Thikana News
১১ মে ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা রবিবার, ১১ মে ২০২৫

ত্যাগ ও ভোগের সম্মিলনে দূরীভূত ক্লেশ 

ত্যাগ ও ভোগের সম্মিলনে দূরীভূত ক্লেশ 

এস এম মোজাম্মেল হক

‘মানুষ মানুষের জন্য জীবন জীবনের জন্য’ অতি সাধারণ এ বাক্যটির মধ্যে লুক্কায়িত আছে বিশেষ তাৎপর্য। মানুষ শুধু মানুষের জন্য নয় বরং পরের অংশ জীবন জীবনের জন্যÑএটিই আসল সত্য। শুধু মানুষ মানুষের জন্য হলে এবং অযত্নে-অবহেলায় পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেলে পৃথিবী তার সৌন্দর্য ও ভারসাম্য হারাত এবং মানুষও অন্যান্য প্রাণী থেকে তার প্রয়োজনীয় যে উপাদান পায়, তা থেকে বঞ্চিত হতো, এমনকি পৃথিবী তার বাসযোগ্যতা হারাত, সন্দেহ নেই। এত কথা বলার পেছনে যে কারণ, তা হলো পৃথিবীর সবকিছু পরস্পর নির্ভরশীল। শুধু শ্রেষ্ঠত্বের জন্য মানুষই পৃথিবীর একমাত্র অধিকারী তা নয়, পৃথিবীতে বসবাসকারী প্রতিটি জীবেরই নির্দিষ্ট আবহে চলার এবং ভোগের অধিকার রয়েছে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, পৃথিবীর বেশির ভাগ প্রাণীরই খাদ্য, বাসস্থান বা অন্যান্য চাহিদার বেশির ভাগ প্রাকৃতিকভাবেই মিটে থাকে। 

গৃহপালিত কিছু পশুপাখির ভরণপোষণের দায়িত্ব মানুষ গ্রহণ করলেও বহু বন্য প্রাণীর ভরণপোষণ প্রাকৃতিকভাবেই সংস্থান হয়ে থাকে। সুতরাং বলা বাহুল্য, সৃষ্টিজগতের সব প্রাণীকেই আত্মনির্ভরশীল করে সৃষ্টি করা হয়েছে, যদিও খাদ্য, বাসস্থান ও অন্যান্য বহু কিছু পারস্পরিক নির্ভরশীল করে দেওয়া হয়েছে। এর পেছনে অন্যতম কারণ হতে পারে পরীক্ষা। এ বিবেচনায় মানবতা ও মনুষ্যত্ব যে কেবল মানুষের প্রতি দরদ, ভালোবাসা বা কর্তব্যবোধ তা-ই নয়, এ কর্তব্যবোধ ভিন্ন প্রাণিকুলের জন্যও প্রযোজ্য বইকি!

‘আপনারে বড় বলে বড় সেই নয় লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়।’ বাংলা ভাষার অতিপরিচিত ও প্রচলিত একটি প্রবাদ। বড়ত্ব কেবল শিক্ষা, অর্থ বা পেশিশক্তিনির্ভর কোনো বিষয় নয়। বড় হওয়ার জন্য প্রয়োজন বড় হৃদয়ের, যা অর্থবিত্ত বা উচ্চশিক্ষানির্ভর নয়। বড়ত্বের জন্য প্রধান উপজীব্য হলো সব ধরনের আইন ও নিয়মনীতির মান্য ও চর্চা থাকা। জাতীয়ভাবে এই আদর্শ প্রতিপালনে যে জাতি যত অগ্রসর, তারা তত বেশি উন্নত ও অগ্রসরমান। সমাজে ন্যায্যতা থাকলে ধনী-গরিব, ক্ষমতাবান-ক্ষমতাহীন কেউই সমাজে তুচ্ছ নয় এবং কেউই সমাজে নিজেকে হীন ভাবে না। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যখন এই নীতি-আদর্শ বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা থাকে, সেই রাষ্ট্র হয়ে ওঠে তত মানবিক। রাষ্ট্র পরিচালনা তথা রাষ্ট্রের ব্যয় নির্বাহের জন্য রাষ্ট্রের কোনো ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রয়োজন হয় না বরং রাষ্ট্রীয় আইনি কাঠামোর মধ্যে নির্ধারিত রাষ্ট্রের ধনিক শ্রেণির কর আহরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করা হয়। যে রাষ্ট্র যত বেশি কল্যাণকর ভূমিকায় অবতীর্ণ, সে রাষ্ট্র তত বেশি মানবিক এবং রাষ্ট্রের জনগণ তত বেশি নির্ভার। কল্যাণ রাষ্ট্রে বসবাসকারী শুধু জনগণই যে কল্যাণমূলক পদক্ষেপের আওতায়, তা নয় বরং সে ভূখণ্ডে অবস্থানকারী প্রতিটা প্রাণীই এ সুবিধা ভোগ করে থাকে।

রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যই হলো সেটি যতই উন্নত হোক, সেখানে ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ভালো-মন্দ সব কিসিমের লোক থাকবে-এটাই স্বাভাবিক। সব সূচকে আমেরিকা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দেশ এবং এর অঙ্গরাজ্য ও শহরের মধ্যে নিউইয়র্ক অন্যতম শ্রেষ্ঠ অঙ্গরাজ্য ও শহর। তাই বলে এখানে রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য মোতাবেক গরিব থাকবে না, তা তো হয় না। তাই এখানেও ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ভালো-মন্দ সব ধরনের লোকের বসবাস রয়েছে। তবে এখানেও একটি বাংলা প্রবাদ বিশেষভাবে প্রযোজ্য আর তা হলো, ‘পরিশ্রমে আনে ধন পুণ্যে আনে সুখ, আলস্য আনে দরিদ্রতা পাপে আনে দুঃখ।’ এখানে যেমন বহু বিলিয়নিয়ারের বাস পক্ষান্তরে গৃহহীন/হোমলেসও রয়েছে। এর অন্যতম কারণ প্রবাদের বিষয়বস্তু। নিউইয়র্ক শহর বহুজাতিক ও বহুভাষাভাষী লোকজনের বসবাসে সমৃদ্ধ। 
এখানে বেশির ভাগ মানুষই কর্মঠ এবং তাদের জীবনযাপনও সাধ্যের মধ্যে সম্মানজনক। এখানে সব ধরনের লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকায় কর্মে আগ্রহী লোকদের তেমন বেকারত্ব ভোগ করতে হয় না, তবে কর্মবিমুখ লোকজনকেই অভাবী ও গৃহহীন/হোমলেস অবস্থায় থাকতে হয়। তা সত্ত্বেও লোকজনের সাহায্য-সহযোগিতায় দৈনন্দিন খাবারদাবারের ব্যবস্থা হয়ে গেলেও থাকার তেমন সুব্যবস্থা নেই এবং তারা খুব বেশি অখুশি নয় বলেই মনে হয়। কারণ অনেক গৃহহীন/হোমলেসকে থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থাসহ সরকারি শেল্টারে আশ্রয় দেওয়া হলেও অনেকেই সেখানে না থেকে পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে। নিউইয়র্ক শহরটি স্কুল-কলেজ, প্রশস্ত সড়ক, পার্ক, খেলাধুলা, বিনোদন সব দিক থেকেই একটি আদর্শ শহর। এখানে সড়কের পাশে এবং বিভিন্ন এলাকায় প্রচুর গাছ ও বনের প্রাধান্য রয়েছে। কোনো কোনো বনে হরিণ ও কম হিংস্র প্রাণীর আধিক্যও লক্ষ করা যায়। এ ছাড়া রয়েছে অন্যান্য অসংখ্য জীবজন্তু। প্রায় সব ধরনের পাখির পাশাপাশি প্রচুর বেওয়ারিশ কবুতর, বিভিন্ন জাতের হাঁস ও অন্যান্য হালাল খাবার উপযোগী পাখপাখালি কিন্তু ভুলেও তা কেউ ধরে খাওয়ার চিন্তা করে না। 

কারণ, এখানকার আইনে তা নিষিদ্ধ এবং এ রকম বেআইনি কাজে কেউ কখনো অভিযুক্ত হলে সে নিজের জন্য ডেকে আনবে বিশাল সর্বনাশ। এখানে কাঠবিড়ালির আধিক্য এত বেশি, যা কল্পনার অতীত। বছরের অর্ধেক সময় প্রচণ্ড ঠান্ডা ও এত প্রতিকূল আবহাওয়া এবং মনুষ্য নির্ধারিত কোনো রুটিনমাফিক খাবারের সুব্যবস্থা না থাকা সত্ত্বেও মানুষের চাহিদার অতিরিক্ত উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়েই এসব পশুপাখি নিজেদের জীবন-জীবিকা সুন্দরভাবে চালিয়ে নিচ্ছে। এটাই এ শহরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এখানেও ত্যাগ ও ভোগের সম্মিলনে যে ক্লেশ থেকে মুক্তি, সে সৌন্দর্য বিদ্যমান। তাই বলা যায়, কেউই এখানে অনাহারি ও বিপদগ্রস্ত নয়। (চলবে)

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও গবেষক।

কমেন্ট বক্স