পিয়াস ফোজান : ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন পদত্যাগ করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিশংসন করা হয়। ব্রাজিলের প্রধানমন্ত্রী বোলসোনারোকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেওয়া হয়নি। ইতালির সাবেক প্রেসিডেন্ট বেরলুসকোনি মারা গেছেন। হাঙ্গেরির প্রেসিডেন্ট কাতালিন নোভাককে সমর্থন দিয়েছিলেন স্বৈরশাসক ভিক্টর অরবান। শেষ পর্যন্ত তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়। ফ্রান্সের সংগীতশিল্পী বারবারা প্রভি উচ্চস্বরে গাইছেন- জনতুষ্টিবাদ মৃত। কিন্তু সত্যি কি তাই?
বরিস জনসন গেলেও আরও বেশি রক্ষণশীল ও কট্টরপন্থি ঋষি সুনাক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। ঋষি সুনাক সাম্প্রতিক ব্রিটিশ ইতিহাসের সবচেয়ে কঠোর অভিবাসনবিরোধী আইন গ্রহণ করেছেন।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আইনি বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। তবুও প্রতিটি আইনি বাধা মোকাবিলা করে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন। তিনি তাঁর আদালতে হাজিরাকে নির্বাচনী প্রচারযন্ত্রে রূপান্তরিত করেছেন। প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে তিনি রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন পেয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের আগামী নির্বাচনে তিনি এবং জো বাইডেন ফের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। ২০২০ সালের নির্বাচনে হেরে গেলেও তাঁর চার বছর দায়িত্ব পালনের সময়ে তিনি 'মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন' স্লোগান
মানুষ অংশগ্রহণ করে।
ইতালির বেরলুসকোনি রাজনীতিকে কুটিল ব্যবসায় পরিণত করেছেন। তিনি ইতালিতে টেলিভিশন সংবাদমাধ্যমকে ইচ্ছামতো ব্যবহার করেছেন। কিন্তু সেখানে নতুন বেরলুসকোনি আরেক কাঠি সরেস। রোমে বর্তমানে ক্ষমতাসীন এ বেরলুসকোনির নাম জর্জিয়া মেলোনি। ২০০৮-১১ সালে বেরলুসকোনি সরকারের সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী ছিলেন। তাঁর দল ফ্যাসিস্ট বাস্তবায়নে কাজ করেছেন। সুপ্রিম কোর্টে তাঁর নিয়োগকৃত বিচারকরা প্রগতিশীল নীতি আটকে দিয়েছিলেন এবং গর্ভপাতের অধিকারসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে উল্টো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরিবেশ সুরক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিক তদারকি হ্রাস এবং শিক্ষার্থীদের ঋণ মওকুফে বাইডেনের প্রকল্প থামিয়ে দিয়েছে। ব্রাজিলে বোলসোনারো পুলিশি জেরার সম্মুখীন; তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। এতদসত্ত্বেও তাঁর সমর্থকরা যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিল আক্রমণের ঘটনা অনুসরণ করছে। তিনি সম্প্রতি সাও পাওলোতে বিশাল সমাবেশ করেছেন, যেখানে লাখ লাখ বেনিটো মুসোলিনির প্রতিনিধিত্ব করছে। তিনি মনে করেন, 'মুসোলিনি ভালো রাজনীতিক ছিলেন।' ২০১৮ সালে তিনি যেখানে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট পেয়েছেন, সেখান থেকে মাত্র চার বছর পর, ২০২২ সালে তা ২৬ শতাংশে ওঠে। আসন্ন ইউরোপীয় পার্লামেন্টে তারা আরো আসন পাবেন বলে মনে করা হচ্ছে।
