স্বনামধন্য প্রয়াত মার্কিন রিপাবলিকান সিনেটের জন ম্যাককেইনের স্ত্রী সিল্ডি ম্যাককেইন জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রধান। তিনি সম্প্রতি এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, প্যালেস্টাইনের গাজার জনগণ বর্তমানে অনাহারে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। যে গতিতে এই মনুষ্যসৃষ্ট ক্ষুধা ও অপুষ্টিজনিত পরিস্থিতি গাজাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে, তা সত্যিই অত্যন্ত ভয়াবহ।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার অপর এক কর্মকর্তা, বেথ বেখডল জানিয়েনে, গাজার পুরো জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ মানুষের দুর্ভিক্ষাবস্থার মধ্যে পতিত হওয়া এক অভূতপূর্ব ঘটনা। যার অর্থ হলো- সেখানকার ১১ লক্ষ মানুষ বর্তমানে ভয়াবহ ক্ষুধা ও অনাহারের সঙ্গে সংগ্রাম করছে। নিদারুণভাবে ক্ষুধার্ত মানুষের এত বড় সংখ্যা এর আগে কোথাও দেখা যায়নি বলে সমন্বিত খাদ্য নিরাপত্তা সংগঠনের সম্প্রতিক প্রকাশিত এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।
আশু ত্রাণ সরবরাহ করা না গেলে অচিরেই গাজা মৃত মানুষের এক বিশাল ভাগাড়ে পরিণত হবে বলে বিভিন্ন মহল থেকে আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে।
গাজার অধিকাংশ বাড়িঘর ইতোমধ্যে ইসরায়েলি গোলা ও বোমা বর্ষণে বিধ্বস্ত হয়েছে। মানুষ তাঁবু টাঙিয়ে সেখানে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে।
প্যালেস্টাইনের জনৈক গায়ক তার গানের কথায় সেখানকার পরিস্থিতির ভয়াবহতা তুলে ধরেছেন এভাবে- Your Crescent moon has appeared, Ramadan. What is the crescent of our joy?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্ব জনমত গাজায় যুদ্ধ বন্ধ ও অবিলম্বে সেখানে ব্যাপক ত্রাণ তৎপরতা শুরুর তাগিদ দিলেও ইসরায়েলের তরফ থেকে এ ব্যাপারে তেমন কোনো অর্থবহ সাড়া মেলেনি। উল্টো ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু হুমকি দিয়ে বলেছেন- প্যালেস্টাইনের হামাস সংগঠন ও এর নেতা-সদস্যদের সম্পূর্ণভাবে উৎখাত ও নির্মূল না করা পর্যন্ত তাদের সামরিক অভিযান অব্যাহত থাকবে। এবং এক্ষেত্রে কোনো ধরনের আবেদন-নিবেদনে তারা কর্ণপাত করবে না।
এই লক্ষ্য হাসিলের জন্য ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজার বিভিন্ন হাসপাতালে হামলা পরিচালনা ছাড়াও সেখানে গিয়ে কর্তব্যরত স্টাফ ও চিকিৎসকদের হাত-পা বেঁধে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে তাদের কাছ থেকে হামাস সদস্যদের অবস্থান জানতে চাইছে। ইসরায়েলিদের ধারণা- বহু হামাস সদস্য রোগীর ছদ্মাবরণে হাসপাতালগুলোতে আত্মগোপন করে আছে।
মিডিয়া সূত্রে জানা যায়, ইসরায়েলি সেনারা অবরুদ্ধ প্যালেস্টাইনি নারীদের সম্ভ্রমহানীমূলক কর্মকাণ্ডেও ব্যাপকভাবে লিপ্ত রয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও মদদদাতা। এসব দেশ কর্তৃক ইসরায়েলে প্রেরিত সমরাস্ত্র বর্তমানে প্যালেস্টাইনের নিরীহ বেসামরিক মানুষ হত্যায় ব্যবহৃত হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বহু দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতার নিন্দা করে প্রতিনিয়ত প্রতিবাদ-বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বহু শহরের সাধারণ মানুষ ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীরা এ ধরনের প্রতিবাদ-বিক্ষোভে শামিল হয়েছেন।
তাদের অনেকে Free Palestine I Stop Aid to Israel লেখা প্ল্যাকার্ড বহন করছে। গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের বাড়াবাড়ির নিন্দা করে ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বেশ কয়েকজন নেতাকেও সোচ্চার হতে দেখা যায়। যাদের মধ্যে রয়েছেন- সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স, কংগ্রেসওম্যান প্রমিলা জয়াপাল, ইলহান উমর, রাশিদা তালিব ও আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও কর্টেজ প্রমুখ।
তারা ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনপূর্বক সে দেশের ওপর ব্যাপক চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে বিদ্যমান সংকট সমাধানের দাবি জানান। তাছাড়া, ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রাইমারি নির্বাচনে একাধিক রাজ্যে ডেমোক্র্যাটিক ভোটারদের অনেকে বাইডেনকে ভোট না দিয়ে ব্যালট পেপারে নিজেদেরকে Non-Committed উল্লেখ করে ইসলাইয়েলের প্রতি মার্কিন নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ নিয়ে ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে বিদ্যমান বিভক্তি ও এই ইস্যুতে ভোটারদের ক্ষোভ দেখে মার্কিন সংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটের মেজরিটি লিডার চাক শুমার গত ১৪ মার্চ সিনেটে প্রদত্ত এক বক্তব্যে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুর ভূমিকার তীব্র নিন্দা জানান।
তিনি তাকে সে অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান অন্তরায় হিসাবে উল্লেখ করে অবিলম্বে ইসরায়েলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সেখানে নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার তাগিদ দেন।
তার ভাষায়, Israel lost its way.
