃথিবীতে বাস করার মানসিকতা এখন তুঙ্গে। মানুষ মানুষকে দেখে না, তাকায় না, যতক্ষণ সে তাকিয়ে থাকে তার দুই ইঞ্চি সেলফোন স্ক্রিনে। কেউ কারো আর্তি আর শোনে না। সবাই কালা। কান বন্ধ হেডফোন কিংবা এয়ার পডে। বলা হয়, সারা পৃথিবী এখন একটি গ্রাম, গ্লোবাল ভিলেজ। কোন সীমান্ত নেই। কিন্তু মানুষতো আত্মকেন্দ্রিক হতে হতে খোলসের মতো নিজের চারপাশে শক্ত আবরণ তৈরি করছে। তৈরি করছে শক্ত সীমান্ত। যেখানে অন্য কারো প্রবেশাধিকার নেই। যদি কোন এক দৈবাৎ মহাপ্লাবনে এসব বলয় ভেঙে যেতো, ওলট-পালট হয়ে যেতো তামাম দুনিয়া! পৃথিবীও যদি ফিরে যেতো তার শৈশবে কিংবা আমরাও ফিরে যেতাম। এ সময়ের অস্থিরতা উবে যেতো যদি, মন্দ হতো না। তবে আমরাও হয়তো ভাগ করে নিতাম প্রেম, আবেগ কিংবা অনুভূতি। মানবিকতায় হয়তো ভরে যেতো সব মানুষের মন, প্রাণ, মনন। বিজ্ঞান তার আগ্রাসী ক্ষমতা হারিয়ে হয়তো কল্যাণ সৃষ্টিতে ব্যস্ত আর ন্যস্ত হতো। তাহলে বিভেদ, বিভাজন, ধর্ম অনল সব নিভে যেতো হয়তো। তখন আমিও হয়তো হয়ে যেতে পারতাম ফেলে আসা শৈশবের সেই বংশীওয়ালা আর বাঁশিতে শান্তির সুর তুলে বাজিয়ে বেড়াতাম পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে।
লেখক : উপস্থাপক ও অভিনেতা।

কমেন্ট বক্স