হাঙ্গেরির প্রেসিডেন্টের হাতে তেমন ক্ষমতা ছিল না। ধর্ষণের অপরাধীকে ক্ষমা করে তিন পদত্যাগে বাধ্য হন। তবে বিষয়টা যত বড় করে দেখানো হয়, বাস্তবতা তা নয়। সেখানে প্রকৃ ত ক্ষমতার অধিকারী প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান। তিনি ক্ষমতা ধরে রাখতে হাঙ্গেরির সংবিধান এবং নির্বাচনী কাঠামো পরিবর্তন করেছেন, রাষ্ট্রের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ সব জায়গায় মিত্রদের বসিয়েছেন। হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে বিক্ষোভ চলছে বটে এবং বুদাপেস্ট একমাত্র নির্বাচনী এলাকা, যেখানে অরবানের দল কোনো আসন পায়নি। দুর্ভাগ্যবশত, বুদাপেস্ট সম্পূর্ণ হাঙ্গেরির প্রতিনিধিত্ব করে না। রোমাবিরোধী, অভিবাসনবিরোধী কুসংস্কার ও ইসলাম ফোবিয়া হাঙ্গেরির সমাজে গভীরভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। অরবান এই রাজনৈতিক নীতিকে রাষ্ট্রীয় পরিসরে বাস্তবায়ন করছেন। গাজা হামলার কারণে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে আপাতদৃষ্টিতে বিশ্বরাজনীতিতে বিচ্ছিন্ন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখা যায় বটে, তবে রাজনৈতিকভাবে তাঁর অবস্থানকে দুর্বল ভাবা ভুল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মতো উগ্র ডানপন্থি জনতুষ্টিবাদীকে অনুসরণ করে নেতানিয়াহুও আদর্শিকভাবে বিকল্পহীন নেতারূপে নিজেকে তৈরি করেছেন। তিনি 'মিস্টার সিকিউরিটি ম্যান' তথা সুরক্ষাকারী হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি তৈরিতে সচেষ্ট। তবে হামাসের হামলা যেহেতু এই ভাবমূর্তিতে ধাক্কা দিয়েছে, এখন তিনি 'মিস্টার নো প্যালেস্টাইন স্টেটম্যান' তথা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতিবন্ধক নেতারূপে নিজের ভাবমূর্তি তৈরির চেষ্টায় লিপ্ত। নেতানিয়াহু এবং তাঁর নতুন এ ভাবমূর্তিকে ইহুদি অতি জাতীয়তাবাদী এবং অতি ডান দলগুলোর জোট সমর্থনও করছে।
সমর্থন চলমান সংঘাত থেকে স্পষ্ট এই অতি ডানপন্থি চরমপন্থিরা শিগগিরই দৃশ্যপট থেকে বিদায় নিচ্ছে না। পরিসংখ্যানও বলছে, জনতুষ্টিবাদ আরো শক্তিশালী হচ্ছে। ভারতে পিউ রিসার্চের গবেষণা ইঙ্গিত করছে, জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য অংশ তথা ৩১% মানুষ কর্তৃত্ববাদী সরকার চায়, যেখানে বিচার বিভাগ বা পার্লামেন্টের ন্যূনতম হস্তক্ষেপ থাকবে না।
যদি রাজনৈতিক চরমপন্থার পরিমাপের মডেল থাকতো, তাহলে মোদি, অরবান, ট্রাম্প, সুনাক এবং মেলোনির মতো ব্যক্তিরা পুতিনের কাছাকাছি পৌঁছতেন। এটা স্পষ্ট জনতুষ্টিবাদীরা নিছক ক্ষমতাই চায় না, বরং তাদের 'বিকল্প বাস্তবতা' সম্পর্কিত বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি চাপিয়ে সমাজের চরিত্র পুনর্নির্মাণ করতে তারা নিরঙ্কুশ ক্ষমতা চায়। জনতুষ্টিবাদের বিরোধীদের উচিৎ জনতুষ্টবাদের বিদায় সম্পর্কে লেখার পরিবর্তে বরং জনতুষ্টিবাদ কেন সদর্পে চলছে, তা বোঝার দিকে মনোনিবেশ করা। তাদের জনগণের কাছে যেতে হবে; কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার সাহস থাকতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ হলো, তাদের এমন কাজ করতে হবে, যাতে গণতন্ত্রের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরে আসে। মানুষকে উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুফল বোঝাতে পারলে তারা জনতুষ্টিবাদীদের সমর্থন করা থেকে ফিরে আসবে।
(দ্য ওয়্যার ডটইন থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর)
লেখক: গণনীতি গবেষক।