চাক শুমার মার্কিন কংগ্রেসের শীর্ষ স্থানীয় ইসরায়েল সমর্থক নেতা। ধর্ম বিশ্বাসের দিক দিয়ে তিনি একজন ইহুদি। যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস পূর্বে চাক শুমারের এহেন বক্তব্য বহু মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। ইসরায়েল সমর্থক মহল ও মিডিয়া এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে শুমার ‘রেড লাইন’ অতিক্রম করেছেন বলে অভিযোগ করেন।
প্রেসিডেন্ট বাইডেন শুমারের বক্তব্য প্রসঙ্গে বলেন, He made a good speech, and I think he expressed serious concern shared not only by him, but by many Americans.
ইসরায়েল সমর্থক ভোটারদের আনুকূল্য পেতে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ডেমোক্র্যাটদের ইসরাইল ও ইহুদী ধর্মবিদ্বেষী বলে বর্ণনা করেন।
শুমারের বক্তব্য সম্পর্কে বাইডেনের প্রতিক্রিয়ায় প্রতীয়মান হয়, শুমার প্রেসিডেন্টসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলেই এ ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। যে কারণে কেউ কেউ তার বক্তব্যকে একটি চতুর রাজনৈতিক চাল হিসেবে দেখছেন।
ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধে ইসরায়েলের ভূমিকা প্রশ্নে নিজ দলের মধ্যকার বিভক্তি এবং ভোটারদের মধ্যে বিদ্যমান ক্ষোভ প্রশমনের জন্যই শুমার এ ধরণের বক্তব্য দেন বলে তারা মনে করেন।
কোনো কোনো মহল এটাও মনে করেন, শুমার যদি সত্যিকার অর্থেই ইসরায়েলের আচরণের পরিবর্তন চান, তাহলে তার উচিৎ হবে সিনেটে প্রস্তাব এনে ইসরায়েলে মার্কিন সমরাস্ত্রের শিপমেন্ট বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়া। কারণ এই সমরাস্ত্রই ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে গাজায় গণহত্যা চালাতে শক্তি যোগাচ্ছে।
এসব মহল আরো মনে করেন, শুমারের বক্তব্য কোনোভাবেই যুক্তরাষ্ট্রকে সংকট নিরসনে উদ্যোগী হতে সহায়তা করবে না। এটা কেবল গাজায় ইসরায়েলের মাত্রাতিরিক্ত প্রতিশোধস্পৃহা প্রশ্নে ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে বিভেদের মাত্রা হ্রাসেই ভূমিকা রাখতে পারে।
তারা মনে করেন, কেবল পয়েন্ট বানানোর জন্য বক্তব্য না দিয়ে শুমারের উচিৎ হবে গাজায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতির পক্ষে সোচ্চার হওয়া, যা জিম্মি মুক্তি এবং সেখানে ত্রাণ সহায়তা প্রেরণে সহায়ক হবে।
সেই সাথে প্যালেস্টাইন ও ইসরাইল কীভাবে তাদের পারস্পরিক স্বাধীনতা, সম্মান, নিরাপত্তা এবং স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর হতে পারেÑ সে বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা।
লেখক : কলামিস্ট।