Thikana News
২৭ জুলাই ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

ঘুরে এলাম বাংলাদেশ

ঘুরে এলাম বাংলাদেশ
৬০-এর দশকে শ্যামল মিত্রের গাওয়া একটি গান তুমুল জনপ্রিয় হয়। গানটি হলোÑ ‘আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে, সাত সাগর আর তের নদীর পাড়ে, ময়ুরপঙ্খী ভিড়িয়ে দিয়ে সেথা, দেখেন এলাম তারে’। শ্যামল মিত্রের গানের রাজকন্যা যে দেশে থাকে, সেটাই আমার জননী জন্মভূমি বাংলাদেশ। গায়ক সেখানে ময়ুরপঙ্খীতে চড়ে গেলেও আমি সেখানে যাই কাতার এয়ারওয়েজের বিমানে চেপে। দীর্ঘ দু’দশকের অধিক সময় পর এটাই আমার প্রথম বাংলাদেশ যাওয়া। ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া, চাকরি, আমার ও স্ত্রীর গুরুতর অসুস্থতা ইত্যাদি নানা কারণে এতদিন বাংলাদেশে যাওয়া সম্ভব হয়নি। গত বছর বাংলাদেশে যাওয়ার স্থির সিদ্ধান্ত নেই। সেজন্য টিকিট বুকিং, ছেলেমেয়ের কর্মস্থল থেকে ছুটি নেয়া এবং আমাদের আমেরিকান পাসপোর্টে ‘নো ভিসা রিকোয়ার্ড’ সিল লাগানোর কাজ সম্পন্ন করা হয়। ‘নো ভিসা সিল’ লাগানোর ক্ষেত্রে নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনসুলেটের ডেপুটি কনসাল জেনারেল নাজমুল হাসানের আন্তরিক সহযোগিতা ভোলার নয়।
গত ২৮ ডিসেম্বর জেএফকে থেকে কাতার এয়ারের রাত দেড়টার ফ্লাইটে আমরা ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করি। আমার আত্মীয় শাহীন, পাভেল ও মিল্টন তাদের গাড়িতে করে রাত সাড়ে দশটায় আমাদের বিমান বন্দরে নামিয়ে দেয়। প্রয়োজনীয় সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আমরা প্রায়োরিটি পাস (Priority Pass) যাত্রীদের জন্য নির্ধারিত লাউঞ্জে এসে কিছু খাবার খেয়ে ও কফি পান করে কিছু সময় পরে বিমানে আরোহণ করি। দীর্ঘ ১২ ঘণ্টা পর আমাদের বিমান কাতারের দোহা হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বিমান বন্দরের আল মাহা লাউঞ্জে এক ঘণ্টা অবস্থানের পর অন্য একটি বিমানে আমাদের ঢাকা নিয়ে যাওয়া হয়। দোহা থেকে ঢাকা পৌঁছাতে ৫ ঘণ্টা সময় লাগে। পরদিন দুপুরের পর আমরা ঢাকা পৌঁছাই। কোনো ঝামেলা ছাড়াই ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে আসি। দীর্ঘ দু’দশক পর নিজ মাতৃভূমিতে ফিরতে পারাকে আমার কাছে একটি পরাবাস্তব (Surreal) ঘটনা বলে মনে হলো। আবেগে আপ্লুত চোখ দুটি নিজে থেকেই অশ্রুসিক্ত হয়ে গেলো। রিসিভ করার জন্য আমার ছোট দু’ভাই মাসুদ ও শেলী, মামা আবিদ, শ্যালিকা পলি ও তাঁর স্বামী রুবেল উপস্থিত ছিল। তাদেরকে নিয়ে দুটি বড় গাড়িতে পুরনো বিমান বন্দরের উল্টো দিকের হোটেল এমপ্রিয়ানে এলাম। এখানে ছেলে, মেয়ে, পুত্রবধূ এমি ও শ্যালক পুত্র তাহমিদকে নামিয়ে দিয়ে আমরা শাহীনবাগের বাসায় চলে আসি। ঢাকা থাকাকালে ছেলে, মেয়ে, পুত্রবধূ ও তাহমিদ এই হোটেলেই অবস্থান করে। 
ঘরে প্রবেশ করে দেখি ডাইনিং টেবিলে ৭/৮ পদের খাবার সাজিয়ে রাখা হয়েছে। হাত-মুখ ধুয়ে লিভিং রুমে বসে সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করে খেতে বসি। যতদিন ঢাকায় ছিলাম, প্রতিদিনের মেন্যুতে মাংস, ডিম, ইলিশ, রুই ও চিংড়ি মাছ ভাজা ও ভূনা এবং ফুলকপি, নতুন আলু ও শিমের সবজি অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাছাড়া, নানা ধরনের পিঠা ও পেঁয়াজু খাবার তালিকায় নিয়মিত ছিল। বলাবাহুল্য, প্রতিটি খাবারই ছিল অত্যন্ত উপাদেয় ও সুস্বাদু।
বাংলাদেশে অবস্থানকালে গত ৭ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনকে ঘিরে বিরোধী দলের আন্দোলন কর্মসূচি থাকায় সর্বত্র এক ধরনের থমথমে ভাব বিরাজ করছিল। নির্বাচনের পূর্বে ঢাকায় বেনাপোল এক্সপ্রেস  ট্রেনে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় কয়েকজনের হতাহতের ঘটনায় মানুষের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্কের সৃষ্টি হয়, যদিও শেষ পর্যন্ত দু-একটি বিক্ষিপ্ত অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়া বেশ শান্তিপূর্ণভাবেই নির্বাচন সম্পন্ন হয়। নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে তেমন কোনো উৎসাহ বা আগ্রহ দেখা না গেলেও ঢাকা শহর নৌকা প্রতীকের পোস্টারের সয়লাব ছিল। 
এখানে সেখানে জাতীয় পার্টির দু’একটি পোস্টার দেখা গেলেও অন্য কোনো প্রার্থীর পোস্টার নজরে পড়েনি। বিএনপি, জামায়াতে ইসলাম, মান্না, ভিপি নূর, কর্নেল অলি, জোনায়েদ সাকীর নেতৃত্বাধীন দলগুলো নির্বাচন বর্জন করায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন এক তরফা নির্বাচনের প্রতি মানুষের আগ্রহ না থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক। নির্বাচনে সরকারিভাবে ৪০ শতাংশ ভোট পড়ার কথা বলা হলেও সেই হার ত্রিশের নিচেই হবে- অনেকের ধারণা। 
নির্বাচনের দিন শেষ বেলায় জনশূন্য ভোট কেন্দ্রে ‘উপরের নির্দেশে’ ব্যালট পেপারে সিল দিয়ে ভোটদানের হার বৃদ্ধি করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। ভোটের ফলাফল দেখে নতুন সংসদ একদলীয় হবে মনে করা হচ্ছে। 
মাত্র ১১ সদস্য নিয়ে জাতীয় পার্টি নামেমাত্র বিরোধী দল হবে। নির্বাচিত ৬২ জন স্বতন্ত্র সদস্যের প্রায় সবাই সরকার দলীয় নেতাকর্মী। হেভিওয়েট প্রার্থী হাসানুল হক ইনু, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, কাদের সিদ্দিকী, মেজর আখতার ও মেজর শমসের মবিন চৌধুরীর পরাজয় এবং হবিগঞ্জের চুনারুঘাট-মাধবপুর আসনে বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলীকে হারিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী ব্যারিস্টার সুমনের চমকপ্রদ জয় অনেক মহলে আলোচনার বিষয় ছিল। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হওয়ার আগামীদিনেও বিরোধীদলের আন্দোলন চালু থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে তাদের আন্দোলন কর্মসূচি সহিংস হবে না, সেটাই সবার প্রত্যাশা।
ঢাকায় পৌঁছার দু’দিন পর আজিমপুর গোরস্থানে বাবা-মা ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের কবর জিয়ারতের জন্য যাই। সেদিন কলাবাগান খেলার মাঠে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী জনসভার কারণে সড়কগুলোতে বহু মিছিল থাকায় ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়। যানজট এড়িয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে আমাদের অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। যাত্রাপথে এক পর্যায়ে কলাবাগানে নিজের পৈত্রিক নিবাসে গিয়ে জালি কাবাব ও ঢাকার বিখ্যাত হাজীর বিরিয়ানী দিয়ে দুপুরের খাবারের পর্ব শেষ করি। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে আমাদের প্রতিবেশী মেহেরু আপা ও তার স্বামী আনু ভাই উপস্থিত ছিলেন। অজিমপুর যেতে সাইন্স ল্যাবরেটরি ও নিউমার্কেট এলাকায় অসহনীয় যানজটে পড়ে দুর্ভোগের শিকার হই। আজিমপুর গোরস্থানে কবর জিয়ারত ও দোয়া-মোনাজাত শেষে মিরপুর রোড ধরে না গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ হয়ে বাসায় ফিরে যেতে মনস্থির করি। কিন্তু এই সড়কের ফার্মগেট পর্যন্ত এলাকায় ছিল ব্যাপক যানজটের যন্ত্রণা। সড়কে যানজট ও ফুটপাতে বিপুল সংখ্যক মানুষের পদচারণা দেখে ঢাকাতে আমার কাছে এক অসম্ভব নগরী (Impossible City) বলে মনে হয়েছে। এ কারণে পরের দিনগুলোতে ঘরের বাইরে বোরোতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলি।
পুরনো ঢাকায় দু’জন আত্মীয়ের (সাবরিনা ও সুজন ভাই) ডিনারের নিমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিতে হয়। আমার অতি পরিচিত গ্রিনরোড, পরীবাগ, হেয়ার রোড, শান্তিনগর, কাকরাইল, পুরানা পল্টন, মতিঝিল ও গুলিস্তান ইত্যাদি এলাকা ঘুরে দেখার ইচ্ছাও পরিত্যাগ করতে হয়। সোনারগাঁও হোটেলের সামনের দৃষ্টিনন্দন সার্ক ফোয়ারাটিকে জরাজীর্ণ ও অচল অবস্থায় দেখতে পেলাম। কেউ একজন বললেন, ফোয়ারাটি বিএনপি আমলে তৈরি হয় বলে এর রক্ষণাবেক্ষণে বর্তমান সরকারের তেমন মাথা ব্যথা নেই। এটা জেনে খুব খারাপ লাগলো। তাছাড়া পান্থপথ সংলগ্ন বাংলামোটর পর্যন্ত বিস্তৃত পান্থকুঞ্জ পার্কটিকেও বেহাল অবস্থায় দেখলাম। এক সময় দৃষ্টি নন্দন এই পার্কটি প্রতিদিন সকালে-বিকালে বহু মানুষের পদচারণায় মুখর থাকতো। পার্কটির অভ্যন্তরের ইট-বালু-সিমেন্টের স্তুপ ও যত্নের অভাবে গাছগুলোকে বিবর্ণ দেখতে পেলাম। 
বহু নেতা ও কর্তাব্যক্তির চোখের সামনে এই পার্কটির করুণ দশা দেখে খুবই কষ্ট পেলাম। তাছাড়া পথের বিভিন্ন স্থানে নতুন নতুন সুদৃশ্য ভবনের পাশে পুরনো বিবর্ণ ও নির্মাণাধীন ভবনের সহাবস্থান বেশ দৃষ্টিকটূ লেগেছে। নির্বাচনের পরদিন ধানমন্ডির চিলিজ রেস্টুরেন্টে আমার আত্মীয়-স্বজনদের অনেককে নৈশভোজে আপ্যায়িত করলাম। এখানে আমার শ্বেতাঙ্গ পুত্রবধূর ভাঙা ভাঙা বাংলা বলা ও সবার সঙ্গে তার বিনয়ী আচরণে সবাইকে বিমোহিত ও মুগ্ধ হতে দেখলাম। আমার ঢাকায় আসার খবর আগেই জানতে পেরে আমার পূর্বতন কয়েকজন সহকর্মী (জাফর সাহেব, খালেক, আব্দুল্লাহ মিয়া ও একেএম আব্দুল্লাহ)  Happy Home Coming লেখা কেক নিয়ে একদিন আমার বাসায় এসে গাজির হলেন। তাদের দেখে ও কথা বলে মন ভরে গেল।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সংস্থার কর্মকর্তা হিসাবে তারা সবাই বারিধারা ও মিরপুর ডিওএইচএসে প্লট পেয়ে ডেভেলপারদের দিয়ে বাড়ি বানিয়ে একাধিক ফ্লাটের মালিক হয়ে সুখে-স্বাচ্ছন্দে জীবনযাপন করছেন দেখে খুব ভালো লাগলো।
ঢাকায় ১০দিন অবস্থানের পর গত ১০ জানুয়ারি নিউইয়র্কের উদ্দেশে প্রিয় জন্মভূমি ত্যাগ করি। ১১ জানুয়ারি নিউইয়র্কে বাসায় এসে পৌঁছি। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সম্ভাব্য সহিংস পরিস্থিতির মধ্যে আমার বাংলাদেশ সফর অত্যন্ত সুন্দর ও নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হওয়ায়, বাসায় ফিরে সর্ব শক্তিমানের দরবারে দু’রাকাত নফল নামাজ পড়ে কৃতজ্ঞতা জানাই।
লেখক : কলামিস্ট।

কমেন্ট বক্স